ব্রাজিলের ‘মারকানা’ কান্না

বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ফুটবলকে পুনরায় উজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয় বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা। এ জন্য ১২ বছর ধরে নির্বাসিত বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে লুক্সেমবার্গে অনুষ্ঠিত ফিফা কংগ্রেসে বিশ্বকাপ আয়োজনে ইচ্ছুক দেশগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলায় বিধ্বস্ত ইউরোপীয় কোনো দেশই ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে ফিফার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য আর কোনো দেশ আবেদন না করায় ফিফা ব্রাজিলকেই বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য মনোনীত করে।
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নেয় ফুটবলের জনক ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপের আগ দিয়ে ইংল্যান্ড ফিফার সঙ্গে নিজেদের বিরোধ মিটিয়ে আবারও সংস্থাটির সদস্যপদ গ্রহণ করে। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইংল্যান্ড ফিফার বাইরে ছিল। ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। মাঝখানের দুটি বিশ্বকাপে অনুপস্থিত উরুগুয়ে ৫০ সালের বিশ্বকাপে আবার ফিরে আসে। আর ফিরে এসেই ফাইনালে ব্রাজিলের লাখো দর্শককে কাঁদিয়ে ব্রাজিলের মাটি থেকে জিতে নিয়ে যায় বিশ্বকাপের শিরোপা।
১৯৫০ সালে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েও তা হেলায় হারায় ভারত। ভারতের বিশ্বকাপে না খেলতে পারার কারণটা বড় অদ্ভুত। ভারতীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ) ফিফার কাছে আবেদন জানায়, বিশ্বকাপে ভারতীয় দল খালি পায়ে কেবল অ্যাংকলেট পড়ে খেলতে নামবে। ফিফা আইএফএর সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে ভারতের আর বিশ্বকাপ খেলা হয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এই বিশ্বকাপে অনেক দেশই অংশ নেয়নি। বিশ্বযুদ্ধের কারণে একঘরে জার্মানিকে অংশ নিতেই দেওয়া হয়নি। অস্ট্রিয়া বিশ্বকাপের আগে নিজেদের জাতীয় দলকে বিশ্বকাপ খেলার অনুপযুক্ত মনে করে নাম প্রত্যাহার করে নেয়। চেকোস্লোভাকিয়া, রাশিয়া, হাঙ্গেরি রাজনৈতিক কারণে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। তবে বিশ্বকাপের মাত্র এক বছর আগে একটি মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় ইতালি জাতীয় ফুটবল দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড় নিহত হলেও ইতালি শেষ পর্যন্ত ভঙ্গুর দল নিয়েই বিশ্বকাপে অংশ নেয়।
১৩টি দল নিয়ে আয়োজিত এই বিশ্বকাপে ছিল এক অদ্ভুত ফরম্যাট। ১৩টি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করে, প্রতিটি গ্রুপ চ্যাম্পিয়নকে নিয়ে আবার রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে দ্বিতীয় রাউন্ড অনুষ্ঠিত হয়। এই দ্বিতীয় রাউন্ডে চারটি দল চারটি দলের সঙ্গে মুখোমুখি হয়, শীর্ষে থাকা দুটি দল ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় অঘটনটি ঘটে, ইংল্যান্ড-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচে। সেই ম্যাচে ফুটবলের জনকদের ১-০ গোলে হারিয়ে সবাইকে হতবাক করে দেয় ফুটবলে নবাগত যুক্তরাষ্ট্র। এই ম্যাচটি নিয়ে একটি মজার ঘটনা আছে—ম্যাচের পরের দিন সকালে দৈনিক পত্রিকা খুলে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ মনে করে, খবরটি ছাপানোর সময় নিশ্চয়ই কোথাও ভুল করেছে সংবাদপত্রগুলো। নিশ্চয়ই ফলটি ১০-১ লিখতে গিয়ে মুদ্রণপ্রমাদ বশত ‘০-১’ হয়ে গেছে! এই খবরটি পড়ে বিভিন্ন মারফত বহু পাঠক সংবাদপত্র কার্যালয়ে যোগাযোগ করে। কিন্তু পত্রিকাগুলো থেকে জানানো হয়, কোনো মুদ্রণপ্রমাদ নয়, গতকাল যুক্তরাষ্ট্র আসলেই ইংল্যান্ডকে পরাজিত করেছে।
