মুক্তিযুদ্ধ- মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম by সেলিনা হোসেন

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে একটি উপন্যাস লিখব বলে তথ্য সংগ্রহের জন্য অনেক আগে গিয়েছিলাম ১১ নম্বর সেক্টরের কামালপুর ও ধানুয়া গ্রামে। এ দুটি গ্রাম বর্তমান কামালপুর জেলার অন্তর্গত এবং ভারতের মেঘালয় সীমান্তের কাছে বাংলাদেশের অংশ। সীমান্তের ওপারে যে গ্রাম তার নাম মহেন্দ্রগঞ্জ, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল।
'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র' দশম খণ্ডে ১১ নম্বর সেক্টরের কথা যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে জানিয়েছেন, কামালপুর ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। কারণ স্থলপথে জামালপুর-টাঙ্গাইল-ঢাকা সড়কের প্রবেশদ্বার ছিল এ কামালপুর। ওরা জানত মুক্তিবাহিনীর হাতে কামালপুর ঘাঁটির পতন হলে মুক্তিবাহিনী দ্রুত ঢাকার পথে এগিয়ে যেতে পারবে এ পথে। এদিক থেকে মুক্তিবাহিনীরও লক্ষ্য ছিল কামালপুর ঘাঁটির পতন। তাই এখানে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ব্রিগেডিয়ার আমিন আহমদ চৌধুরী তাঁর লেখায় লিখেছেন, "তখনকার দিনে পাকশিবিরে বন্দি মেজর আজিজের ভাষায় বলতে হয়, পাকিস্তানিদের নিজেদের মতে কামালপুর হলো পাক সৈন্যদের মরণঘাঁটি। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে আজিজকে জিজ্ঞাসা করা হতো 'হয়ার ইজ ধানুয়া কামালপুর কিংবা হয়ার ইজ ইওর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট'।"
উপন্যাসের পটভূমির একটি অংশ হিসেবে আমি ধানুয়া-কামালপুরকে বেছে নিই। কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করে। সে জন্যই জায়গাটি দেখতে যাওয়া। ঢাকা থেকে কামালপুর পেঁৗছাতে পাঁচ ঘণ্টা লাগল। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পারে ফুলপুর, শেরপুর, বঙ্গিঞ্জ হয়ে কামালপুর পেঁৗছলাম। যে রাস্তাটি সোজা রৌমারীর দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তার মোড়ে কয়েকটি দোকান ছিল। সেখানে থামলাম আমরা। ওই দোকানের পাশ দিয়ে একটি কাঁচা সড়ক উত্তর দিকে সোজা চলে গেছে মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তে। ইদানীং এ সড়ক দিয়ে বোল্ডার আর কয়লা আমদানি হয়। চারদিকে খোলা মাঠ। কাঁচা রাস্তা ধূলি-ধূসরিত। ট্রাক গেলে ধুলোর কুয়াশা তৈরি হয়। কিছুক্ষণের জন্য চোখ মেলে রাখা যায় না। সীমান্তের অপর পারে কাঁটাতারের বেড়া, টাওয়ার। ইমিগ্রেশন পোস্ট। নোম্যানস ল্যান্ডে গরু চরে বেড়ায়। একাত্তরের দিনগুলোতে কী ভয়াবহ ছিল এসব এলাকা! কর্নেল তাহেরের লেখায় পড়েছি, ধানুয়ায় একটা বিশাল জলাভূমি ছিল। একসময় নকল রক্ষাবূ্যহ তৈরি করে পাকিস্তানি আর্মিকে ওই জলাভূমিতে বের করে এনে হত্যা করা হয়েছিল। মনে হলো, এখনো সেই জলাভূমি আছে। শুধু শীতকালে ওগুলো ধানক্ষেত হয়েছে। এখন কাটা ধানের পরিত্যক্ত প্রান্তর। সীমান্তের দূরে মেঘালয়ের পাহাড়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। তাকিয়ে দেখি, সামনে সীমান্ত চৌকি। এখন কী নীরব! শুধু মাঝেমধ্যে ট্রাকগুলো বোল্ডার কিংবা কয়লা বোঝাই করে আসা-যাওয়া করছে। অথচ একসময় কী প্রচণ্ড শব্দে ভরপুর ছিল এই শান্ত-স্নিগ্ধ প্রান্তর! দোকানদারদের জিজ্ঞেস করলাম, পাকিস্তানিদের বাংকারগুলো কোথায় ছিল? সব সমান হয়ে গেছে। এখন ওখানে হাট বসে। পশ্চিমে এগিয়ে যান। দেখবেন, কামালপুর সীমান্ত ফাঁড়ি লেখা আছে। ওখান থেকে বাঁয়ে গেলে বিডিআর ক্যাম্প। ওটাই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি ক্যাম্প ছিল। আর সামনের বড় মাঠটায় ছিল বাংকার।
