মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমবাজার: দুর্দশার গহ্বর -প্রবাসীশ্রমিক by সুমন রহমান, এ কে এম মোহসীন

সমপ্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানোর ব্যাপারে সে দেশের নিষেধাজ্ঞা এখনো বহাল আছে (প্রথম আলো, ২৪ জুলাই ২০০৯)। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের মানবেতর জীবন নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারমাধ্যমে তোলপাড় হওয়ায় গত মার্চে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে করে প্রায় ৫৫ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি, যাঁরা মালয়েশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য দুই বছর আগে টাকা-পয়সা দিয়ে বিমানে চড়ার অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁদের ভাগ্যটি কার্যত আরও ঝুলে যায়। তখন থেকেই এসব শ্রমিকের নিয়োগ-এজেন্টদের তরফ থেকে বলা হচ্ছিল, অচিরেই এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে এবং তাঁরা মালয়েশিয়া যেতে পারবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি সেই আশার কফিনে আরেকটা পেরেক মারল। কে জানে এটাই শেষ পেরেক কি না!
২০০৬ সালে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে ৮৪ হাজার টাকা খরচ করে একজন বাংলাদেশি শ্রমিক চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়া যেতে পারার কথা। যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা কাগজ-কলমে ৮৪ হাজার টাকাই দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে দিয়েছেন দুই লাখ ২০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত। অতিরিক্ত টাকাটা ভাগজোক হয়ে গেছে কিছু বাংলাদেশি ফড়িয়া ও মালয়েশীয় এজেন্টদের মধ্যে। এই নির্বিচার লুটের বখরা দুই দেশেই অতি উচ্চপ র‌্যায় পর্যন্ত গেছে, এটাও অনেকের জানা। যা-ই হোক, কাগজ-কলমে যে ৮৪ হাজার টাকা, এর মধ্যে ওই শ্রমিকের এক বছরের লেভি (সরকারকে প্রদেয় কর) অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য দেশে যেখানে শ্রমিকের লেভি তাঁর নিয়োগদাতা কোম্পানি দিয়ে থাকে, মালয়েশিয়ায় সেটা অত্যন্ত অমানবিকভাবে শ্রমিকের বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে সেটা বছরে ৩০০ রিঙ্গিত থেকে এক হাজার ৮০০ রিঙ্গিত (বাংলাদেশি টাকায় ছয় হাজার টাকা থেকে ৩৬ হাজার টাকা) পর্যন্ত।
এখন ধরা যাক, একজন শ্রমিক আড়াই লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় এসে এমন একটা চাকরি পেয়েছেন, যেখানে নিয়মিত কাজ আছে এবং বেতন-ভাতা আছে। সে ক্ষেত্রে সার্ভিস সেক্টরে একজন শ্রমিকের আদর্শ বেতন মাসে ৬০০ রিঙ্গিত বা বাংলাদেশি টাকায় ১২ হাজার টাকার মতো। এই টাকা থেকে মাসে ১৫০ রিঙ্গিত লেভি, ১৫০ রিঙ্গিত খাওয়া খরচ, আরও ১০০ রিঙ্গিত অন্যান্য (ফোন, সিগারেটের খরচ ইত্যাদি)। বাকি থাকে ২০০ রিঙ্গিত, যা বাংলাদেশি মুদ্রা চার হাজার টাকার মতো। বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। এখন আড়াই লাখ টাকা দিয়ে তিন বছরের চুক্তিতে মালয়েশিয়ায় যাওয়া শ্রমিক তিন বছরে মোটের ওপর মাত্র দেড় লাখ টাকা বাড়ি পাঠাতে পারেন। ধরা যাক, তাঁর চুক্তি নবায়ন হলো আরও দুই বছর। মালয়েশিয়ার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বিদেশি শ্রমিক সে দেশে পাঁচ বছরের বেশি কাজ করতে পারবেন না। তো, এই পাঁচ বছর নিয়মিত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার মাধ্যমে আমাদের শ্রমিকটি আসলে তাঁর ‘চালান’টিই ফেরত পাবেন মাত্র। আর এই ফেরত পাওয়া চালানকে রেমিট্যান্স ভেবে আমরা পরম আনন্দে বগল বাজাব!
