কবি জয়দেবের বসতভিটা সংরক্ষণ জরুরি by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

গীত গোবিন্দ’ খ্যাত সংস্কৃত কবি জয়দেবের বসতভিটা সংরক্ষণ করার কথা উঠেছে। সেনরাজ লক্ষ্মণ সেনের রাজসভার প্রধান কবি জয়দেবের জন্মস্থান যে বর্তমান জয়পুরহাট জেলার আমদই ইউনিয়নের কেন্দুলি (স্থানীয় লোকেরা বলে কেন্দুল) গ্রাম, তা সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ স্বীকার করে নিয়েছেন। এক সময় ধারণা করা হতো, জয়দেব মিথিলা-উড়িষ্যার কবি। অজয় নদের তীরের কেন্দুবিল্ব বা কেন্দুলি তাঁর জন্মস্থান। কেন্দুবিল্বতে জয়দেবের স্মরণে প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে মেলা বসে। খ্যাতনামা পণ্ডিত আচার্য সুকুমার সেন বলেছেন, অজয় নদের তীরে কেন্দুবিল্ব বা কেন্দুলি বলে কোনো গ্রামই নেই। তবে সেখানে যে মেলা বসে তা কেন্দুলির মেলা নামে পরিচিত। তাঁর অনুমান, সেখানে জয়দেব কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন; সে কারণে তার নিজ জন্মগ্রাম কেন্দুলির স্মরণেই এ মেলার নামকরণ হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা ইতিহাসে ঘটে থাকে। চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ আধ্যাত্মিক সাধক বায়েজিদ বোস্তামির মাজার আসলে রয়েছে ইরানের বোস্তাম শহরে। এ সাধক এখানে কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন বলে তাঁর ভক্তগণ সাধকের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এখানে একটি ‘পীঠ মাজার’ (কাল্পনিক মাজার) তৈরি করেছিলেন। জয়দেবের কেন্দুলির ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনই কিছু ঘটেছে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, জয়দেব ছিলেন সেনরাজ লক্ষ্মণ সেনের প্রধান সভাকবি। এই সেন রাজাদের রাজধানী ছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার পদ্মার তীরবর্তী বিজয়নগরে। লক্ষ্মণ সেনের পিতামহ বিজয় সেন ও পিতা বল্লাল সেন এখান থেকেই গৌড়-বরেন্দ্র শাসন করেছেন। জয়দেবের কাব্যে বিজয়নগর আর কেন্দুলির প্রকৃতির অনবদ্য চিত্র ফুটে উঠেছে। কদম, কেতকী, পলাশ, বকুল তো বাংলার নিজস্ব ফুল। এসব ফুলের অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন জয়দেব তাঁর ‘গীত গোবিন্দ’ কাব্যে। জয়দেব কদম ফুলের চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করেছেন, যেখানে প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাধার মনেও এক ধরনের আবেগ উপচে পড়ছে। তাঁর কাব্যের গুরুগম্ভীর ঘন বর্ষার ‘মেঘৈইর্মেদুরম্বং’ আকাশ আসলে বাংলাদেশেরই বৃষ্টিঝরা আকাশ। জয়দেবের অনেক কবিতার ভণিতায় বারবার এসেছে জন্মস্থান কেন্দুলির নাম।
গৌড়-বরেন্দ্রের এই প্রাচীন জনপদ বিজয়নগর কিংবা কেন্দুলে বসে জয়দেব এত বড় কবি হলেন কী করে, যে কারও মনেই প্রশ্নটা আসতে পারে। আগেই বলেছি, জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি। সেন রাজাদের অব্যবহিত আগে এ অঞ্চলে প্রায় সাড়ে তিন শো বছর শাসন করেছেন বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী পাল রাজারা। পাল শাসকদের সময় এখানে বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি সংস্কৃত সাহিত্যেরও গৌরবোজ্জ্বল ধারা গড়ে উঠেছিল। সোমপুর (পাহাড়পুর) বিহার এবং নিকটবর্তী জগদ্দল বিহারকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দর্শন ও অনুষ্ঠান নিয়ে বহু সাহিত্য রচিত হয় উত্তর ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার আদর্শে। চন্দ্রগোমীন ‘চান্দ্র ব্যাকরণ’; ব্যোপদেব ‘কবি কল্পদ্রুম’, ‘ধাতুবোধ’, ‘কাব্যে কামধেনু’; অতীশ দীপঙ্কর ‘মধ্যমকরত্নপ্রদীপ’; ‘ভট্টনারায়ণ’ ‘বেণী সংহার’ রচনা করেন। এ জয়পুরহাটেরই আরেক সংস্কৃত কবি ছিলেন মৌনভট্ট। মহাস্থানের গোকুলের অধিবাসী ছিলেন ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ ‘রামচরিতম’ গ্রন্থের রচয়িতা সন্ধ্যাকর নন্দী। সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা প্রজাপতি নন্দী ছিলেন পালরাজা রামপালের সান্ধি-বিগ্রহিক।
