কাসাবের সেই জবানবন্দি



২৬/১১ মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলার মামলার আসামি মুহম্মদ আজমল আমির কাসাবের ফাঁসির আদেশ দেওয়ার ঠিক দুই সপ্তাহ পর তাঁর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রকাশিত হয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায়।
২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কাসাবের জবানবন্দি রেকর্ড করেন অতিরিক্ত মুখ্য মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আর ভি সাওয়ান্ত। ৪০ পাতার স্বীকারোক্তিতে কাসাব জানিয়েছেন তাঁর গ্রামের কথা, কীভাবে শহরে কাজের সন্ধানে এসে জড়িয়ে পড়েন জঙ্গি সংগঠনে এবং কীভাবে করাচি থেকে মুম্বাইয়ে এলেন তাঁরা।
কাসাব তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেন, ‘আমার নাম মুহম্মদ আজমল আমির কাসাব। ১৯৮৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আমার জন্ম। আমি পাকিস্তানের বাসিন্দা। ফরিদকোটের একটি প্রাথমিক স্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। আমার বাবার দোকান ছিল একেবারে রাস্তার ধারে। আমি টিভি ও হিন্দি সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসতাম। আমার প্রিয় হিন্দি সিনেমা হলো—শোলে, লাওয়ারিশ, বীর জারা, আশিকি ও বেটা। আমি তামাক সেবনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ২০০০ সালে আমি স্কুল ছেড়ে আমার বন্ধু ডিট্টুর সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিই। তার পরের বছর আমি লাহোর রওনা হই। আমার বাবার সঙ্গে ভালো কাজের সন্ধানে সেখানে শ্রমিকের কাজ করি টানা পাঁচ বছর। সেখানেই পরিচয় হয় মুজাফ্ফর লাল খানের সঙ্গে এবং পরে আমাদের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে আমরা দুই বন্ধু মিলে রাওয়ালপিন্ডি রওনা হই আরও ভালো কাজের সন্ধানে। সেখানে আমার সঙ্গে দেখা হয় লস্কর-ই-তাইয়েবার একজনের সঙ্গে। তিনি আমাকে প্রথমে বলেন, “সাহায্য করো কাশ্মীরিদের, তাদের স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে এসো” ইত্যাদি।
‘আমরা ভাবলাম, আমাদেরও কিছু ভালো কাজ করা উচিত মানুষের জন্য। আমরা যখন সরাই আলমগীরে জামাত-উদ-দাওয়া (লস্কর-ই-তাইয়েবার মূল সংগঠন) কাজ করি, তখন এই ভাবনাটা এল। তারপর তারা আমাদের বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যেতে লাগল। সেখানে আমরা তাদের কথা মন দিয়ে শুনতাম। কথা শোনার পর একদিন দুজনই সিদ্ধান্ত নিলাম, জেহাদি প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেব। সেই মতো ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে রাওয়ালপিন্ডির রাজাবাজারে লস্করের অফিসে পৌঁছালাম। তারপর প্রশিক্ষণ শুরু। মাত্র ছয় মাসে দুটি প্রশিক্ষণ শিবিরে আমরা শিখলাম কীভাবে আধুনিক অস্ত্র চালাতে হয়। জামাত-উদ-দাওয়ার প্রধান হাফিজ সাঈদ আমাদের ২২ জন মুজাহিদের মধ্যে কয়েকজনকে মনোনীত করলেন। তার মধ্যে আমি একজন। এবার আমার নতুন নাম দেওয়া হলো আবু মুজাহিদ। তার পরই আমাদের ১৩ জনকে নিয়ে যাওয়া হলো পাকিস্তানের বন্দরনগর করাচিতে। সেখানে নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ শুরু হলো। কীভাবে সমুদ্রের দিক চিহ্নিত করতে হবে, কীভাবে সমুদ্রে জাল ফেলতে হবে, সমুদ্রের গভীরতা মাপতে হবে কীভাবে ইত্যাদি। ওই প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো বাইতুল মুজাহিদিনে। সেখান থেকে আমাদের ছয়জনকে হাফিজ সাঈদ পাঠালেন কাশ্মীর সীমান্তে আক্রমণের প্রশিক্ষণ নিতে। সেখান থেকে প্রচুর অস্ত্র, বিস্ফোরক পদার্থ, মোবাইল ফোন এবং আরও অনেক কিছু নিয়ে আমরা ফিরে এলাম ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর। তারপর আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আবু ইসমাইল আমাদের ফিদাইন গোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিতে লাগলেন এবং কীভাবে আমাদের ছড়িয়ে গিয়ে হামলা শুরু করতে হবে জানালেন।
‘পরের দিন ২২ নভেম্বর সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়লাম এবং তার পরই মুম্বাইয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হলাম। একটা ছোট্ট রাবারের ডিঙি নিয়ে ২৬ নভেম্বর রওনা হলাম মুম্বাইয়ের পথে। নির্দিষ্ট সময়ের থেকে দেড় ঘণ্টা পরে রাত নয়টায় মুম্বাইয়ের বুধবার পার্কের ঘাটে এসে পৌঁছালাম। ২০ মিনিট পর আমি ও ইসমাইল রওনা হলাম মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসের দিকে। সেখানে পৌঁছেই ইসমাইল অপেক্ষারত যাত্রীদের দিকে গ্রেনেড ছুড়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করল। আমিও গুলি চালাতে শুরু করলাম। তারপর স্টেশনের বাইরে কামা হাসপাতালের দিকে এলাম। হাসপাতালের বাইরে দেখলাম একটি পুলিশের জিপ আমাদের দিকে আসছে। এলোপাতাড়ি গুলি চালালাম। তারপর ওই পুলিশের ভ্যান নিয়ে অন্যত্র যাওয়ার চেষ্টা করলাম, তখন দেখি ভ্যানের সামনের চাকায় হাওয়া নেই। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্কোডা গাড়িটি নিয়ে চম্পট দিলাম। তারপর আমরা পৌঁছালাম গিরগাঁও এলাকায়। পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময় হলো। ইসমাইল গুলিতে মারা গেল। আমি ধরা পড়ে গেলাম।’

No comments

Powered by Blogger.