বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ- সরল গরল by মিজানুর রহমান খান

আমরা বিস্মিত, আমরা স্তম্ভিত। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ে বিপুলসংখ্যক বিচারকের অস্বাভাবিক উপস্থিতি ও আর্মড পুলিশ দিয়ে দেহ তল্লাশিসংক্রান্ত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত আমরা চেয়েছিলাম। কারণ, বিচারক বা যিনিই হোন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নন। বিচারকদের কাছে মানুষ সকল পরিস্থিতিতে সংযম ও পরিমিতিবোধ আশা করে। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্ত ও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়াই জেলা জজ মো. অবদুল গফুর ও মো. শাহজাহানকে অস্বাভাবিক পন্থায় চরম শাস্তি দেওয়া হলো। এই আদেশ সংবিধান ও আইনের চোখে অবৈধ, এখতিয়ারবহির্ভূত ও বাতিল কি না, তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে।
আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ হয় সংবিধানের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, নাহয় তাঁর উদ্ধৃতি পত্রিকায় ঠিকভাবে ছাপা হয়নি। তবে আপাতত তাঁর অভিমত জেনে মনে হয়েছে, তিনি যেন চতুর্থ সংশোধনী বহাল থাকা বাকশাল মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, জেনারেল জিয়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতার একটু মুখরক্ষা করেছিলেন! আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সংবিধান সর্বোচ্চ আইন। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ ব্যবস্থা নিয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলে সে ক্ষেত্রে অন্য আইন বা বিধিবিধানে যা কিছুই থাক না কেন, তা প্রযোজ্য হয় না। কারণ, সংবিধান সবকিছুর ওপরে।’ (প্রথম আলো, ৩১ জুলাই)। আইনমন্ত্রী যে ভুল মন্তব্য করেছেন, তা বোঝার জন্য আপনাকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। ১১৬ অনুচ্ছেদের বিবর্তন লক্ষ করুন।
বাহাত্তরের মূল সংবিধানে লেখা ছিল: ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল-নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটি-মঞ্জুরীসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকিবে।’ চতুর্থ সংশোধনীতে এই বাক্যে ‘সুপ্রিম কোর্টের’ স্থলে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দ বসানো হয়। লক্ষ্য ছিল, বিচারকদের ওপর নির্বাহী বিভাগের খবরদারি প্রতিষ্ঠা করা। জিয়া ও পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী নানা কলাকৌশলে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহতভাবে বজায় রাখে।
কয়েক দিন ধরে ভাবছিলাম, জেনারেল জিয়ার সমালোচনা করে একটি কঠিন লেখা লিখব। এসব কথা বলতে গিয়ে নিজেকে কখনো সং মনে হয়। কারণ, সমালোচনা বাদ দিয়ে এখন তাঁরই প্রশস্তি গাইতে হচ্ছে। এখন দেখছি, এ সরকার তাঁকেও টেক্কা দিচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টকে আর লাগছেই না। মাসদার হোসেন মামলায় বিচারপতি মোস্তাফা কামাল লিখেছিলেন, ‘অধস্তন আদালত ব্যবস্থাপনায় একটি ডায়ারকি বা দ্বৈত শাসন চলছে। আদালত ও ট্রাইব্যুনালগুলোর তদারকি ও নিয়ন্ত্রণভার হাইকোর্ট বিভাগের কাছে এবং সেখানে কর্মরত বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত।’ বিদ্যমান এই যে জগাখিচুড়ি অবস্থা, এর জনক জেনারেল জিয়া। কারণ, তিনি ধূর্ততার সঙ্গে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের পদানত রেখে যান। ১৯৭৮ সালে এক সামরিক ফরমান দিয়ে ১১৬ অনুচ্ছেদে এক অদ্ভুত সংশোধনী এনে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শের একটি সড়ক তৈরি করেন; যদিও এই পরামর্শ বা কনসালটেশন অর্থ এই নয় যে সরকার তা অবশ্যই মানতে বাধ্য থাকবে। এরপর মাসদার হোসেন মামলার রায় দিয়ে এটুকু উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা চলে যে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে সুপ্রিম কোর্টের মতামতই প্রাধান্য পাবে।