এঁদের উত্তর পুরুষ জয়দেব যখন কাব্য রচনা শুরু করেন, তখন সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা। প্রাদেশিক ভাষাগুলো নিজ নিজ সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে। কিন্তু জয়দেব এ অবস্থাতেই সংস্কৃত ভাষার নেতৃত্ব অস্বীকার করে সংস্কৃত ভাষাতেই কাব্যে বাংলাদেশের আবহ উপস্থাপন করে সাহিত্য সৃষ্টি করলেন। সংস্কৃত ভাষায় কাব্য রচনা করলেও পরোক্ষভাবে তিনি অনাগত কালের বাংলা সাহিত্যকে ছন্দে, ভাবোচ্ছ্বাসে, প্রেমানুভূতি ও ভক্তিরসে স্নাত করে রেখে গেলেন। তিনি বাঙালি কবিদের জন্য ভবিষ্যতের যে পথ নির্মাণ করে রেখে গেলেন, বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা চিরকাল তা স্মরণ করবে। বাঙালির সাহিত্যের চর্চার কথাই শুধু বলি কেন? ধর্ম-ভাবনা, সংস্কৃতি-চিন্তা, সামাজিক অবস্থা, রাজ্য-শাসননীতি প্রভৃতি অনেক তথ্যই জানা যাবে জয়দেবের সাহিত্য পাঠ করলে।
কবি জয়দেবের বসতভিটার অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত। যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তা রক্ষা করতে হবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সরকারি উদ্যোগে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে ‘প্রটেক্টেড মনুমেন্ট’ হিসেবে এটি অধিগ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশে প্রাচীন সাহিত্য (ক্লাসিক্যাল) চর্চা করার কোনো একাডেমি বা কেন্দ্র নেই। সম্ভব হলে এখানে ‘সেন্টার ফর স্টাডি অব এনশিয়েন্ট লিটারেচার’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। কেন্দুলির খুব কাছে সোমপুর আর জগদ্দল বিহারেই তো শুরু হয়েছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চর্যাপদ রচনার পর্ব। সাহিত্য-ঐতিহ্যের এই জনপদে সরকার প্রাচীন সাহিত্যচর্চার ওই কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। কেবল পশ্চিমা দেশেই বলি কেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ ধরনের বেশ কয়েকটি প্রাচীন সাহিত্য চর্চাকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।
বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া গেছে, তা অবশ্যই আমাদের গর্ব করার মতো বিষয়। সেই সঙ্গে সে ভাষার অতীতও সম্যক জানতে হবে বৈকি। এ প্রসঙ্গে এক শিশু শিক্ষার্থীর ঘটনা তুলে ধরছি। ঘটনাটি হলো, এক শিশু শিক্ষার্থীকে তার বাবা পড়াশোনা করলে কিছু উপহার দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। শিশুটিকে বলা হলো, তাদের বারান্দায় টবে রাখা পাতাবাহারের গাছ সম্পর্কে দশটি বাক্য লিখতে হবে। শিশুটি সাধ্যমতো লিখল। লেখাটি অসম্পূর্ণ বলে তার বাবা জানালে শিশুটি অত্যধিক মনোযোগ দিয়ে লেখাটি আবার তৈরি করে। এবারও লেখাটিতে কাঙ্ক্ষিত বিষয় না থাকায় নিরুপায় বাবা পুত্রকে টবের কাছে নিয়ে গিয়ে মাটি খুঁড়ে গাছের শেকড় দেখিয়ে বললেন, আদতে এ গাছটির মূলই হলো শেকড়, যার দ্বারা গাছটি বেঁচে আছে। শিশুটি সে বিষয়ে লিখতে পারেনি। বলা বাহুল্য যে, শেকড়টি দৃশ্যমান ছিল না বলেই এই শিশু শিক্ষার্থী তার লেখা পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরতে পারেনি।
শেকড় দেখতে পাওয়া যায় না বলে আমাদের অনেক কাজই অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। শেকড় না দেখার ঘটনা আর কত ঘটতে থাকবে? কবি জয়দেবের স্মৃতি রক্ষার জন্য অবশ্যই আমাদের কর্তব্য কিছু আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখবে।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.