গল্প- ‘অপঘাতে মৃত্যু’ ও ‘সাদামাটা’ by লীসা গাজী

অপঘাতে মৃত্যু
‘অপঘাতে মৃত্যু’ কথাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সিঁথির। রিকশার হুড খোলা, গরম বাতাস চোখে মুখে লাগছে। উঠবার সময় কেন যে হুডটা টেনে দিতে বললো না! ধ্যাৎ এখন কামিজের নিচে ঘাম চিড়িবিড় করছে। রিকশা ট্রাফিক লাইটে এসে দাঁড়ালো, অবস্থা বেগতিক, রিকশায় রিকশায় ছয়লাপ যাকে বলে।  পাশের রিকশাটা এতো গায়ের উপর হুমড়ি খাওয়া যে মনে হচ্ছে ওরা কোনো বাড়ির উঠানে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। মানে পাশের রিকশার দু’জন যাত্রী আর সে নিজে। গল্প শুরু করে দিলে মন্দ হয় না। পাশেরজনটি তো আবার বেশ ঠারে ঠোরে তাকাচ্ছেন। কেন ভাই এইদিকে কেন, আপনার বান্ধবী তো খারাপ না দেখতে, কথাও নিশ্চয়ই বলতে পারেন, তাহলে আর এদিকে তাকানো কেন ভাই আমার।

‘এই যে রিকশাওয়ালা ভাই, হুডটা টেনে দেন তো।’

রিকশাওয়ালা কোমর থেকে আয়েশ করে গামছার গিঁঠ খুলে ঘাড় আর কপালের ঘাম মুছলো, থুক করে থুতু ফেললো রাস্তায়। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে, থুতুটা পড়লো নিজের পায়ের উপরেই–আর বিড়বিড় করে গালি দিলো। সিঁথির কেন যেন মনে হলো ওকেই গাল দিচ্ছে।

‘দেন না ভাই হুডটা তুলে।’

‘দিতাছি। একটু সবুর করন লাগে।’

হুডটা তো মাথার উপর উঠলো, কিন্তু এখন আবার বমি বমি লাগছে। জ্বর আসবো, আসি করছে গতকাল থেকে।

‘আসলে আয়, না আসলে বাড়িত যা।’

মনে মনে কথাটা বলে ফিক করে হেসে ফেললো সিঁথি। যাক লাল বাতি সবুজ হয়েছেন। রিকশা চলতে শুরু করেছে, এখন আবার চলতি হাওয়ায় ঠাণ্ডা লাগছে। কী বিপদ! ‘অপঘাতে মৃত্যু’ কথাটা আবার মাথার ভিতরে উঁকি দিচ্ছে। আসলে ব্যাপার কিছুই না। অতো আটঘাট বেঁধে চিন্তা করার মতোও না। আজ ক্লাসের ফাঁকে ভার্সিটির মাঠে বন্ধুরা সবাই মিলে যখন আড্ডা দিচ্ছিলো তখন বাউল লুকিং এক লোক এসে হাজির। হাফিজ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো, নাম বললো মিথুন। সে নাকি অচিরেই মহাজাতকের ভাত মারবে। বলা মাত্র আর যায় কোথায়, সিঁথিরা সবাই কই মাছের মতো খলবল করে উঠলো।
শেষমেশ তার ভাগ্যে কি না লেখা আছে অপঘাতে মৃত্যু। আচ্ছা অপঘাতে মৃত্যু মানে কি তাকে কেউ খুন করবে? না না, সে নিজেও তো আত্মহত্যা করতে পারে। অথবা এই রিকশাটা এখনই যদি উল্টে যায় আর সে যদি ছিটকে পড়ে আর একটা গাড়ি যদি তখন তাকে চিড়াচেপ্টা করে পালিয়ে যায়–তাকেও অপঘাতে মৃত্যু বলা যাবে। তাহলে তিনটা সম্ভাবনা–খুন, আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনায় মৃত্যু। এই সবগুলোকেই অপঘাতে মৃত্যু বলা যায়। সিঁথি এখন পারমুটেশন কম্বিনেশনে এগুবে কি না ভাবছে। মানে একে একে সম্ভাবনাগুলো বিবেচনা করে খারিজ করে দেয়া। কিন্তু রিকশাযাত্রী হিসেবে এতোটা সময় কি তার আছে?

