গল্প- 'দ্বিতীয় জীবন' by ইরাজ আহমেদ

দুপুরবেলা তিন তলা বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে যেতো। কাজের লোকেরা নিচের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। দোতলায় দুজন বাসিন্দা প্রতিদিনের মতো ঘুমের কাছে সমর্পিত। আর আমি তখন গাছপালায় ঘেরা বিশাল বাড়িতে একমাত্র জীবন্ত প্রাণী। ফাঁকা বাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে নিজেকে মাঝে মাঝে একটা কাচের বোতলে আটকে পড়া মাছির মতো মনে হতো। এখানে ওখানে উড়ে বেড়াচ্ছি, কোথাও ঝিম মেরে বসে থাকছি কিন্তু বের হওয়ার কোন পথ নেই। আমার কখনোই বইপত্র পড়ার অভ্যাস ছিলোনা। কোন কাজও করার ছিলো না। ফলে সেইসব নির্জন দুপুরে তিনতলায় নিজের ঘরের জানালার পাশে বসে বাইরে আকাশ অথবা গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকাটা ছিলো আমার একমাত্র কাজ। তখনই আমি বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম। এ বাড়িতে আসার প্রথম বছরে ভাবনাটা চেতনার স্রোতের ভেতরে পাল তুলে দেয়নি। তখন অনেক কাজ ছিলো আমার। অধিকাংশ দিন বিকেল বা সন্ধ্যায় কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকতো। সকালবেলা ব্যস্ত থাকতাম ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার কাজ তদারকি নিয়ে। ভেবেছিলাম দাঁতে দাঁত কামড়ে সবকিছু ভুলে থাকবো। কিন্তু তা আর হলো কই? এখন ভাবি, কী রকম বোকা ছিলাম আমি। আমার নিজেরই এখন সেই সরল মনটার জন্য খুব মায়া হয়।
এখন আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে দুপুর বা বিকেলের আকাশ দেখার কোন প্রশ্নই নেই। অনেকগুলো লম্বা-লম্বা বাড়ির মাঝখানে এই বামন একতলা বাড়িটার আকাশের কাছে মুখ দেখানোর কোন সুযোগ নেই। তবে যেদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি সেদিন আকাশ দেখি। রিকশায় বসে চলন্ত আকাশ। আগের দিনের কথা মনে পড়ে যায়। সেই তিনতলা বাড়িটার কথা, মানুষগুলোর কথা, একজন লোকের কথা। কোথায় যেন একবার পড়েছিলাম মানুষের মনের গতি ঘাসের চেয়েও দ্রুত সঞ্চরণশীল। আসলে কথাটা একশ ভাগ ঠিক। মন যে কোথায় কখন থাকে, কোথা থেকে কোথায় যে ভেসে চলে যায় তার হিসাব মানুষের কাছে নেই। মানুষ ইচ্ছা করলেই মনকে থামাতে পারে না। সে গড়াতেই থাকে। বিয়ের এক বছর পরেই আমার মন তারেকের কথায় ভেসে গিয়েছিলো।

আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ করেই। তখনও আমার প্রেমে-ট্রেমে পড়া হয়ে ওঠেনি। কলেজে পড়া সাধারণ একটা মেয়ে ছিলাম। বাড়িতে সারাদিন লাফ ঝাঁপ, কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে সিনেমায় যাওয়া, পিকনিক এসব নিয়েই আমার দিন কাটতো। এক বিয়ে বাড়িতে ছেলে পক্ষ আমাকে দেখে বাবার সঙ্গে কথা বলে সবকিছু ঠিক করে ফেললো। তারপর সানাই বাজলো, বাজি পুড়লো, গেট সাজলো, আলো জ্বললো। আর আমি যেন রাজকন্যা সেজে সাতদিন সাতরাত জাহাজে করে সমুদ্রে ভেসে আরেক রাজ্যে গিয়ে উঠলাম। সেই বিশাল রাজ্যের মালিক ছিলো প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ ফরিদ রেজা আর তার মা জাহান বেগম। ফরিদ রেজা আবার রাজমাতার সাংঘাতিক অনুগত ছিলো। আসলে সেই বিশাল রাজ্যের আসল মালিক ছিলো জাহান বেগম, মানে আমার শাশুড়ী। রেজার এসব ব্যাপারগুলো দেখে প্রথম প্রথম আমি বিস্মিত হতাম। রেজা যখন দিনের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে বসে ঢক ঢক করে এক গ্লাস দুধ খেতো তখন দেখে আমার হাসি পেতো। আমাদের পরিবার আবার রেজাদের মতো ইন্টেলেকচুয়াল ছিলো না। বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন। মা কলেজে পড়াতেন। নিয়ম কানুন আমাদের ভাইবোনদের ঘিরে থাকতো সর্বক্ষণ। কিন্তু সেখানে রেজার মতো এ বয়সে মায়ের পাশে বসে দুধ খাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। রেজার বাবা ছিলেন ডাকসাইটে বিচারপতি। ভদ্রলোক আমাদের বিয়ের দুবছর আগে মারা যান। অনেক সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন তিনি জাহান বেগমের নামে। রেজা লন্ডন থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট করে দেশে ফিরে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করতে একটা বিশাল এনজিও দিয়েছিলো। একটা বড় বিদেশী ব্যাংকের উপদেষ্টাও রেজা। সমাজের সুশীল অংশের গুরুত্বপূর্ণ পার্ট ছিলো লোকটা। কিন্তু বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বের হতে হতো মানুষটাকে। মায়ের নির্দেশে রাত এগারোটায় বিছানায় চলে যেতে হতো। ওদের বাড়িটাকে আমার সুকুমার রায়ের ছড়ার ধমক দিয়ে ঠাসা একটা বাড়ির মতো মনে হতো। প্রথম দিকে আমি রেজাকে এসব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছি। ও দেখতাম ভয় পেতো কথা বলতে। বলতো, এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার দরকার কী? কোন সমস্যা তো হচ্ছে না। এগুলো আমাদের বাড়ির অনেক কালের নিয়ম। বাবার আমল থেকে শুরু হয়েছে। মা চায় না নিয়মগুলো ভেঙে যাক।

এখানে বলে রাখি, আমার নাম প্রীতি। আমি ছিলাম বাবার একমাত্র মেয়ে। আমার আরও দুই ভাই আছে। বিয়ের পর রাতের বেলা বাধ্যতামুলক লোডশেডিংয়ের মাঝে বসে অনেক কথা হতো আমার আর রেজার। টাকা আর খ্যাতি রোজগার ছাড়া সংসারে কোন ধরনের ভূমিকাহীন এই মানুষটার নরম একটা মন ছিলো। আমাকে পৃথিবীর নানা দেশের মজার মজার গল্প শোনাতো। মানুষের কথা বলতো। অল্প বয়সে অনেক দেশ দেখা হয়েছিলো তার। বলার ভঙ্গীটা এতো সুন্দর ছিলো যে আমার শুধু শুনতে ইচ্ছা করতো সে সব গল্প। সকালে রেজা কাজে চলে যাবার পর আমি সারাদিন অপেক্ষায় থাকতাম রাতের জন্য। ওই নিয়ন্ত্রিত অন্ধকারই ছিলো আমাদের দুজনের ক্ষণস্থায়ী যৌথ জীবনের একমাত্র আলোকিত সময়। তখন মনে হতো লোকটা নিয়ম ভাঙতে চায় কিন্তু সাহসের অভাবে পারে না। আমি অনেক সাহস যোগানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। পরে দেখলাম একেবারেই নির্বিষ। মানুষটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে ভয় আর নিয়ম। আমার খারাপ লাগার শুরুটা সেখান থেকেই। তবে রেজা মায়ের সম্পত্তির লোভের দাস ছিলো না, ছিলো অভ্যাসের দাস।

