ইউপি নির্বাচনে আট তথ্য -সংসদীয় কমিটির সুপারিশ আত্মঘাতী

মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা দেওয়ার বিধান বাতিল এবং বিলখেলাপিদের নির্বাচনে যোগ্য ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন) পরিষদ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে দেওয়া সংসদীয় কমিটির সুপারিশ পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য। এটি গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দিনবদলের অঙ্গীকারের প্রতি একটি ছুরিকাঘাত। কারণ বর্তমান যুগটা শাসনব্যবস্থার সর্বত্র, বিশেষ করে জনপ্রতিনিধিদের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থার তৃণমূলের মৌলিক স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের প্রশাসনিক একাংশ। এই প্রশাসনিক একাংশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেন চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। তাঁদের প্রত্যেকের জীবন ও কার্যাবলি সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ এবং প্রত্যক্ষভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করে থাকে। সে কারণে নীতি-নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয় এই স্তরের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হলে এর ব্যাপকভিত্তিক সুফল জাতি আশা করতে পারে।
তৃণমূলের মানুষ মন্ত্রী দূরে থাক, সংসদ সদস্যদেরই চোখে দেখার সুযোগ কালেভদ্রে পেয়ে থাকেন। তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের সুখে-দুঃখে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদেরই পেয়ে থাকেন। আর এটা অনস্বীকার্য যে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে সমাজের সবচেয়ে ভালো ও নিরীহ মানুষদের সামাজিক নেতা হওয়ার দিন অনেকটাই বাসি হয়ে গেছে। এখন যে নিতান্ত সত্ ও নিরীহ লোকের প্রায় বিনা খরচে, কেবল জনগণের ভালোবাসায় চেয়ারম্যান ও মেম্বার হওয়ার দিন একেবারেই বাসি হয়ে গেছে তা নয়; তবে এটা অনস্বীকার্য যে তাঁদের সংখ্যা কমছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব ব্যাধি, বিশেষ করে কালো টাকা ও পেশিশক্তি, তা কিন্তু এই নির্বাচনের প্রক্রিয়ায়ও ঢুকে পড়েছে। অশুভ প্রতিযোগিতা, টাকার খেলা, ক্ষমতার দাপট, সর্বোপরি দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি স্থানীয় শাসনকেও কলুষিত করেছে। সুতরাং এখন সময় যেখানে অধিকতর স্বচ্ছতার, সেখানে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া একটি দুর্ভাগ্যজনক পশ্চাত্মুখী যাত্রা।
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর বলেছেন, চলতি অধিবেশনেই ওই সুপারিশ আইন আকারে পাস হবে। আট তথ্য না দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গাইতে তিনি নির্লজ্জ। তাঁর হাস্যকর যুক্তি: ‘সংসদের মতো এত জটিল আইন ইউনিয়ন পরিষদে থাকা কাম্য নয়।’ কথিত পরিবর্তনে সংকল্পবদ্ধ মন্ত্রিসভার সদস্যের মানসিক গঠন চাপা থাকেনি। সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতাসংক্রান্ত নিয়মকানুনগুলো তাঁর কাছে সরল নয়, জটিল। বিগত সাধারণ নির্বাচনে আট তথ্য নিয়ে এত কাঠখড় পোড়ানোর পরও অনেক প্রভাবশালী আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। এবং তাঁদের পক্ষে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তথ্যসংক্রান্ত হলফনামার বিধান প্রবর্তন বিরাট ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সংসদনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এলেন। আমরা যতদূর জানি, শেখ হাসিনা প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিবর্তনবিষয়ক স্লোগানের একজন সমর্থক। ওবামা পাবলিক অফিসে কাজ করতে আগ্রহীদের ৬৩ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য (ট্রাফিক নিয়ম ভেঙে ৫০ ডলারের বেশি জরিমানাদানের মতো তথ্যসহ) প্রকাশ বাধ্যতামূলক করেন। পরিবর্তন আনার কথা বলে বড় বিজয় অর্জনকারী আমাদের সংসদনেত্রী প্রস্তাবিত ওই আত্মঘাতী আইন প্রণয়নের আগে ওবামার এই নীতি বিবেচনায় নিতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.