‘এই যে রিকশাওয়ালাভাই গাড়ি ঘুরান। আবার ভার্সিটির সামনে যান, তারপর আবার এখানে আসেন। এইভাবে তিনবার, তারপরে যেখানে যেতে বলছি সেখানে যাবেন। বুঝছেন?’

সিঁথি নিশ্চিত আবারও রিকাশাওয়ালা তাকে গালি দিচ্ছে, যদিও মাথা নেড়ে বলেছে বুঝেছে।

‘চিন্তা কইরেন না, টাকা বেশি পাবেন।’

‘টেকা নিয়া এই বান্দা চিন্তা করে না।’

বললো বটে কিন্তু তাকে যথেষ্ট চিন্তিত দেখাচ্ছে। রিকশার প্যাডেল ঘুরাচ্ছে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। তারও মাথার ভিতরে কোনো বিষয় নিয়ে পারমুটেশন কম্বিনেশন চলছে বোধহয়।

আচ্ছা, যদি সে খুনই হয় তাহলে তাকে কে খুন করতে পারে?…

বহু চিন্তা করেও সিঁথির মাথায় কোনো নাম এলো না।

কিন্তু বীথির বর? সে কি সিঁথিকে খুন করবে? হাজার হোক সিঁথি তাকে নিজের দুটো জ্যান্ত চোখে কাজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে দেখেছে–আর এই কথাটা সে নিজের কাছেও দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেনি। কিন্তু সে কথা তো আর সেই গুণধর পুরুষটি জানেন না।

হুম…বীথির বরের যথেষ্ট কারণ আছে তাকে খুন করার। ইচ্ছা করলেই তো সে তাদের সুখের সংসারে (বালের সংসার) লাঙ্গল চষতে পারে।

আচ্ছা, ক্লাস নাইনের সেই দেওয়ানা প্রেমিক কি তাকে খুন করতে পারে। হাজার হোক কাঁপা কাঁপা গলায় তো একবার বলেছিলো, আমি ছাড়া তোমার ওই চোখে কেউ চাইতে পারবে না, ওই ঠোঁট কেউ ছুঁতে পারবে না…।
 
তোমার দিকে অন্য কেউ তাকালেও আমি তাকে ধ্বংস করে দিতে পারি। অবশ্য অন্য কারও তাকাবার দরকার হয়নি সিঁথি নিজেই অন্যের দিকে তাকিয়েছে। সুতরাং ধ্বংস হবার পথঘাট তো সে নিজেই তৈরি করেছে। এই ভাবতে ভাবতে সিঁথি দেখলো ওর রকশা আর্ট কলেজ পার হচ্ছে। আল্লায় জানে রিকশাওয়ালা কতোবার চক্কর দিয়েছে। হঠাৎই সিঁথি দেখতে পায় শাহবাগের ঠিক গোল চত্বরের সামনে দিয়ে মানুষে বোঝাই লোকাল ট্রেন তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছে। ‘আরে ভাই দাঁড়ান, দাঁড়ান, মারতে চান নাকি? ট্রেনটাকে যেতে দেন।’

‘কী কন?’

চোখের ধান্দা! এখানে ট্রেন আসবে কোত্থকে। কিন্তু সিঁথি যে স্পষ্ট দেখতে পেলো ট্রেনটাকে ছুটে যেতে। এই ট্রেনের নিচেই কি তার মৃত্যু লেখা ছিলো। ধ্যাৎ, এই ট্রেন তো আর সত্যি না, জ্বরের ঘোরে দেখা।

‘আফা, জুত কইরা বসেন, পড়লে তো ছাতু হয়া যাবেন।’

‘আপনেরে থামতে বলছে কে? চালান! আর গালি দিবেন না।’

‘ইয়া আল্লাহ, এইডা আফনে কী কন, গালি দিমু কেন?’