কথা বলতে বলতে বোধহয় মানুষের মন আর তারেকের প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এলাম? আসলে মানুষের এরকমই হয়। স্মৃতির ভূত মাথায় চেপে বসলে শুধু কথাই বলতে ইচ্ছা করে। একটা পুরনো বই পৃষ্ঠা উল্টে পেছনে, অনেক পেছনে নিয়ে যায় তাকে। আসলে পুরনো কথা না বলে দুম করে এসব প্রসঙ্গে আসাও যায় না। ঘটনাগুলো একে অপরের সঙ্গে খুব বেশি করে জড়িয়ে আছে। আমি এখন একটা ব্যাংকে ছোট চাকরি করি। অফিসের কাছেই এক বন্ধুর সঙ্গে একটা বাসা ভাড়া করে থাকি। বাবা-মায়ের সঙ্গে একটা ক্ষীণ যোগাযোগ আছে। এই বিষয়গুলো আগের ঘটনার ওপর নির্ভরশীল। ফরিদ রেজা আর জাহান বেগমের সংসারে না গেলে আমার জীবনে এই অংশটা তৈরিই হতো না। অনেকেরই মনে হতে পারে এরপর হয়তো আমি অবৈধ প্রণয়ের গৎবাঁধা গল্প শুরু করবো। এক রাজকন্যা সোনার তৈরি কোন কারাগারে বন্দি ছিলো। একদিন এক রাজপুত্র তার জীবনে এলো ঝড়ের মতো। সবকিছু তছনছ করে দিয়ে সে রাজকন্যাকে উদ্ধার করলো বন্দীদশা থেকে। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা সেরকম ছিলো না। তারেক নামের ছেলেটি আমাকে দ্বিতীয় আরেকটি জীবনের লোভ দেখিয়েছিলো। স্বামীর ব্যস্ত আর ভয়ে ভয়ে থাকা জীবন আর শাশুড়ীর কঠোর নিয়মকানুনের বাইরে সে জীবন উচ্ছ্বল, আনন্দময় আর উজ্জ্বল। আমি একসময় ভেবেছিলাম সে জীবনটা আমারও হতে পারে।

তারেক ছিলো অর্থনীতির ছাত্র। রেজার সঙ্গে এনজিওতে কাজ করতো। রেজার অনুপস্থিতিতে কাজকর্ম সামাল দেয়া আর বিভিন্ন দেশে ঘোরা ছিলো তারেকের কাজ। বাসায় ছেলেটাকে আমি কয়েকদিন দেখেছি একতলায় রেজার লাইব্রেরী ঘরে বসে কাজ করতে। অবশ্য ছেলেটার সঙ্গে আমার কথা হয় বাসার বাইরে। একটা দোকানে। একদিন দুপুরবেলা হাতিরপুলে বাজার করছি, হঠাৎ তারেকের সঙ্গে দেখা। বাজারে দোকান থেকে দোকানে ঘুরে ঘুরে অনেক কথা বললো ছেলেটা আমার সঙ্গে। ওকে এর আগে বাসায় দেখে মনে হয়নি এত কথা বলতে পারে। আমার অবশ্য তারেকের সঙ্গে কথা বলতে খারাপ লাগছিলো না। বেশ মজা করে কথা বলে। আসার সময় তারেককে রেজার অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে ফিরলাম। বিকেল-সন্ধ্যা তারেক আমার সঙ্গে থাকলো। আসলে তারেক না, থাকলো ওর মজার কথাগুলো। মনে হচ্ছিলো, অনেকদিন পর আমি হাসলাম। সাধারণ মানুষের মতো কথা বললাম। এরপর বাসায় এলে তারেক আমার সঙ্গে কাজের ফাঁক ফোকড় গলে কথা বলতো। কথা বলার জন্য তারেকের উৎসাহটা শুধু টের পেতাম কিন্তু অন্যকিছু বুঝিনি। আসলে এখন টের পাই আমি মুক্তি চেয়েছিলাম। মনের অবচেতনে আকাক্সক্ষা তৈরি হওয়াতেই ফাঁক গলে হাওয়ার মতো তারেক এসে ঢুকেছিলো। একদিন দুপুরবেলা বাসায় ফোন করলো তারেক। লাইব্রেরী রুমে ফোনটা বাজছিলো। আমি সামনের উঠানে পায়চারি করছিলাম। এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে, রিসিভার তুলতেই তারেক প্রশ্ন করেছিলো, কী, বন্যায় আটকে পড়া পিঁপড়ার মতো ঘরের ভেতরে পায়চারি করছেন তো? আজকের বিকেলটা খুব সুন্দর হবে। বেরিয়ে পড়ুন। ভালো লাগবে আপনার। তারেকের এসব কথা আপনাদের জন্য আহামরি কিছু নয় হয়তো। এরকম কথা গল্পে আর বাস্তবে আপনাদের অনেকেই অনেকবার শুনেছেন। কিন্তু আমার জন্য এরকম কথা নতুন। এরপর তারেক অনেক কথা বলেছিলো। কিন্তু আমার ভেতরে বার বার গুনগুন করছিলো ওর প্রথম বাক্যটা। এরকম ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য কখনো কোনকালে কেউ বলেনি। আমার বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিলো। চৈত্র মাসে ঝড়ের বাতাসে পাতা যেভাবে ঘর ছাড়ে তেমনি ভাবে।