আমরা আজ একি দেখলাম? সর্বজনীন প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল জাস্টিসেরও আজ বিসর্জন ঘটল। অন্তত পাঁচটি কারণে দুই জেলা জজকে অবসরদানের আদেশ প্রশ্নসাপেক্ষ, যা আদালতে রিটের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জযোগ্য।
প্রথমত, ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো বিচারককে অপসারণ বা অবসর যাই দেওয়া হোক, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতেই হবে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আওয়ামী লীগের বিগত আমলের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, ‘সরকারের জন্য এই পরামর্শ গ্রহণ ম্যান্ডেটরি বা বাধ্যতামূলক। যদি সুপ্রিম কোর্টের পারামর্শ ছাড়া কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা ভয়েড বা বাতিল বলে গণ্য হবে।’ (কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ, পৃ. ৬৬৮)। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ বনাম ইদ্রিসুর রহমান মামলায় আপিল বিভাগ ওই অভিমত দেন।
উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের বিষয়ে প্রথম আলোর ৩১ জুলাইয়ের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে ‘সংশ্লিষ্ট একজন বিশেষজ্ঞ’ অবলীলায় মনের মাধুরী মিশিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটি শৃঙ্খলামূলক কোনো ব্যবস্থা নয়। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চাকরির ২৫ বছর পূর্ণ হলে যেকোনো গণকর্মচারীকে চাকরি থেকে জনস্বার্থে অবসর দিতে পারেন।’ অথচ ওই প্রতিবেদনেই সিসিটিভির সাহায্যে তথাকথিত বিক্ষোভকারীদের শনাক্তকরণের কথা আছে। বলা আছে, ‘জনপ্রশাসনে সদাচরণ ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে’ দুজন জেলা জজকে অবসর দেওয়া হয়েছে বলে সরকারি আদেশেই উল্লিখিত হয়েছে। এ ছাড়া ১১৬ অনুচ্ছেদের বরাতে তথাকথিত ওই বিশেষজ্ঞর দাবি অবান্তর।
দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পর সংবিধানের ১১৫ ও ১৩৩ অনুচ্ছেদের আওতায় বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলাবিধান এবং চাকরির অন্য শর্তাবলি) বিধিমালা-২০০৭ প্রণয়ন করা হয়। এর ৬ ধারায় বলা হয়েছে, জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যদের সাময়িক বরখাস্তকরণ, বরখাস্তকরণ ও অপসারণ ব্যতীত শৃঙ্খলাসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে আলাদা বিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সরকারের একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য গভর্নমেন্টস সার্ভেন্টস (ডিসিপ্লিন অ্যান্ড আপিল) রুলস-১৯৮৫-এর বিধানাবলি প্রযোজনীয় অভিযোজনসহকারে সার্ভিসের সদস্যদের শৃঙ্খলা বিধান করবে। সুতরাং রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টকে না জানিয়ে দুজন বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ১১৫ অনুচ্ছেদের আওতায় তাঁরই জারি করা বিধি লঙ্ঘন করেছেন। তাই আইনের চোখে রাষ্ট্রপতির ৩০ জুলাইয়ের আদেশ তাঁরই জারি করা বিধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে প্রতীয়মান হয়। ১৯৮৫ সালের বিধিতে শৃঙ্খলাজনিত কারণে কোনো দোষী ব্যক্তির শাস্তি কিন্তু বাধ্যতামূলক অবসর লেখা আছে। তাহলে সে নিয়ম মানতে বাধা ছিল কি?