সিঁথি তার ভাবনায় ফিরলো। একটু হাঁসফাঁস লাগছে। জ্বরের কারণে না কি খুনীর লিস্টি ক্রমশই বাড়ছে সেই কারণে কে বলতে পারে।

ইস্ আর একটু হলেই ট্রেনের নিচে পড়ে ইহকাল সাঙ্গ হতো।

তাহলে সে খুনই হচ্ছে। সিঁথি নিজের জন্য দুঃখিত বোধ করে। আচ্ছা, খুনীর লিস্টি থেকে অনেক ছোট বেলার নিমাইয়ের মাকে সে বাদ দিলো কী মনে করে? ঈদের আগের দিনের কথা, বয়স খুব বেশি হলে সিঁথির তখন দশ কি এগারো। নানুর ব্যাগ খুলে দশ টাকা সে বেমালুম হাপিশ করে দিয়েছিলো। যখন খোঁজ পড়লো তখন শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড। একটা দশ টাকার জন্য বাড়িঘর মাথায় উঠলো। সিঁথি ভয়ে চোখ বন্ধ করে বলে দিলো, সে নিমাইয়ের মাকে টাকাটা নিতে দেখেছে। নিমাইয়ের মা পত্রপাঠ বিদায় হলো আর তার বেতন থেকে দশ টাকা কেটে রাখা হলো। শুধু ঈদের দাক্ষিণ্য হিসেবে মার খাওয়া থেকে সেই যাত্রা বেঁচে গেলো সে। এখনও সিঁথি নিমাইয়ের মা’র চোখ দুটো ভুলতে পারে না। চোখ দিয়ে যদি শেষ করা যেতো তাহলে সেদিনই সে খুন হতো। অপঘাতে মৃত্যু!  আত্মহত্যার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা দরকার, সিঁথি মনে মনে ভাবলো। কিন্তু সিঁথি ভেবে পেলো না কোন দুঃখে সে আত্মহত্যা করতে যাবে। যদিও নিজের ভোট নিজে দিবো, যাকে খুশি তাকে দিবো টাইপ একটা ব্যাপার আছে। মানে, নিজের জীবন নিজেই নিবো যখন খুশি তখন নিবো, এই আর কি! আত্মহত্যা করার মতো দুঃখ তার একেবারেই যে নেই তাও তো না। প্রেমে কঠিন ছ্যাক খাওয়ার জন্য সে আত্মহত্যা করতে পারে। অবশ্য ছ্যাক খেয়েছিলো দুই বছর আগে, সেই দুঃখে এখন আত্মহত্যা করাটা ঠিক হবে কি না সিঁথি বুঝতে পারছে না।
বড় হয়েছে মামার বাড়িতে, মামির পাখার বাড়ি খেয়ে খেয়ে। সেই দুঃখটাও তো কম না। মুশকিল হচ্ছে সেইজন্য মামির উপর সিঁথির কোনো রাগ বা আক্রোশ নেই। মামি বেচারাই বা কী করবে, মনের ঝাল কারও উপর তো ঝাড়তে হবে। কিংবা যেদিন বাবা মারা গেলেন। খুব ছোট হলেও তার স্পষ্ট মনে পড়ে বুকের কোথাও কী একটা বন্ধ হয়ে গেলো। সেটা কি শ্বাস না স্পন্দন এতোদিন পরে আর তা মনে পড়ছে না। সেই বেদনায় কি সে আত্মহত্যা করতে পারে না? অবশ্য কেন আত্মহত্যা করবে এই নিয়ে এতো মাথা ঘামাতে রাজি না সিঁথি। সেই গল্পের মতো–ওই যে, বাঘে ঘাস খায় না, কিন্তু যদি খায় তাহলে ঠেকায় কে।

অথবা ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতায় উজ্জীবিত হয়ে সে এমনি এমনিও আত্মহত্যা করতে পারে, কারণের ধার কে ধারে?

আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে ক্লান্ত–ক্লান্ত করে; লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই…।  কারণটা যে খুব বেশি জরুরি এখন আর তা মনে হচ্ছে না সিঁথির। আজকে রাতেও করা যায়। সিঁথি হালকা বোধ করে।

শালা, অন্তত মৃত্যুটা তো আমার হাতে!

ভিতরে একটা জোর পায় সিঁথি।

অবশ্য একটুক্ষণ আগে ট্রেনের নিচে কাটা পড়লেও ল্যাঠা চুকে যেতো।

পত্রিকার প্রথম পাতার কোণার দিকে একটা ছোট্ট নিউজ ‘ট্রেনের নীচে কাটা পড়া যুবতীর লাশ উদ্ধার’ বিস্তারিত খবরের জন্য আটের পাতার ২ নম্বর কলাম দ্রষ্টব্য।

লন্ডন, সেপ্টেম্বর ২০০৭
--------------------------------
সাদামাটা

সোহানার জীবনে একটা রহস্য আছে। এই নিয়ে আমরা কখনও কোনো কথা বলি না।   দু’দিন পর সোহানার বিয়ে। আজ ওর গায়ে হলুদ ছিলো। বরপক্ষ বিদায় হয়েছে। উফ্ বাঁচা গেছে। বত্রিশ পাটির দাঁত দেখিয়ে কথা বলতে বলতে আমাদের গাল ব্যথা হয়ে যাচ্ছিলো। অবশ্য সারাক্ষণই যে হাসাহাসি চলছিলো তা না, হাতাহাতিও প্রায় হবার যো হয়েছিলো। কিছুই না, বরপক্ষের মান্যগণ্য জঘন্য কোন খালাকে নাকি আমরা অপমান করেছি। হ্যাঁ, আমাদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই। আরে বাবা, হলুদ দিতে আসছো সুন্দর মতো দিয়ে উঠে পড়। তা না উনি যেন ঘর লেপতে বসলেন। কপালে, দুই গালে তো দিলেনই–পারলে মিষ্টির বদলে মুখের ভিতরেও হলুদ ঠুসে দেন। এই যখন চলছিলো তখন আমরা বন্ধুরা শুধু চাওয়াচাওয়ি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু সেই বিশালদেহী মহিলা যখন একটা পুরো চমচম সোহানার গালের ভিতর ঢোকাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তখন আর নাজনিন চুপ করে থাকতে পারলো না। ওর স্বভাবের বাইরে গিয়ে নরম করে বললো, ‘আন্টি এতো বড়টা ও খেতে পারবে না।’
তো সেই কথায় আমাদের আন্টি ভ্রুক্ষেপও করলেন না। তিনি যথারীতি তার কসরত চালিয়ে যেতে লাগলেন। তখনই শুধু নাজনিন ওর স্বভাব মতো বললো, ‘আন্টি ওর মুখের সাইজ দেখেন আর চমচমটার সাইজ দেখেন, এই চমচম কি ওর মুখের ভিতর ঢোকানো ঠিক হবে?’

আর এতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। আমরা তার আঙুলের সমান হয়ে এতো বড় অপমান করলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষমেশ সোহানার মামার মধ্যস্থতায় ব্যাপারটার মীমাংসা হলো এবং আমাদের মাথা নত করে আন্টিমণির কাছে সরি বলতে হলো। এইসব নাটকের পর যখন এরা উঠলো–আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

আর এখন আমরা বন্ধুরা ওকে ঘিরে জমিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রথম দলছুট হবে একজন। কিন্তু তাতে কারও কোনো দুঃখ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