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। বিশ্বকাপের ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ফাইনাল এটি। ব্রাজিলীয়দের জন্য এই ফাইনাল ছিল এক ট্র্যাজিক অধ্যায়। ১ পয়েন্টে এগিয়ে থেকে ফাইনাল খেলতে নেমে শিরোপা জয়ের জন্য ব্রাজিলের প্রয়োজন ছিল কেবল ড্র। রিও ডি জেনিরোর বিখ্যাত মারকানা স্টেডিয়ামে এক লাখ ৭৪ হাজার দর্শক সেদিন মাঠে গিয়েছিল উত্সব করতে করতেই। তত্কালীন ব্রাজিলের তুখোড় ফর্মের কাছে উরুগুয়ে খরকুটোর মতো উড়ে যাবে—এমন ধারণাই ছিল সবার। খেলা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ব্রাজিলের একের পর এক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে উরুগুয়ে। প্রথমার্ধজুড়েই অ্যাদেমির, জিজিনহো ও জাইর ত্রয়ীর আক্রমণ ঠেকাতে নাকাল হতে থাকে উরুগুয়ে। উরুগুয়েন গোলরক্ষক গাস্তন ম্যাসপোলির অসাধারণ নৈপুণ্য সেদিন উরুগুয়েকে অন্তত পাঁচটি নিশ্চিত গোলের হাত থেকে রক্ষা করে। দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটে ব্রাজিল অবশেষে উরুগুয়ের গোলমুখ খুঁজে পায়। অ্যাদেমির ও জিজিনহোর সমন্বয়ে একটি পরিকল্পিত আক্রমণ থেকে গোল করেন অ্যাদেমির। মারকানা স্টেডিয়ামের উত্সব যেন নতুন মাত্রা পায় সেই মুহূর্তে। গোল করেও একের পর এক আক্রমণ করে যেতে থাকে ব্রাজিল। আক্রমণ করতে করতে ক্লান্ত ব্রাজিল দলের ফাঁক-ফোকর বের করে বুদ্ধিদীপ্ত প্রতি আক্রমণ শুরু করে উরুগুয়ে। খেলার ৬৬ মিনিটের সময় সমতা ফিরিয়ে আনে উরুগুয়ে। ব্রাজিলের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় বিগোদের একটি ভুলে ঝিজিয়া মুহূর্তের জন্য থমকে দেন মারকানা স্টেডিয়ামকে। পরক্ষণেই আবার প্রাণ ফিরে আসে স্টেডিয়ামে। কারণ দর্শকেরা জানত, একটি ড্র-ই ব্রাজিলের শিরাপা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বিধি বাম। খেলার ৭৯ মিনিটের সময় সেই ঝিজিয়াই মারকানাতে প্রেতপুরীর নিস্তব্ধতা নামিয়ে আনেন উরুগুয়েকে ২-১ গোলে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে। বাকি ১১ মিনিটে ব্রাজিল আরও কয়েকটি আক্রমণ করেও কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখা পায়নি। রেফারি খেলার শেষ বাঁশি বাজালে শোকস্তব্ধ মারকানা স্টেডিয়ামের লাখ লাখ দর্শক কান্নায় ভেঙে পড়ে, কয়েকজন তো এই দুঃখ সইতে না পেরে মারকানার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহননের পথই বেছে নেয়।
শিরোপা জয়ের ব্যাপারে ব্রাজিল এতটাই নিশ্চিত ছিল যে ফাইনালের পরের দিন দেশটিতে সরকারিভাবে আগাম ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ছুটি ব্রাজিলীয়রা কাটিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এ রকম শোকের আবহ দেশটিতে আগে কখনো দেখেনি কেউ। ফাইনালের পরের দিন পুরো ব্রাজিল ছিল শোকস্তব্ধ। নীরব, নিথর। সেই দিনটির সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকা প্রবীণেরা আজও শিউরে ওঠেন ফাইনাল-পরবর্তী ব্রাজিলের কয়েকটি দিনের কথা মনে করে।

No comments

Powered by Blogger.