স্বাস্থ্য আলোচনা- 'প্রসূতিসেবায় পিছিয়ে দেশ' by শেখ সাবিহা আলম

দেশে জরুরি প্রসূতিসেবা কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। সরকারি জেলা হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্তসংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স নেই।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠালেও অনেক কেন্দ্রে সেগুলো ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নেই। এতে জরুরি প্রয়োজনে সেবা পাচ্ছেন না প্রসূতি মায়েরা, বিশেষ করে গ্রামের মায়েরা। বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। জীবিত শিশু জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি লাখে ৩২০ জন মা মারা যাচ্ছেন। জাতিসংঘ বলছে, পৃথিবীর যেসব দেশে মাতৃমৃত্যুর হার বেশি, বাংলাদেশ তার অন্যতম।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে (এমডিজি) ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে ১৪৩ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউনিসেফের সর্বশেষ জরিপ (প্রগতির পথে, ২০০৯) বলছে, ৭৬ শতাংশ মা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পাচ্ছেন না।
এমডিজিবিষয়ক সরকারের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গর্ভবতী বা প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, বাধাগ্রস্ত প্রসব এবং অনিরাপদ গর্ভপাত। এসব জরুরি প্রয়োজনে সেবা দেওয়ার জন্য সরকার জরুরি প্রসূতিসেবা কার্যক্রম চালু করে।
এই কার্যক্রম তদারক করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রজননস্বাস্থ্য ইউনিট। ইউনিট সূত্র জানায় ২০০৯-১০ অর্থবছরে এই খাতে ৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সিংহভাগ উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও জেলা হাসপাতালে কার্যক্রম ঠিকভাবে চালাতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ৯০ কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু সেবার আওতা বাড়বে কি না তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না।
প্রজননস্বাস্থ্য ইউনিটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর লক্ষ্যে দেশের ১৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সমন্বিত জরুরি প্রসূতিসেবা কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সালে। পরে ৫৯টি জেলা হাসপাতাল ও সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও এই কার্যক্রম চালু করা হয়। এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল জরুরি সেবা প্রয়োজন ও গর্ভকালীন জটিলতা আছে এমন মায়েদের সেবা দেওয়া। কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে প্রতিটি হাসপাতালে রক্তসঞ্চালন কার্যক্রমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি হাসপাতালে একজন শল্যচিকিৎসক ও একজন অবেদনবিদ (অ্যানেসথেটিস্ট) পাঠানো শুরু হয়।
সাত বছর পর সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, এই কার্যক্রম ঠিকমতো চলছে না। সরকারি দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ৩৪টি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কার্যক্রমটি ঠিকমতো চলছে। ২৭টি কেন্দ্রে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বাকি ৭১টি কেন্দ্রে কার্যক্রম চলছে খুঁড়িয়ে। এসব কেন্দ্রে শল্যচিকিৎসক থাকলে অবেদনবিদ থাকছেন না। অবেদনবিদ থাকলে শল্যচিকিৎসক থাকছেন না। অথচ অস্ত্রোপচারের সময় এই দুজনের একসঙ্গে উপস্থিত থাকা দরকার। দীর্ঘকালীন ছুটি নিয়ে কিংবা প্রেষণে বড় শহরের হাসপাতালে চলে গেছেন অনেকেই।
প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও জেলা হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন, মূল্যবান যন্ত্রপাতি অব্যবহূত পড়ে আছে; কোনোটিতে শল্যচিকিৎসক নেই, কোনোটিতে অবেদনবিদ নেই, চিকিৎসকেরা ছুটি না নিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসচিব মো. হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকেরা যেন উপজেলা পর্যায়ে থাকতে আগ্রহী হন, সে জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক অবেদনবিদ নেই। এই সমস্যার সুরাহা কী করে করা যায়, তা নিয়ে সরকার ভাবছে।
কয়েকটি উদাহরণ: গফরগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ২১ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টা। হাসপাতালের ঠিক পেছনে সালটিয়া ইউনিয়ন থেকে প্রসূতি রূপালী বেগমকে পাঁজাকোলা করে তাঁর আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে নিয়ে আসেন জরুরি সেবার প্রয়োজনে। কিন্তু কেন্দ্রের স্ত্রী ও প্রসূতিরোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আফরোজা বেগম, জরুরি প্রসূতিসেবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুই চিকিৎসক হালিমা বেগম ও রায়হান ইসলাম ওই সময় হাসপাতালে ছিলেন না। কর্মকর্তারা জানান, জটিলতা নিয়ে কোনো নারী এলে সেবা না পেয়ে ৪০ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালটির অবেদনবিদ শরীফুল ইসলাম সম্প্রতি বদলি হয়ে গেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা তালাবদ্ধ একটি কক্ষ দেখিয়ে বলেন, জরুরি প্রসূতিসেবা দেওয়ার সব যন্ত্রপাতি আছে কক্ষটিতে। দুই বছর আগে রক্তসঞ্চালনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরকার পাঠিয়েছে। কিন্তু এসব ব্যবহার করা হচ্ছে না। এই কেন্দ্রে শল্যচিকিৎসক ও অবেদনবিদকে একসঙ্গে পাওয়া যায় না। ১৯৯৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মাকসুদা আহমেদ নামের একজন অবেদনবিদকে জুনিয়র কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাত্র এক দিনের জন্য তিনি হাসপাতালে আসেন। এরপর ১১ বছর তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেষণে ছিলেন। জরুরি অবস্থার সময় তিনি ওখানে কিছুদিন কাজ করেছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রওশন আলম খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আফরোজা বেগম অর্জিত ছুটিতে আছেন এবং হালিমা বেগম অসুস্থতাজনিত কারণে হাসপাতালে আসতে পারছেন না।