এমনকি সোহানাকেও দেখে মনে হচ্ছে না ওর কোনো দুঃখ হচ্ছে। দিব্যি সব বন্ধুদের সাথে সেও ক্যালাচ্ছে। তাই দেখে পিয়া ফোঁড়ন কাটলো, ‘এতো হাসিস না দাঁত পইড়া পা কাটবে।’

আমরা হাসতে হাসতে আরও পা কাটার ব্যবস্থা করলাম। আমাদের সাজের বহরও দেখার মতো হয়েছে। এর মধ্যে নীলারই একটু উসখুস আর মন খারাপ অবস্থা। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে বহু খুঁজে-পেতে যাও বা একটা আংটি যোগাড় করেছিলো তাও ঠিক বের হবার মুহূর্তে পরে আসতে ভুলে গেছে। সেই খেদ ওর এখনো যায়নি। হলুদের অনুষ্ঠান প্রায় শেষ–তবুও না। একই প্যাঁচাল তখন থেকে পাড়ছে। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে নাজনিন বলেই ফেললো, ‘এই একটা আংটির জন্য মরাকান্না কাঁদিস না তো। আংটিটা পরলেও তোকে এখন যা লাগছে তাই লাগতো–শাকচুন্নি।’

এই কথায় কই আমরা একটু প্রতিবাদ করবো তা না সবাই নাজনিনের কথায় সায় দিয়ে উঠলাম। বেচারা নীলাটা এখন মুখ ভার করে আছে। অবশ্য বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না। একটু পরেই আবার মরাকান্না জুড়বে। সব সময়ই কিছু না কিছু নিয়ে তার কমপ্লেন করতেই হবে। অসহ্য।

আরে, সোহানাকে তো আজ শাড়িটায় খুব মিষ্টি লাগছে। যদিও আমরা ছেলের বাড়ির সব জিনিসের মধ্যেই খুঁত ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিছুই আমাদের পছন্দ হয়নি। বিশেষ করে শাড়িটা। হলুদের শাড়ি হলুদ তো হবেই তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নাই, কিন্তু এমন বাজে হলুদ এর আগে আমরা আর কখনও দেখি নাই। তানিয়া বললো, ‘নেহায়েত আমরা সুন্দরী নইলে এই শাড়িতে আজকে খবর ছিলো।’
 
এদিকে সোহানার এক কাজিন এসেছে বিদেশ থেকে। বেচারা এতোগুলো মেয়ে দেখে আর অন্য কোথাও যেতে পারছে না। এদিকেই কেমন আঠার মতো লেপ্টে আছে। তাকে নিয়ে আমরা বেশ মজা করছি। বেচারা আমাদের মাঝখানে পড়ে ভোদাই বনে গেছে।

তানিয়ার মতে, চোখ ট্যারা হয়ে গেছে। তাই শুনে নাজনিন বললো, ‘চোখ ট্যারা হবে না–একই সঙ্গে বাপধন এতোগুলা সুন্দরী এবং মুসলমান মেয়ে কই পাবে।’

আমরা সবাই আবার একচোট হাসলাম। সবচেয়ে জোরে হাসলো সোহানা নিজেই।

আমাদের মধ্যে নাজনিনের একটু মুরুব্বি মুরুব্বি ভাব। খুব বিরক্ত হলো সে।

‘তুই এতো খ্যাক খ্যাক করে হাসছিস কী মনে করে? তোর না আজকে বিয়ে। আজকে অন্তত একটু লজ্জা শরম রাখ।’

‘হ্যাঁ, দয়া করে দাঁতগুলা মুখের ভিতরেই রাখেন ম্যাডাম।’ আমি বললাম।

‘একি তোদের সামনেও হাসতে পারবো না? তোরা তো আমার বন্ধু।’

‘বন্ধু বলে কি আমরা মানুষ না।’

নীলা মন খারাপ ভাবটা আর বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, ‘দ্যাখ দ্যাখ, আমাদের বিদেশী ভাইয়া নাজনিনের দিকে কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। চোখ দু’টা তো কোটর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।’