তারেকের সঙ্গে এরপর আমার অনেক কথা হয়েছে টেলিফোনে। কিন্তু সেই বৃষ্টির বিকেলের কথা আমি কখনো ভুলবো না। আমি যখন বাসা থেকে বের হই তখন আকাশে মেঘের ছিটে ফোঁটাও ছিলো না। জাহান বেগম যাবেন তার এক বোনের বাসায়। আমাকে যেতে হবে দোকানে কয়েকটা জিনিশ কিনতে। সে সময়টাতে জাহান বেগম আমার সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। ছেলেমেয়ে না হওয়ায় আমার ওপর তার বিরক্তি ক্রমেই বাড়ছিলো। আমি কখনো মুখ খুলে তাকে বলতে পারিনি যে সমস্যাটা ছিলো তার ছেলের। বিয়ের পর থেকেই দেখেছি আমাদের যৌথ জীবনে শরীরের বিষয়টা রেজার কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করতো না। দু একবারের পর প্রক্রিয়াটি তাকে তেমনভাবে আর আলোড়িত করতো না। রাতে স্ত্রীর শরীরের রহস্য অনুসন্ধানের চাইতে বইয়ের মধ্যে বেশি গোসল করতে চাইতো রেজা। ফলে আমাদের মিলনের কোন ফলাফল ছিলো না। জাহান বেগম বিষয়টাকে আমার ব্যার্থতা বলে ধরে নিয়েছিলেন।

সেদিনও গাড়িতে বসে আমার সঙ্গে তিনি তেমন কথা বললেন না। তাকে মালিবাগে একটা বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে কিছুদূর এগুতেই সূর্যের আলোকে ঘিরে ধরলো কালচে বর্ণের মেঘ। গাড়ির কাচ তোলার আগেই ধুলোমাখা বাতাস ঝাঁপ দিলো ভেতরে। আমি যখন দোকানের সামনে পৌঁছলাম তখনও বাতাসের একতরফা দাপট চারপাশে। বৃষ্টি শুরু হয়নি। গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে শপিং সেন্টারের ভেতরে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেলো তারেকের সঙ্গে। দেখা হওয়ার পর আমি কী করেছিলাম, কী কথা হয়েছিলো আমাদের মধ্যে এখন আর মনে নেই। কিন্তু সেদিন তারেকের সঙ্গে গোটা শহরের মতো আমিও বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম মনে আছে। খামোখাই ঘটেছিলো ঘটনাটা। ড্রাইভারের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা শপিং সেন্টার ছেড়ে বের হয়ে পড়েছিলাম রাস্তায়। কিন্তু আমার মনে আছে সেদিন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আমার শরীরে যেন গান হয়ে বেজেছিলো। মেঘ গম্ভীর স্বরে ডাকতে ডাকতে আমার ভেতরে ছেলেবেলা হয়ে ঢুকে পড়েছিলো। শেষ চৈত্রে ভেজা মাটির গন্ধ আমার ভেতরে ওলটপালট করে দিয়েছিলো। সেদিনই বৃষ্টি শেষে একটা দোকানে বসে কফি খেতে খেতে তারেক দ্বিতীয় জীবনের কথা বলেছিলো। তারেকের কথা শুনতে শুনতে আমার যেন নেশা ধরে গিয়েছিলো। আমি ভাবতে শুরু করে দিয়েছিলাম ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে কোন দ্বীপের কথা, নারকেল গাছের সারির কথা, বালির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার কথা, আশ্চর্য নীল আকাশের কথা। সেখানে মানুষের আরেকটা জীবন আছে। সংসারের প্রতিদিনের মালিন্য থেকে মুক্তি আছে। সেখানে ভয়ার্ত রেজা নেই, জাহান বেগম নেই, নেই একটা তিনতলা বাড়ি, নেই কোন স্বজন। তারেক সেই দোকানের ভিড়ের মধ্যে বসে আমার হাত ধরেছিলো। আমি চমকে উঠিনি, অন্য পুরুষের স্পর্শ আমার পিপাসায় রুক্ষ হয়ে যাওয়া শরীরে আলাদা করে কোন বৃষ্টি নামায়নি। আমি খুব শান্তভাবে ভেজা কাপড়ে গাড়িতে উঠে আবার বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম।