গাইবান্ধায় জোড়াতালি দিয়ে চলছে প্রসূতিসেবা: গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে ১২ বছর ধরে প্রসূতি বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। অবেদনবিদের পদ শূন্য আছে এক বছর ধরে। শল্যচিকিৎসা বিভাগে একজন চিকিৎসককে দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে অবেদনবিশেষজ্ঞ আবদুস সোবহানকে সদর হাসপাতালে এনে সপ্তাহে দুই দিন শল্যচিকিৎসার কাজে সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আমিনুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এখানে আসতে চান না। তাঁরা উচ্চপর্যায়ে ধরাধরি করে রংপুর ও বগুড়া মেডিকেল কলেজসহ পছন্দমতো হাসপাতালে চলে যান।
শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও নার্স নেই: গত সেপ্টেম্বরে শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নুশরাত আরা ইউসুফ নামের একজন স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ যোগ দিয়েছিলেন। তিনি মাত্র এক দিন ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করেছিলেন। তারপর থেকে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। এ ছাড়া হাসপাতালটিতে অবেদনবিদ নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (টিএইচও) এ বি এম আবদুর রকিব চৌধুরী জানান, এই উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো দিন কোনো জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয়নি। জরুরি কোনো প্রসূতি রোগী এলে তাঁদের সুনামগঞ্জ অথবা সিলেট শহরে যেতে বলা হয়। এ ছাড়া বিদ্যুতের সমস্যা প্রকট। রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়।
বান্দরবান আধুনিক সদর হাসপাতাল: কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বান্দরবান সদর হাসপাতালে আছে। কিন্তু তা মানুষের কোনো কাজে লাগে না। কারণ অভিজ্ঞ শল্যচিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সময়মতো থাকেন না। জটিল বা জরুরি রোগী হাসপাতালে এলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
লামা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রায় দুই বছর শল্যচিকিৎসক ও অবেদনবিদ না থাকায় শল্যচিকিৎসাসেবা বন্ধ রয়েছে। জরুরি রোগী স্থানান্তর করার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো অ্যাম্বুলেন্সও নেই।
বান্দরবানের সিভিল সার্জন মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সেবিকারা প্রসূতিদের সেবা দেন।
এ প্রসঙ্গে প্রজননস্বাস্থ্য ইউনিটের কর্মসূচি সমন্বয়ক কাজী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি দেশের বেশ কিছু উপজেলায় ডিমান্ড সাইড ফাইন্যান্সিং (ডিএসএফ) নামে নতুন একটি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এতে গর্ভকালীন জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে আসার জন্য মা ও সেবা দেওয়ার জন্য চিকিৎসকের জন্য আলাদা অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, এই কর্মসূচি থেকে বেশ ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। সরকার এই কর্মসূচি আরও বিস্তৃত করার চিন্তাভাবনা করছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের মাতৃস্বাস্থ্য ইউনিটের গবেষক ইকবাল আনোয়ার বলেন, দুর্গম এলাকায় জরুরি প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করতে সরকার সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারির কাজ শুরু করতে পারে। তিনি বলেন, ভারতের গুজরাটে দুর্গম এলাকায় চিকিৎসক সরবরাহের দায়িত্ব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে সুফল পাওয়া গেছে।
======================
রাজনৈতিক আলোচনা- 'বন্দিত কান্না, নিন্দিত হরতাল আর রাজকীয় অশ্রুপাতের গল্প' by ফারুক ওয়াসিফ  খবর- উত্তর কোরিয়ার নতুন পরমাণু প্ল্যান্ট দেখে 'তাজ্জব' মার্কিন বিজ্ঞানীরা  গল্পসল্প- 'মুজিব একবার আসিয়া সোনার বাংলা যাওরে দেখিয়ারে' by মোস্তফা হোসেইন  আন্তর্জাতিক- 'ওবামা কি ক্লিনটনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন?' by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী  কৃষি আলোচনা- 'পোষের শেষ মাঘের বারো' by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস  মণিপুরি মহা রাসলীলা উৎসবের ইতিকথা by মুজিবুর রহমান  প্রকৃতি- সমুদ্রে উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রবাল মড়ক  মণিপুরি রাসমেলা উৎসব by আকমল হোসেন নিপু  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'মডার্ন হাম্মুরাবি এবং কাঠের ঘোড়া' by আলমগীর সাত্তার  আলোচনা- 'কারাগার থেকে সংশোধনাগার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ' by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু  শিল্প-অর্থনীতি 'ক্ষুদ্রঋণের বিড়ম্বনা' by আহমদ রফিক  আন্তর্জাতিক- 'চীন ও দুর্লভ ধাতু নিয়ে উদ্বেগ' by পিটার কাস্টার্স  আলোচনা- 'সুশাসন-সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো' by এ এম এম শওকত আলী  খবর ও ফিচার- 'মুক্তি পেল নীলকণ্ঠ পাখি' by শরীফ খান  প্রকৃতি- 'বাংলাদেশে জীবিকা হারানো মানুষের ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুতি’  আলোচনা- 'প্রসঙ্গ : দুর্নীতি উৎপাটন' by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম  ইতিহাস- পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পরিচিতি



প্রথম আলো সৌজন্যে
লেখকঃ শেখ সাবিহা আলম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.