‘একটা বাটি হাতে দিয়ে আয়। পড়লেই যেন টুপ করে ধরতে পারে। এই বাজারে চোখ হারালে চোখ কই পাবে।’ খুব গম্ভীর হয়ে পিয়া বললো। আর নীলা বেশ সহজ ভাবে উঠে গেলো।   ‘এই, ও কি সত্যি সত্যি বাটি আনতে গেলো নাকি?’ আমি জিগ্যেস করেই বুঝলাম এই প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না। অবশ্যই বাটি আনতে গেছে। খালা মানে সোহানার মা এসে আমাদের সবার সামনে বিশাল তেহেরির ডিশ ধরিয়ে দিয়ে গেলো; আমরা নাকি ঠিক মতো কেউ খাইনি আগে। সোহানা বললো, ‘এই আমাকে তোরা কেউ একটু খাইয়ে দে না। খুব খিদা লেগেছে।’ ‘এখন তো ছেলের পক্ষের কেউ নাই, এখন নিজে খা।’ নাজনিন বললো।
‘এখন নিজে খা মানে, ও তো সারাক্ষণ খাচ্ছিলোই।’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ, খাচ্ছিলাম, কিন্তু যা খেতে চাচ্ছিলাম সেটা কেউ দিচ্ছিলো না। আর তোরা এতো মিন কেন? আমার মনে হয় আমার তোদের আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে তোরা হিংসায় মরে যাচ্ছিস।’
ঠিক এই সময় আমাদের নীলাটা একটা বাটি হাতে ফিরে এলো আর আমরা মজা দেখার জন্য সবাই চুপ করে গেলাম। নীলা খুবই গোবেচারা ভঙ্গিতে বাটিটা বিদেশী ভাইয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
‘আমার বোল লাগবে না, থ্যাঙ্কস।’
‘না, না, বাটিটা হাতে ধরে থাকেন–কখন কাজে লাগে বলা তো যায় না।’
এই কথায় আমরা সবাই হাসতে হাসতে শেষ। এবার সোহানা আর ভাইয়ের পক্ষ না নিয়ে পারলো না। ‘তোরা থাম তো! শাহরিয়ার ভাইয়া আসো, আমার পাশে এসে বসো।’
‘ইটস অকে। আমি ইনজয় করছি।’
আমরা সবাই তখন বেশ মজা করে সেই বিশাল ডিশে হাত ডুবিয়েছি। নাজনিন সোহানাকে দাবড়ানি দিলেও এখন ঠিকই খাইয়ে দিচ্ছে।
‘এই পিয়া কই যাস?’ নাজনিন জিজ্ঞাসা করে।
‘পানি আনতে।’
‘কয়েকটা কাঁচামরিচ নিয়ে আয় না।’
‘আম্মা, সালাদ কি শেষ হয়ে গেছে? ইশ সালাদ হলে খুব জম্পেশ করে খাওয়া যেতো।’
‘বেশি জম্পেশ করে খাওয়ার দরকার নাই। ধুমসি তো হচ্ছেন দিনকে দিন।’ আমি বললাম, বলেই বুঝলাম কী ভুল করলাম। ভিমরুলের চাকে ঢিল মারলাম। ‘এই তুই আমাকে কথাটা বললি, তাই না? আচ্ছা, আমাকে কি আজকে বেশি মোটা লাগছে, বল না, বল না? এই শাড়িটা একটু ফোলা ফোলা তাই না?’
‘নীলা, আর একবার ঘ্যান ঘ্যান করবি তো সিরিয়াস মার খাবি।’ তানিয়ার কড়া ধমক খেয়ে নীলার গলার আওয়াজ মিন মিন হয়ে গেলো। আমাদের বিদেশী ভাইয়া দেখি বাটিটাকে এরই মধ্যে কাজে লাগিয়েছেন।  বাটিতে বেশ আরাম করে তেহারি খাচ্ছেন আর কায়দা করে এমনভাবে চেয়ার ঘুরিয়ে বসেছেন যেন নাজনিনকে ভালোভাবে গিলতে পারেন। ভদ্রলোকের দেখি কঠিন পছন্দ হয়েছে নাজনিনকে। সোহানাকে খাওয়ানো শেষ করুক তারপর ওকে নিয়ে পড়া যাবে।

