গল্পালোচনা- 'দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ?' by মহসীন হাবিব

তখনকার এথেন্স ছিল সৌন্দর্যের পূজারি। সে সময় একজন মানুষ শুধু শারীরিক সৌন্দর্যের কারণে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠত এথেন্সের সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। অন্য একজন মানুষ শুধু শারীরিক সৌন্দর্য না থাকায় সমাজে পিছিয়ে পড়ত।
এমনই এক সমাজে, এথেন্সের শহরতলি থেকে উঠে আসেন একজন মানুষ। পেটে গোল একটি ভুঁড়ি, গোল গোল চোখ, রোমশ হাত। অদ্ভুত তাঁর হাঁটার ভঙ্গি। এক কথায় দেখতে ভালো না। কিন্তু শারীরিক সৌন্দর্যের বদলে মেধার সৌন্দর্য দিয়ে তিনি কেড়ে নিলেন সমাজের বিত্তবান, সৈনিক, ব্যবসায়ী, যুবসমাজ_এমনকি শহরের যৌনকর্মীদের মন। তাঁর চিন্তা, দর্শন ও ব্যক্তিত্ব দ্বারা যুব সম্প্রদায় এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে তারা নতুন আলখাল্লা কিনে সেটা ছিঁড়ে পরিধান করত। সেটাই ছিল তাদের কাছে স্টাইল, গর্বের বিষয়। কারণ তাদের প্রাণপুরুষের গায়ের আলখাল্লাটি শতচ্ছিন্ন। অনেকেই তাঁর জীবনযাত্রার ধরন অনুকরণ করতে চেষ্টা করত। তাঁর খাদ্যাভ্যাস, বাচনভঙ্গি রপ্ত করার একটি রেওয়াজ উঠেছিল। সে রেওয়াজ কালক্রমে ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপে। আড়াই হাজার বছরের বিবর্তনে সেই বাহ্যিক অসুন্দর মানুষটি সব সৌন্দর্য জয় করে প্রাণপুরুষে পরিণত হয়েছেন। তিনি আর কেউ নন, পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত, প্রশংসিত, পশ্চিমা জ্ঞানদর্শনের জনক সক্রেটিস।কে জানে, হয়তো সক্রেটিসের কারণেই পশ্চিমা দৈহিক সৌন্দর্য প্রভাবিত করতে পারেনি মেধা-বুদ্ধি-বিচক্ষণতাকে। সভ্য দুনিয়ার মানুষ দৈহিক সৌন্দর্যকে অবশ্যই নান্দনিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে। দৈহিক সৌন্দর্যের একটি শক্তি আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সক্রেটিস নিজেই বলেছেন, 'Beauty is the bait which with delight allures man to enlarge his kind.'সৌন্দর্য একটি নান্দনিক ধারণা। এটি মানুষের কোনো বিশেষ গুণাগুণ হতে পারে না। কিন্তু সৌন্দর্যের সংজ্ঞা কী? ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, যে দেশে মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগে সে দেশে সৌন্দর্যের ধারণা মেদবহুল শরীর। আমরা কোন্ ঘাটতির কারণে শুধু গাত্রবর্ণের প্রতি দুর্বলতা পোষণ করছি? শুধুই চামড়ার বিভিন্ন কালার কী সৌন্দর্যের নির্ধারক হতে পারে? আমরা, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমাজে দৈহিক সৌন্দর্যের যে ধারণা পোষণ করি তা শুধু অপরিণতই নয়, রীতিমতো অসুস্থ, অমানবিক ও দুঃখজনক। এ অসুস্থ ধারণা মানুষের সাধারণ জীবনকে ব্যাহত করে আসছে। শহর-গ্রাম সর্বত্র একজন শ্যামবর্ণের বা অপেক্ষাকৃত ডার্ক মানুষকে সমার্থক শব্দ দিয়ে বলা হয় 'গায়ের রং ময়লা'। কারো গায়ের রং সাদা হলে তাকে বলা হয় পরিষ্কার! বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষের গায়ের রং সম্পর্কিত এ ধারণা ঔপনিবেশিক মানসিকতাপ্রসূত। কেউ দেখতে সাদা হলে তাকে সমাজের প্রতিটি শ্রেণীতেই বলা হচ্ছে, দেখতে সাহেবের মতো। সাহেব মানে ইংরেজ। এখনো সাদা চামড়ার একজন যদি স্বভাবে চোরও হয় তিনি এখানে সাহেব! কিছুদিন আগে এক বাসায় বসে শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট খেলা দেখছিলাম। সেখানে দুই-তিনজন কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েও খেলা দেখছে এবং তাদের সবাই অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে রীতিমতো চেঁচামেচি করতে থাকল। জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে কেন? ওরা জবাবে বলল, শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়রা কেমন কালো! আর দেখেন তো, অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়রা কী সুন্দর! বেচারা কিশোর-কিশোরীরা জানে না অস্ট্রেলিয়ায় অনেক এলাকা আছে যেখানে এশিয়ানদের কাছে বাসা ভাড়া দেওয়া অলিখিতভাবে নিষেধ। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের রয়েছে ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন, লঙ্কানরা আমাদের সমগোত্রীয় মনে করে। এ দৃষ্টিভঙ্গির সৌন্দর্যের কোনো মূল্য নেই? শুধুই সাদা চামড়া?আমরা বাংলাদেশের সৌন্দর্যের ধারণার কী প্রভাব দেখতে পাচ্ছি? ডজনখানেক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চলছে। অসংখ্য মেয়ে সংবাদপাঠক ও উপস্থাপক রয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিতেও কোনো মেয়ে সংবাদপাঠক কালো নেই, অথবা তাদের কালো গায়ের রং প্রদর্শনের সুযোগ নেই। যদি কারো গায়ের রং অপেক্ষাকৃত ডার্ক হয়ে থাকে তাহলেও তাকে স্নো-পাউডার-লিপস্টিক দিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন সাহেবের সন্তান! কাকে আমরা দোষ দেব? কোনো বেসরকারি চ্যানেলে যদি দেশি গায়ের রঙের দুই-চারটি মেয়ে দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয় তাহলে দর্শক কমে যাওয়ার জোর সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ বিশাল এ জনপদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই ক্ষত রয়ে গেছে। বাংলাদেশে শুধু গায়ের রং বাংলাদেশি হওয়ায় অসংখ্য মেয়ের চাকরি না হওয়ার নজির আছে। মেধা বা বিচক্ষণতাকে কোনো বিবেচনায় আনা হয় না। অসংখ্য মেয়ে প্রতিভাবিকাশের সুযোগ পায় না শুধু গায়ের রং এদেশীয় হওয়ায়। এর চেয়ে অন্যায়, অমানবিক সামাজিক ধারণা আর কী হতে পারে? জীবনযাপন থেকে শুরু করে সভ্য দুনিয়ার এত কিছু আমরা নকল করছি, কিন্তু এই পরিণত বোধটুকু নকল করতে পারছি না। সভ্য দুনিয়া যেখানে গুণের প্রয়োজন সেখানে গুণকেই প্রাধান্য দেয়। সেখানে রূপের কোনো ঠাঁই নেই। আবার যেখানে, রূপের প্রয়োজন, সেখানে রূপকে। এটাই বিজ্ঞানসম্মত হিসাব। অথচ আমরা গুণের কাজটিও রূপ দিয়ে চালাতে চেষ্টা করছি, যে-রূপ আবার ভুল ধারণাপ্রসূত। বাংলাদেশ থেকেই দেখা যায় বিবিসি, সিএনএনের মতো বিশ্বজয়ী প্রচারমাধ্যমগুলো। অসংখ্য নিউজ প্রেজেন্টার, করেসপনডেন্ট, রিপোর্টার রয়েছেন, যাঁদের গায়ের রং শুধু কালো নয়, মুখের গঠনও সুশ্রী নয়। অথচ তাঁরা তাঁদের গুন দিয়ে, স্মার্টনেস দিয়ে প্রতিষ্ঠান এবং দর্শকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। এ সুযোগ বাংলাদেশের একটি সাধারণ চেহারার মেয়ের নেই কেন? শুধু কি তাই, অসম্ভব গুণবতী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নাক-চোখের অধিকারী মেয়ের একটি সাদামাটা বর জোগাড় করতে মা-বাবার কী কষ্ট হয় তা আমরা অনেকেই দেখেছি। আবার একটি হাবাগোবা সাদা চামড়ার মেয়েকে ঘরে নেওয়ার জন্য সরকারি কর্মকর্তা এবং জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি যুদ্ধ শুরু করছেন। মানুষের এ চোখের ওপর কি ভরসা রাখা যায়?আরো আছে। একজন খর্বকায় মানুষ দেখলে বাংলাদেশে ভদ্রসমাজও তাকে হাসিঠাট্টার খোরাক মনে করে। একজন খোঁড়া মানুষকে এমনকি প্রচারমাধ্যমেও হাসির উপাদান হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু একজন বামনকে দেখলে ইউরোপের আবালবৃদ্ধ কারো মাথায় আসে না যে তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করার কিছু আছে। একজন খোঁড়া মানুষের ব্যাপারে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার আছে বলে তারা ভাবতেও পারে না। এ পার্থক্যের কারণ, ইউরোপ-আমেরিকার সমাজ সৌন্দর্যকে হৃদয় দিয়ে দেখে, আমরা দেখি খোলা চোখ দিয়ে।