তৃতীয়ত, জেলা জজদের নিছক সরকারি কর্মকর্তা ভাবা হয়েছে। ধরে নেওয়া হয়েছে, তাঁরা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের আওতাভুক্ত। এ কারণেই তারা হয়তো সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেয়নি। ১৯৯৯ সালের আগে স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল সার্ভিস স্বীকৃত ছিল না। তাদের বলা হতো বিসিএস জুডিশিয়াল ক্যাডার। আপিল বিভাগ বলেন, বিচারকদের চাকরির শর্তাদি ও ম র‌্যাদা অবশ্যই হবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। কোনো অবস্থায়ই অন্য কোনো ক্যাডারের সঙ্গে সমান্তরাল, একীভূত বা সমন্বিত করা যাবে না। বিচারপতি মোস্তাফা কামাল লিখেছেন, এই মনোভাব একটা সাংবিধানিক রূপকথা। এটা করে নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর কথায়, এটি একটি monumental constitutional blunder বা বিশাল সাংবিধানিক বিপর্যয়, যা দেশের স্বাধীনতার গোড়ার বছরগুলোতেই করা হয়েছে। সেই বিপর্যয়ের ভূত আমরা আজও তাড়াতে পারিনি। বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতায় নির্বাহী বিভাগের নগ্ন হস্তক্ষেপ ফুটে উঠেছে।
চতুর্থত, আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭৪ সালের যে আইনটি বিচারকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, সেটি একটি কালাকানুন। আকবর আলি খানের নেতৃত্বে গঠিত রেগুলেটরি কমিশন ওই আইনের ৯(২) ধারা সংশোধনীর সুপারিশ করেছে। এ আইনে বাধ্যতামূলক অবসর সম্পর্কে ‘অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র’ শীর্ষক একটি বিখ্যাত মামলা রয়েছে। ১৯৮০ সালের দিকে তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তিনি তা চ্যালেঞ্জ করেন। আপিল বিভাগ তাঁকে চাকরি ফিরিয়ে দেন। বিচারপতি রুহুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান একটি শাস্তি। তাই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নোটিশ দিতে হবে। তাঁকে শুনতে হবে।’ এই রায় পরে আর উল্টে গেছে বলে জানা যায় না। মাহমুদুল ইসলাম লিখেছেন, এই উপমহাদেশের আদালতের মতের প্রাধান্য হলো নিছক বাধ্যতামূলক অবসর শাস্তি নয়। কিন্তু শাস্তি হিসেবে অবসর দেওয়া হলে, তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করা হলে সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাঁকে নোটিশ দিতে হবে। (পৃ.৭১৪)
পঞ্চমত, ১৯৭৪ সালের সরকারি কর্মচারী (অবসর) আইন ১৭০১ সালের অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্টের পরিপন্থী। আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা ইংলিশ কমন লর ওপর দাঁড়ানো। এ থেকে ছিটকে পড়লে কারও সাধ্য নেই নৈরাজ্য ঠেকায়। ১৭০১ সালের আইনেই প্রথম রাজা বা রানির সন্তুষ্টি পর্যন্ত মেয়াদে বিচারকের পদে বহাল থাকার দিনের অবসান ঘটে। এই ক্ষমতা দেওয়া হয় সংসদকে। কানাডার সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৫ সালে ওয়াল্টার ভেলেন্তি বনাম হার ম্যাজেস্টি দ্য কুইন মামলায় বিচারকদের চাকরির মেয়াদের সুরক্ষাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে লেখা হয়, এই অভিমত আমরা বাংলাদেশেও গ্রহণ করলাম। একটি লেখা মনে পড়ছে, অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট পাস হওয়ার কিছুদিন আগে রানি অ্যান সিংহাসনে বসেছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি দুজন বিচারককে অপসারণ করেন।
পরিহাস হলো, বিচারকদের বিক্ষোভ নিয়ে খবরের কাগজে বড় করে শিরোনাম ছাপা হয়েছিল। মনে হয়েছিল, সচিবালয়ে সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবারের এই সাংবিধানিকভাবে অসংগতিপূর্ণ পদক্ষেপের দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.