গাড়ি নিয়ে আমরা হাটে গেলাম। দু-একটা মুদিদোকান খোলা। বাকি চালাগুলো খালি। বিকেল ৩টা থেকে হাট জমে উঠবে। আমাদের দেখে গ্রামবাসী এগিয়ে এল। কেউ কেউ যুদ্ধের সময়ের কথা মনে করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলতে থাকল, ওই যে বটগাছটা দেখছেন, বিশাল বটগাছ, ওটার গায়ে এখনো গুলির চিহ্ন আছে। ওই যে দেখেন ঘরটা? যুদ্ধের সময় গুদাম ছিল। তাকিয়ে দেখেন, শেল পড়ে কেমন ঝাঁজরা হয়ে আছে। এই যে এখানে_ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শহীদ হয়েছিলেন। ওই, ওপাশে দোকানের পেছনে শেলের আঘাতে কর্নেল তাহেরের পা বিধ্বস্ত হয়েছিল। যেদিনের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শহীদ হয়েছিলেন, সেদিন দু-তিন শ মুক্তিযোদ্ধাও শহীদ হয়েছিলেন। ধানুয়ায় তাঁদের গণকবর আছে। আবার কান্না। চোখ মোছা। মনে হয়েছিল, আমরা যেন একটি রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি। আর শত শত মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের গৌরবের দিনগুলোকে স্মরণ করছেন। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে জলপ্রপাতের মতো শব্দরাজি, যেন অচলায়তনের আড়াল সরে গেছে। বলতে ইচ্ছে করছে শত মুখে।
ওরা যখন কথা বলছে, তখন কামালপুর-ধানুয়া হয়ে রৌমারীর দিকে ছুটে যাচ্ছিল গাড়ি। মনে পড়ছে, ওই দিকে কোদালকাঠিচরে যুদ্ধ করেছিলেন তারামন বীর প্রতীক। ওখানে গেলেও এভাবে ছেঁকে ধরবে গ্রামবাসী। বলবে, আমরাও শত মুখে বলতে চাই গৌরবগাথা। মনে হলো, আমরাই সেই নষ্ট মানুষ যারা ভান করি, মিথ্যাচার করি, ফায়দা লোটার জন্য ব্যবহার করি মুক্তিযুদ্ধকে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য উড়িয়ে দিতে চাই গৌরবের দিনগুলোকে। সাধারণ মানুষ তো ঠিকই আছে। বুকের ভেতর বারুদের মতো ঠেসে রেখেছে। সামান্য প্রেরণায় তা ছুটে বেরিয়ে আসে।
সেদিন ওদের জিজ্ঞেস করলাম, এখানে যে রাজাকাররা ছিল ওরা কোথায়?
একজন বুড়ো কৃষক, ছোটখাটো_তীক্ষ্ন কণ্ঠে বললেন, রাজাকার বদরকার? সব সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে বলি, বদরকার? অদ্ভুত তো, এই বৃদ্ধ একটি নতুন শব্দ তৈরি করেছেন। কী প্রবল ঘৃণায় বদরকার শব্দটি উচ্চারণ করলেন! আমি নিজে তো আলবদরের প্রতিশব্দ বদরকার চিন্তা করতে পারিনি। রাজাকার-বদরকার! কামালপুরের যুদ্ধ করা মানুষের জীবন দিয়ে তৈরি করা শব্দ_একেই তো বলতে হয় নিরক্ষরতার ভেতরে শিক্ষিত চৈতন্যের বোধ।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবদুস সালামের ছেলে মাখন বলছিলেন, ধানুয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের যে গণকবরটি আছে, সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কথা আমরা অনেক দিন ধরে বলেছি। আগে গণকবরটি যতখানি আয়তনজুড়ে ছিল, সেটার আয়তনও ক্রমাগত কমে আসছে। শেষ পর্যন্ত স্মৃতিবিজড়িত এ স্থান কি সব কিছু হারিয়ে ইতিহাস থেকে মুছে যাবে? যদি তা-ই হয় তাহলে তা হবে আমাদের চরম ব্যর্থতা। এমনটি যেন না হয় সে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
=========================
১২ বছর আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে  চট্টগ্রাম ইপিজেডে সংঘর্ষে নিহত ৪  ড. ইউনূস : প্রতিটি বাংলাদেশির গৌরব  জলাভূমিবাসীদের দুনিয়ায় আবার..  আসুন, আমরা গর্বিত নাগরিক হই  স্মৃতির শহীদ মির্জা লেন  ইয়াংওয়ান গ্রুপের পোশাক কারখানা বন্ধ  ট্রানজিটে ১১ খাতের লাভ-ক্ষতির হিসাব শুরু  চট্টগ্রামের বনাঞ্চল ছাড়ছে হাতি  ট্রেন  স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি  মানবাধিকার লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার  মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশে দেশে  ক্ষমতা যেভাবে মানবাধিকার আর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে  চাক্কু মারা 'মশা' কাহিনী  উল্কির ভেলকি  এইচআইভি/এইডস্  উইকিলিকসঃ জুলিয়ান চে গুয়েভারা!  তিন কালের সাক্ষী  বাবর আলীর ইশকুল  এ মাটির মায়ায়  মধ্যবিত্তের উত্থান, না ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভব  হিমালয়ের পায়ের কাছেঃ গোধূলির ছায়াপথে  পতিত স্বৈরাচারের আস্ফালন ও আওয়ামী লীগের নীরবতা  ৪০ বছর পড়ে থাকা লাশটার সৎকার করতে চাই  এই কি আমাদের মানবাধিকার?  ঐতিহ্যের মধ্যে সমকাল  কেমন দেখতে চাইঃ ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা  দ্রীপ প্রতিভার দ্যুতিময় স্মারক  গল্প- বৃষ্টি  শহীদুল্লা কায়সারঃ রাজনৈতিক সৃষ্টিশীলতা  আনোয়ার পাশাঃ জাতিরাষ্ট্রের অংশ ও প্রেরণা  মুনীর চৌধুরীঃ তাঁর নাটক  জেগে ওঠার গল্প  এখন শুনবেন বিশ্ব-সংবাদ  বাঘ  বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১০


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ সেলিনা হোসেন


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.