জাতি হিসেবে আমাদের মানসিকতায় অনেক বৈপরীত্য আছে, যা ভয়াবহ। একদিকে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক মানসিকতাকে চরম ঘৃণা করি, অন্যদিকে ব্রিটিশের চামড়াটির প্রতি ভক্তির কোনো শেষ নেই! যেমন কোনো স্তরে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কাজের প্রশংসা করে পার পাওয়া যায় না, অথচ বাংলাদেশের শতভাগ (যদি কদাচিৎ ব্যতিক্রম থাকে তা ধর্তব্যের নয়) মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে একটু ঠাঁই চায়। শুধু তাই নয়, একজন আমেরিকা প্রবাসীও বাংলাদেশে সর্বস্তরে আলাদা কদর পেয়ে থাকেন। আমাদের এ বৈপরীত্য, এ অসংলগ্ন ধারণার প্রতিকার কোন্ ওষুধে সারবে? এটি সরকারের কাছে দাবি করার বিষয় নয়, কয়েকটি এনজিও ব্যানারে স্লোগান লিখেও এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। দেশের সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রে মুখ্য চরিত্রের মুখশ্রী অন্য সবার চেয়ে অনেক সুন্দর হওয়া অপরিহার্য। সংস্কৃতিও যদি এমন স্থূলতায় আটকে থাকে তাহলে সমাধান কী?সমাজবিজ্ঞানীদের বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখার দরকার আছে। তবে একটি দেশের শিক্ষার মানের সঙ্গে নন্দনতত্ত্বের একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। আমরা স্কুল-কলেজে পড়েছি, এখন আমাদের সন্তানরা পড়ছে। শিক্ষার যে পাঠ্যক্রম দেখে আসছি তা সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্রের মতোই মোনোটোনাস, খর্বকায়। এর একটি ধাক্কা দেওয়া পরিবর্তন কম প্রয়োজনীয় নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানে বলেছেন, তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। রবীন্দ্রনাথের এই চোখ ব্যাপক অর্থে। এই চোখের সৌন্দর্যের দেখা পেতে হবে।===========================স্বাস্থ্য আলোচনা- 'প্রসূতিসেবায় পিছিয়ে দেশ' by শেখ সাবিহা আলম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বন্দিত কান্না, নিন্দিত হরতাল আর রাজকীয় অশ্রুপাতের গল্প' by ফারুক ওয়াসিফ  খবর- উত্তর কোরিয়ার নতুন পরমাণু প্ল্যান্ট দেখে 'তাজ্জব' মার্কিন বিজ্ঞানীরা  গল্পসল্প- 'মুজিব একবার আসিয়া সোনার বাংলা যাওরে দেখিয়ারে' by মোস্তফা হোসেইন  আন্তর্জাতিক- 'ওবামা কি ক্লিনটনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবেন?' by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী  কৃষি আলোচনা- 'পোষের শেষ মাঘের বারো' by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস  মণিপুরি মহা রাসলীলা উৎসবের ইতিকথা by মুজিবুর রহমান  প্রকৃতি- সমুদ্রে উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রবাল মড়ক  মণিপুরি রাসমেলা উৎসব by আকমল হোসেন নিপু  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'মডার্ন হাম্মুরাবি এবং কাঠের ঘোড়া' by আলমগীর সাত্তার  আলোচনা- 'কারাগার থেকে সংশোধনাগার প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ' by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু  শিল্প-অর্থনীতি 'ক্ষুদ্রঋণের বিড়ম্বনা' by আহমদ রফিক  আন্তর্জাতিক- 'চীন ও দুর্লভ ধাতু নিয়ে উদ্বেগ' by পিটার কাস্টার্স  আলোচনা- 'সুশাসন-সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো' by এ এম এম শওকত আলী  খবর ও ফিচার- 'মুক্তি পেল নীলকণ্ঠ পাখি' by শরীফ খান  প্রকৃতি- 'বাংলাদেশে জীবিকা হারানো মানুষের ‘অগত্যা বাস্তুচ্যুতি’  আলোচনা- 'প্রসঙ্গ : দুর্নীতি উৎপাটন' by মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম  ইতিহাস- পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পরিচিতি    কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মহসীন হাবিব

এই গল্পালোচনা'টি পড়া হয়েছে...

free counters

No comments

Powered by Blogger.