এ তো গেল আদর্শ পরিস্থিতির কথা। মোটের ওপর ২০ শতাংশ শ্রমিকের এই ভাগ্য হয়েছে মালয়েশিয়ায়। বাদবাকি ৮০ শতাংশের ক্ষেত্রে চিত্রটি ভয়াবহ। শুরু করি লেভি প্রসঙ্গ দিয়েই: সরকার নির্ধারিত ৮৪ হাজার টাকার মধ্যে ওই শ্রমিকের এক বছরের লেভি অন্তর্ভুক্ত থাকলেও মালয়েশিয়ায় গিয়ে আবারও সেটা দিতে বাধ্য হন ওই ৮০ শতাংশ শ্রমিক। অর্থাৎ প্রথম বছর থেকেই কোম্পানি লেভি কর্তন করতে শুরু করে। কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা আরও ভয়াবহ: লেভি কর্তন করার পরও দ্বিতীয় বছরের শুরুতে কোম্পানি এবং এজেন্ট ওই শ্রমিকের চুক্তি নবায়নে থোক দুই থেকে আড়াই হাজার রিঙ্গিত দাবি করে। শ্রমিক যখন বলেন যে তিনি নিয়মিত লেভি দিয়েছেন, তখন তাঁকে বলা হয় ওটা লেভি নয়, ‘কমিশন’ ছিল! এখন টাকা দিতে না পারলে চুক্তি নবায়ন হবে না। আবার, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোম্পানি/ফ্যাক্টরিগুলো পুরো বছরের কাজ দিতে পারে না শ্রমিককে। গড়ে পাঁচ মাস থেকে নয় মাস কাজ থাকে তাঁর। বাকি সময় বসে বসে খেতে হয়। ফলে বছরে পাঁচ মাস থেকে নয় মাস কাজ করে যে টাকা তিনি উপার্জন করেন তা থেকে লেভি ও খাইখরচা বাদ দিলে যা থাকে তা দিয়ে আবার আগামী বছরের লেভি পরিশোধ করা তাঁর পক্ষে নিতান্ত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া, ক্রমাগত হাতবদলের চক্করে তাঁর ন্যায্য মজুরিও বুঝে পান না তিনি, চাইতে গেলে শারীরিক নিগ্রহ তো আছেই। তখন তাঁর সামনে তিনটা পথ খোলা থাকে: হয় দেশ থেকে টাকা এনে লেভি পরিশোধ করা, নয় দেশে চলে আসা (তাও যদি বিমানভাড়া থাকে), নয়তো ‘অবৈধ’ শ্রমিক হয়ে গিয়ে ফ্যাক্টরি বা এজেন্টের হাতে বন্দী হয়ে থাকা কিংবা পালিয়ে ফেরারি হয়ে যাওয়া।
বেশির ভাগ শ্রমিক তৃতীয় পন্থাটি বেছে নিতে বাধ্য হন। মালয়েশিয়ায় তাঁর বাংলাদেশি পাসপোর্টই ওয়ার্ক পারমিট। সেটা মালিকের জিম্মায় থাকে। মালিক বা এজেন্ট তখন এসব শ্রমিককে হয় তাঁদের ডর্মে বন্দী করে রাখে, নয়তো অন্য কোনো কোম্পানির কাছে বেচে দেয়। পাসপোর্টহীন এসব শ্রমিকের পক্ষে তখন সুদূর কুয়ালালামপুর পর্যন্ত গিয়ে হাইকমিশনে অভিযোগ করারও সাধ্য থাকে না। আর তাতে কোনো ফায়দাও নেই। ইতিমধ্যে জেনে গেছেন তাঁরা বাইরে বেরোলেই বিপদ। পুলিশের হাতে পড়লে শ্রীঘরে। পুলিশকে টাকা না দিলে নিশ্চিত কারাবাস। পাসপোর্ট যেহেতু মালিকের জিম্মায়, কাজেই রাস্তাঘাটে কোনো শ্রমিক ধরা পড়লে তাঁকে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে গিয়ে পুলিশ মোটা টাকা দাবি করে। শ্রমিক এত টাকা পাবেন কোথায়? এখন ধরা যাক তাঁর কোম্পানি, কোনো আত্মীয় বা নিয়োগকারী বাংলাদেশি এজেন্টের কাছ থেকে তিনি হয়তো পুলিশের ঘুষের টাকাটা ধার হিসেবে চাইবেন। সে ক্ষেত্রে ডিটেনশন সেন্টার থেকে ওই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বরে একটা মিসড কল দেওয়ার সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয়। ডিটেনশন সেন্টার থেকে প্রতিটি মিসড কলের চার্জ ১০ রিঙ্গিত!
এভাবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যে অবস্থাটি মালয়েশিয়ায় দেখা যায়, তাকে ‘একবিংশ শতাব্দীর নব্য দাসপ্রথা’ বলে অভিহিত করেছেন প্রত্যক্ষদর্শী অনেক সাংবাদিক এবং গবেষক। একটা দৃষ্টান্ত দিই: ২০০৮ সালে জোহর বাহরু এলাকায় এক ফ্যাক্টরির ৬০/৭০ জন শ্রমিকের লেভির টাকা ওই কোম্পানি সরকারকে পরিশোধ না করায় তাঁরা আইনত অবৈধ হয়ে যান। তখন এসব শ্রমিকের অন্য এজেন্টের কাছে বেচে দেওয়া হয়। লোকালয় থেকে বেশ দূরে এক পরিত্যক্ত দোকানঘরে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল তাঁদের। বাইরে যাওয়া বারণ ছিল, যেহেতু তাঁরা ‘অবৈধ’। ঘরে তালা লাগিয়ে রাখা হতো। কিছুদিন পরপর লরিতে করে তাঁদের কাজের জন্য এখানে-ওখানে নিয়ে যাওয়া হতো। দু-তিন দিন পরপর কিছু খাবার দেওয়া হতো। ৬০-৭০ জনের প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনের জন্যও ছিল একটি বাথরুম, ওই খুপড়ি-লাগোয়া। এভাবে এই অসহনীয় দশায় তিন মাস কাটিয়ে গত মার্চ মাসে এই শ্রমিকেরা জানালা ভেঙে পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে আমরা সেই ঘরটি দেখতে গিয়েছিলাম। ঘরের দেয়ালে বড় বড় করে বাংলায় লেখা ছিল—‘দোজখের আরেক নাম মালয়েশিয়া’!
