দ্রাবিড়ের পরামর্শ আর পরিশ্রম

দুজনকে মেলাবেন কীভাবে? আইপিএলে দুজন একই দলে খেলেন বা দুজনেই ডানহাতি ব্যাটসম্যান, এমন মিল অবশ্য দেখানো যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিচয় যেটা, ‘ক্রিকেটার সত্তা’ তাতেই তো রাহুল দ্রাবিড় ও কেভিন পিটারসেনের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। একজন ধৈর্যের প্রতিমূর্তি, শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাটসম্যান, খেটে-খুটে রান করতেই ভালোবাসেন। আরেকজনের ব্যাটিংয়ে প্রথাবিরুদ্ধতার জয়গান। ব্যাকরণ-ট্যাকরণ পরে, আগে বোলারকে ছিঁড়েফুঁড়ে ফেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ব্যাটিং-দর্শনটাই তো দুজনের পুরো আলাদা। কিন্তু যখন খারাপ সময় আসে, সবাইকে যে ফিরে যেতে হয় শেকড়ে!
সর্বশেষ ৬ ইনিংসে ফিফটি নেই, বাঁহাতি স্পিনটাকে মনে হচ্ছে জগতের সবচেয়ে বড় রহস্য, পিটারসেনকেও তাই ফিরতে হয়েছে মূলে। ফোন করেছিলেন তাই ‘ব্যাটিং-শুদ্ধতার প্রতীক’ দ্রাবিড়কে। ফলাফল তো কাল নিজের চোখেই দেখেছেন, পিটারসেনের মুখেও শুনুন, ‘এই সপ্তাহেই আমার বন্ধু রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে ফোনে অনেকক্ষণ কথা বলেছি, ও আমাকে বেশ কিছু টিপস দিয়েছে। আমি চেষ্টা করেছি সে অনুযায়ী খেলতে, টিপসগুলো কাজে লেগেছে। আমি জানতাম আমাকে কিছু একটা নিয়ে কাজ করতেই হবে এবং আমি করেছি।’
স্পিন-রহস্য যাঁদের কাছে মোটেও দুর্বোধ্য ছিল না, সেই ব্যাটসম্যানদের একজন এখন তাঁর কোচ। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকেও কৃতজ্ঞতা জানালেন অনেকবার, ‘অ্যান্ডি স্পিনের বিপক্ষে দারুণ ব্যাটসম্যান ছিল। ওর সঙ্গে নেটে কাটানো সময়টা আমার খুব উপকারে এসেছে। গত একটা সপ্তাহ আমি অনেক পরিশ্রম করেছি।’
শেন ওয়ার্নের মতো বোলারকে পাত্তা দেননি, মুত্তিয়া মুরালিধরনের দুসরা অবলীলায় রিভার্স সুইপ করে গ্যালারিতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাঁহাতি স্পিনটা পিটারসেনের জন্য ‘জুজু’ হয়েই ছিল। ভেট্টোরি-হ্যারিস-বেনদের বিপক্ষে তো বটেই, ভারতে গিয়ে ভুগেছেন যুবরাজ সিংয়ের মতো পার্টটাইমারের বোলিংয়েও। বাংলাদেশে আসার পর থেকেও বাঁহাতি স্পিন দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাঁকে। সেটি জয় করাই ছিল পিটারসেনের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাতে জয়ী হওয়ার মূলে আছে ব্যাটিং নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা, ‘বাঁহাতি স্পিনারের বিপক্ষে টানা ব্যর্থ হয়েছি, ব্যাটিংয়ে একটা কিছু পরিবর্তন আমাকে আনতেই হতো। এই মুহূর্তে (ওয়ানডে) র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের সেরা তিনজন বোলারই বাঁহাতি স্পিনার—ভেট্টোরি, সাকিব ও প্রাইস। অনেকবার সামনের পায়ে এলবিডব্লু হয়েছি, এটা নিয়েও ভাবতে হয়েছে। অ্যান্ডির সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেছি, দ্রাবিড়ের পরামর্শ তো ছিলই।’
দ্রাবিড়-অ্যান্ডির পরামর্শ নিয়েছেন, কিন্তু টিপস পেয়ে বসে থাকলেই তো আর হয় না। সবচেয়ে জরুরি ছিল সেটি নিয়ে কাজ করা। একটুও ফাঁকি দেননি তাতে, ‘সব ক্রিকেটারের জীবনেই ব্যাড প্যাচ আসে। আমি কখনোই চেষ্টার কোনো কমতি রাখিনি, দিনের পর দিন চেষ্টা করেই গিয়েছি। নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের সঙ্গে কাটিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি, আপনি যতটা কঠোর পরিশ্রম করবেন, ততটাই সফল হবেন। শুধু এই খারাপ ফর্মের জন্য নয়, পুরো ক্যারিয়ারেই আমি একটা জিনিস মেনে এসেছি—পরিশ্রম না করলে কিছুই পাওয়া যায় না।’
সেঞ্চুরিটা পাওয়া হয়নি, তবে রান তো পেয়েছেন, খেলার ধরনেও ছিল সেরা ফর্ম ফিরে পাওয়ার আভাস। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে পেয়েছেন দুর্বিষহ দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসতও, ‘গত ১২টা মাস ছিল ভয়াবহ। ইনজুরি, এর পর দক্ষিণ আফ্রিকায় বাজে ফর্ম, ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পা নড়ছিল না। যত ভালো ক্রিকেটারই হন না কেন, একটা ব্যাড প্যাচ আসবেই, মনে হবে পরের রানটা কোত্থেকে আসবে। এই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, তাই আমি জানি কষ্ট করতেই হবে।’ ১৪তম ইংলিশ হিসেবে নড়বড়ে নিরানব্বইয়ে আউট হয়ে অবশ্য একটু হতাশ, তার চেয়ে বেশি হতাশ আরও বড় স্কোর না পেয়ে।
দিন শেষে দেখা গেল ড্রেসিংরুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছেন। হয়তো দ্রাবিড়কেই বলছেন, ‘বন্ধু ধন্যবাদ। সাফল্যের সবচেয়ে বড় রেসিপি ওই একটাই—পরিশ্রম।’

No comments

Powered by Blogger.