দ্বিতীয় জীবনের স্বপ্ন আমাকে এরপর অনেকদিন ভাবিয়েছে। সেদিন এক বিকেলে বৃষ্টি আর ঝড়ের ধাক্কায় সংসার থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম। যে সামান্য সুতার সংযোগ সেখানে আমার ছিলো তা যেন এক ঝটকায় ছিঁড়ে গিয়েছিলো। আমি একা একা বসে এসব কথাই ভাবতাম। মাঝে মাঝে রেজাও জানতে চাইতো কী হয়েছে আমার। জাহান বেগমকে কখনো বলতে শুনেছি বউয়ের নতুন ঢং হয়েছে। কারো সঙ্গে কথা বলে না। আমি এখন ভাবি সেই দ্বিতীয় জীবনের স্বপ্ন কি আসলেই আমাকে স্পর্শ করতে পেরেছিলো? সেটা সম্ভব হলে এখন আমি যেভাবে জীবন যাপন করছি তা সম্ভব হতো কি? তারেক আমাকে ঠিক কোথায় নিয়ে দাঁড় করাতে চেয়েছিলো তা এখনো আমার বোঝার বাইরের বিষয়। কারণ ও আমাকে একভাবে দেখতে চেয়েছিলো আর আমি জীবনকে অন্যভাবে। ফলে আমার আর রেজাদের বাড়িতেও থাকা সম্ভব হয়নি। কারণ আমার মনের বন্ধ দরজাটা সেদিন বিকেলে খুলে গিয়েছিলো। তারেকও ব্যাপারটা বোধহয় বুঝতে পারেনি। পারলে পরে ওরকম একটা ঘটনা সে ঘটাতো না।

এখানে বলে রাখা ভালো, এরপর আমার সঙ্গে তারেকের অনেক কথা হয়েছে। আমাকে ছেলেটা অনেক কিছু বোঝাতে চেয়েছে। সেগুলো শুধু আমি যা বুঝতে চেয়েছিলাম তা বাদে আরও অনেক কিছু। একসময় তারেকের কথায় আমি একটা সুটকেস হাতে নিয়ে সেই তিনতলা বাড়িটা ছেড়ে এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছেছিলাম। তারেক বলেছিলো আমাকে সে নিয়ে যাবে সেই এক দ্বীপে। বাংলাদেশ থেকে প্লেনে দুবাই। তারপর দূরে আরও দূরে। বোকার মতো কাজ, তবু করে ফেলেছিলাম। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে সেদিন বিমান বন্দরে তারেকই আর আসেনি। অথবা বলা যায় আসার সাহস তার হয়নি। আসলে সে যা চেয়েছিলো ঘটনাটা ঠিক সেভাবে ঘটেনি। বলা যায় ঘটনাটা আমি সেভাবে ঘটাতে পারিনি। ফলে সেই সুটকেস হাতে আমি হাঁটতে হাঁটতে এই গলির ভেতরে আকাশকে মুখ দেখাতে ব্যর্থ বাড়িটা পর্যন্ত এসে পৌঁছে গেছি। কে জানে, এটাই হয়তো আমার দ্বিতীয় জীবনের শুরু।
=======================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা   গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ   গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ...  গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর   গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা   গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী  সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প   গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক   গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম   গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান  গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ ইরাজ আহমেদ


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.