এভাবে ফ্যাক্টরির ‘জেলখানা’ থেকে বের হয়ে ওই সব ভাগ্যবিড়ম্বিত শ্রমিক গোটা দেশটাকেই পায় জেলখানা হিসেবে। কয়েদির নিশ্চিত জীবনও তাঁর নয়। ফেরারি আসামির মতো পালিয়ে পালিয়ে কাজ করে চলেন তিনি। পদে পদে পুলিশ কিংবা তামিল গ্যাংস্টারদের নিগ্রহ তাঁকে তাড়া করে। কখনো এক শহরে কোনো ফ্যাক্টরি, কখনো অন্য শহরে কোনো দোকান, কখনো গ্রামে প্লানটেশন সেন্টারে, এভাবে দিনের পর দিন কাটে তাঁর। তিনি জানেন না তাঁর ভবিষ্যৎ কী, জানেন না দেশে ফিরতে পারবেন কি না। মালয়েশিয়ায় বৈধ শ্রমিকেরও কোনো ইনজুরি ইনস্যুরেন্স করা হয় না। অবৈধ হলে তো প্রশ্নই আসে না। ফলে কারও হাত-পা ভেঙে গেলে, আঙুল কেটে গেলে বা কেউ মারা গেলে এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ নেই।
৫৫ হাজার শ্রমিকের মালয়েশিয়া-গমন যে কার্যত ঝুলে গেল তাতে আসলে ক্ষতি কতটুকু হলো? এসব শ্রমিকের অধিকাংশেরই নিয়োগদাতা কোনো না কোনো আউটসোর্সিং কোম্পানি, সরাসরি ফ্যাক্টরি নয়। তাদের হাতে যদি ১০০ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার মতো চাকরি থাকে, তবে তারা এক হাজার বা পাঁচ হাজার শ্রমিক নিয়ে আসে। ভিসা ফির সঙ্গে পাওয়া অতিরিক্ত টাকাটার লোভে। চাকরিহীন অতিরিক্ত শ্রমিক তখন ওই আউটসোর্সিং কোম্পানির ডর্মে কার্যত বন্দী অবস্থায় থাকেন, এমনকি কখনো কখনো এয়ারপোর্ট থেকেও তাঁদের ছাড়িয়ে নেওয়া হয় না। তখন এয়ারপোর্টের ডিটেনশন সেন্টারে মাসের পর মাস কয়েদ করে রাখা হয় তাঁদের। আউটসোর্সিং কোম্পানি এবং বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি অসাধু এজেন্টদের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এই ৫৫ হাজার শ্রমিকের কতজনের যে সুনিশ্চিত চাকরি আছে সে বিষয়ে সবাই সন্দিহান। আমরা সরেজমিনে গিয়ে কথা বলেছি সেখানে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধি ও স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সঙ্গে। সবাই এই নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিশ্বমন্দার এই সময়ে প্রায়-চাকরিহীন মালয়েশিয়ার বাজারে যেখানে অবস্থানরত পাঁচ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের একটা বড় অংশ অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, সেখানে নতুন করে আরও ৫৫ হাজার শ্রমিককে ঠেলে দেওয়া যত না জনশক্তি রপ্তানি হবে, তার চেয়ে বেশি হবে মানব পাচার। কার স্বার্থে সেটা?
এ প্রশ্নকে সামনে রেখেই এগোতে হবে। সরকারকে জানতে হবে কোন ধরনের চুক্তির অধীনে এসব শ্রমিকের নিয়োগ হয়েছে? আদৌ এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে কি না। বিদেশ গিয়ে কাজ করার আশায় এসব মানুষ আর কত দিন দ্বারে দ্বারে ঘুরবেন? যদি নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে, তবে তাঁদের বিনিয়োগের টাকা ফেরত দেওয়া হবে কবে? বায়রার এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিদেশে শ্রমিক নিয়োগের প্রায় ৭০ শতাংশই সেসব দেশে অবস্থানরত কিছু বাংলাদেশি এজেন্টদের তৎপরতার মাধ্যমে হয়ে থাকে। এরা কারা? এদের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাবান লোকদের কী সম্পর্ক? জনশক্তি রপ্তানি জিনিসটাকে একটি অসাধু মাফিয়াচক্র দিন দিন মানব পাচার বা হিউম্যান ট্র্যাফিকিংয়ের সমার্থক বানিয়ে ফেলছে। এই দশা থেকে উদ্ধার পেতে হলে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে প্রবাসে শ্রমিক নিয়োগের প্রতিটি প র‌্যায়ে। মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত করতে হবে এই প্রক্রিয়াকে, সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে একেবারেই যে জবাই করে ফেলছে অল্প কিছু লোভী মানুষ!
সুমন রহমান: সাহিত্যিক, গবেষক। এ কে এম মোহসীন: সাংবাদিক, সম্পাদক বাংলার কণ্ঠ।
sumanrahman@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.