রাখাইন তাঁতের ঠক ঠক by রহমান আরিফ

তাঁতে কাপড় বুনন রাখাইনদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হস্তচালিত তাঁতশিল্পকে পেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরে বরগুনার রাখাইন সম্প্রদায় বেঁচে আছে। প্রতিটি পরিবারের নারী সদস্যরা তাঁতে কাপড় বুনে নিজস্ব পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাকি কাপড় বাজারে বিক্রি করে উপার্জনের পথ ধরে রেখেছেন। রাখাইন তাঁতশিল্প লাভজনক পেশা হওয়া সত্ত্বেও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে প্রতিনিয়ত এর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তাঁতশিল্প রাখাইনদের ঐতিহ্যপূর্ণ জাতিগত পেশা। অনেক রাখাইন পরিবারে হস্তচালিত পুরোনো তাঁত রয়েছে। তাঁতে রাখাইন তরুণী ও নারীরা তাঁদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টি অনুযায়ী নানা রঙের, নানা ধরনের কাপড় বুনে থাকেন। প্রথমত, তাঁরা নিজস্ব পরিবারের জন্য লুঙ্গি, চাদর, থামি, বিছানার চাদর প্রভৃতি তৈরি করে নিজেদের অভাব পূরণ করে থাকেন। আর বাইরে বিক্রি করার জন্য অবশিষ্ট সময় তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করে কাপড় বোনার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তবে পুরুষেরা প্রস্তুতকৃত পণ্যগুলো বাজারজাত করে অর্থ উপার্জন করে থাকেন।
তাঁতশিল্প রাখাইনদের অর্থনীতিতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। অতীতে রাখাইনদের তৈরি রেশমি লুঙ্গি ছিল যথেষ্ট প্রশংসিত পণ্য। কিন্তু বর্তমানে সুতার অভাবে রেশমি লুঙ্গি বয়ন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
হস্তচালিত তাঁতশিল্পে উত্পাদিত লুঙ্গি, চাদর, ব্যাগ, রুমাল, উলের শার্ট পিস প্রভৃতির যথেষ্ট চাহিদা থাকলেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে রাখাইনরা সফলতা অর্জন করতে পারছে না।
তালতলী রাখাইন অঞ্চলের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা মং তাহান বলেন, ‘কতগুলো সমস্যার সামাধান হলে আমাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প ধরে রাখতে পারব। এগুলো হচ্ছে, তালতলীতে রাখাইন তাঁতিদের জন্য একটি স্থায়ী সেমি-অটোমেটিক (এসএ) তাঁত বুনন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও উত্পাদন কেন্দ্র স্থাপন করা; রাখাইন তাঁতিদের জন্য এসএ তাঁত বুনন এবং রি-অ্যাকটিভ ও ভেজিটেবল রংকরণে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; এসএ তাঁত স্থাপন করার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাঁতিদের তাঁত ও সুতা কেনার জন্য সহজ শর্তে প র‌্যাপ্ত পরিমাণ ঋণ প্রদান করা; রাখাইন তাঁতিদের জন্য সুতা ও রং ন্যায্যমূল্যে পাওয়ার ব্যবস্থা করা; রাখাইন তাঁতিদের তৈরি বস্ত্র যথাযথ বাজারমূল্যে বিক্রয়ের জন্য নিশ্চিয়তা প্রদান করা; বরিশাল টেক্সটাইল মিলস থেকে রাখাইন তাঁতিদের জন্য বরাদ্দ সুতার ব্যবস্থা করা; রাখাইনদের জন্য বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড থেকে একজন তাঁত প্রশিক্ষক সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োগ করা।
মেয়েদের তাঁতে কাপড় বোনাকে জাতিগত গুণ বলে গণ্য করা হয়। বিয়ের সময় এই গুণ অনেক কাজে দেয় বলে জানা যায়। যে মেয়েটি কাপড় বোনার কাজে যত বেশি দক্ষ ও পারদর্শী, বরপক্ষ তার সঙ্গে তাদের ছেলে বিয়ে দিতে ততই আগ্রহী। কেননা, সে পরিবারের ভরণপোষণের আর্থিক সমস্যা দূরীকরণে সাহায্য করতে পারবে।
রাখাইন পরিবারে তাঁতে কাপড় বুনতে জানে না এমন মেয়ে বিরল। মা বা পরিবারের বয়স্ক নারীরা পরিবারের কিশোরীকে সংসারের দেখাশেনার কাজের সঙ্গে সঙ্গে তাঁত বোনার কাজ শিক্ষা দিয়ে তাদের পারদর্শী করে তোলেন।
বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার তালতলী এলাকায় ৪৪টি পাড়া রয়েছে। এখানে এক হাজার ৩৮০টি পরিবার, বরগুনা সদর উপজেলার বড় বালিয়াতলী এলাকায় নয়টি পাড়ায় ৩৯০টি পরিবার বসবাস করছিল। বর্তমানে অভাব-অনটন ও নানা সামাজিক অসুবিধার কারণে রাখাইন পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। বর্তমানে তালতলী এলাকায় ১৪টি পাড়ায় ২৬৪টি পরিবার ও বালিয়াতলী পাড়ায় একটিতে ২৬ পরিবার বসবাস করছে।
তালতলীর মুনখেপাড়ার মায়েমেন রাখাইন বলেন, ‘আমরা বেশি লেখাপড়া করতে পারি না বলে ভালো চাকরিও পাই না। এ জন্য তাঁতের কাপড় বুনে বাড়তি আয়ের দিকে মনোযোগী হই। এ শিল্পের বিকাশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।’

No comments

Powered by Blogger.