‘কে কে বোরহানি খেতে চাও?’ এক হাতে বোরহানির জগ উঁচু করে ধরে খালা জানতে চাইলেন। আমরা সবাই সমস্বরে খেতে চাইলাম।

খাওয়া দাওয়া চুকলো। একে একে সবাই বিদায় নেয়ার জন্য তৈরি হলো। আগামীকাল অনেক কাজ। ছেলের বাড়িতে হলুদ। আমরা সবাই যাবো। আজ আমরা পরেছিলাম গঙ্গা যমুনা শাড়ি। কাল পরবো কাঁথা স্টিচ। বন্ধুদের মধ্যে শুধু আমি থেকে গেলাম সোহানার সাথে। ওরা চলে যেতেই ছোট্ট ফ্ল্যাটটার উপর ক্লান্তি নেমে এলো। বিদেশী ভাইয়া উঠে গেলেন, খালা আমাদের কাপড় বদলাতে তাড়া দিলেন। কিন্তু আমার আর সোহানার কিছুই করতে ইচ্ছা করছিলো না। তারপর এক সময় ওর বেণীবাঁধা চুল আলগা করতে শুরু করলাম। ফুলের গয়না খুললাম, কাঁচের চুড়ি, কানের দুল। এই নিষ্পাপ হুল্লোড় আর অযথা পচানো তাহলে শেষ হচ্ছে। এই দুই জীবন আর কখনও মুখোমুখি হবে না এই উপলব্ধি সোহানাকে কিছুক্ষণ ম্লান করে রাখলো।
 
আবারও এক চোট বকা খেয়ে আমরা বিছানা করতে উঠলাম। বকার অবশ্য সিংহভাগ আমিই খেলাম। বিয়ের দু’দিন আগে খালা মেয়েকে প্রাণেধরে আর বেশি কিছু বলতে পারলেন না। মেঝেতে বিছানা পাতলাম, মশারি টাঙ্গালাম তারপর সোহানাকে বললাম, ‘শুতে আয়।’

‘শীলা?’

‘হু?’

‘ঘুমিয়ে পড়েছিস?’

‘হুম।’

‘বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে কার মতো হতো দেখতে?’

এই প্রশ্নে রাত আরও গভীর হয়ে নামলো। জানালা গলে একফালি চাঁদ মশারি অগ্রাহ্য করে হুঁটোপুটি খেলো মেঝের বিছানায়। আমরা শুয়ে থাকলাম। সোহানার কথা জানি না। ওর পিঠ আমার দিকে ফেরানো। শুধু আমার চোখ থেকে পানি পড়ছিলো অকারণে।

লন্ডন, অক্টোবর ২০০৭
=========================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা   গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না ..মানষ চৌঃ   গল্প- 'বীচিকলায় ঢেকে যায় মুখ ও শিরোনাম' by আনোয়ার ...  গল্প- 'প্রীত পরায়া' by সিউতি সবুর   গল্প- 'চলিতেছে' by মাহবুব মোর্শেদ   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা   গল্প- 'রূপকথা' by লুনা রুশদী  সঞ্জীব চৌধুরীর কয়েকটি গল্প   গল্প- 'অস্বস্তির সঙ্গে বসবাস' by ফাহমিদুল হক   গল্প- 'মঙ্গামনস্ক শরীরীমুদ্রা' by ইমতিয়ার শামীম   গল্প- 'হাজেরার বাপের দাইক দেনা' by জিয়া হাশান



bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ লীসা গাজী


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.