বৃষ্টির কারণে টিপাইমুখে নামতে পারেনি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল by ইফতেখার মাহমুদ

ভারতের মণিপুর রাজ্যের টিপাইমুখ এলাকায় মুষলধারে বৃষ্টি পড়ায় হেলিকপ্টার থেকেই টিপাইমুখ দেখে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে প্রতিনিধিদল টিপাইমুখে নামতে পারেনি। বৃষ্টি কমলে ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা আজ ভোরে আবার টিপাইমুখের উদ্দেশে রওনা হবেন।
গতকাল শুক্রবার ভোরে বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধিদলটি হেলিকপ্টারে করে গুয়াহাটি থেকে টিপাইমুখের পথে রওনা হয়। সেখানকার স্থানীয় জনগণ ও প্রকল্প কর্মকর্তারা দলটিকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু বৃষ্টির কারণে বেশ কিছুক্ষণ মণিপুরের আকাশে বিচরণ করে দুপুর নাগাদ হেলিকপ্টারটি গুয়াহাটিতে ফিরে আসে।
বাংলাদেশ দলের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক আজ আবার টিপাইমুখের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তকে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প র‌্যালোচনা করা হবে। প র‌্যালোচনা শেষে এ প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক করা হবে।
সংসদীয় প্রতিনিধিদল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যানের (ফ্যাপ) আওতায় টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হলে কী ধরনের প্রভাব বাংলাদেশ পড়তে পারে, তা নিয়ে একটি গবেষণা হয়। গবেষণায় বলা হয়, বরাক নদের ওপর বন্যানিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো ও বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং লাভ হবে। ব্যারাজ নির্মাণ করা হলে ক্ষতির আশঙ্কার কথা সমীক্ষায় বলা হয়েছিল। মূলত এই গবেষণার আলোকেই ভারতের দেওয়া তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করা হবে। ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সব প্রস্তুতি শেষ করে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা শেষে তারা প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু করবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রকল্পের ব্যাপারে কোনো আপত্তি থাকলে তা বিবেচনায় নেওয়ার জন্য ভারত সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ যদি প্রকল্পটি থেকে উত্পাদিত বিদ্যুৎকিনতে চায় তা বিবেচনা করা হবে।
ভারত সরকারের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশ যদি প্রকল্পটি নির্মাণে সহযোগিতা করে ও আপত্তি না জানায়, তাহলে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎকেনার সুযোগ দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হবে।
বিএনপির সংশয়: সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিনের মতে, ভারত বাংলাদেশের সংসদীয় প্রতিনিধিদলকে যে তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হওয়ার কিছু নেই। ১৯৭৮ সালে তৎকালীনরাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ তথ্য-উপাত্ত ভারতের কাছ থেকে চেয়েছিলেন। তখন ভারত তা দেয়নি। এত বছর পর যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাও সংক্ষেপিত ও যথেষ্ট নয়।
ব্যারাজ নির্মাণ না করার আশ্বাসের ব্যাপারে বিএনপির এই নেতা গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৫ সালে যৌথ নদী কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও ভারতের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে ফুলেরতলে ব্যারাজ নির্মাণ না করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তার পরও নিপকোর (নর্থ ইস্ট পাওয়ার করপোরেশন) ওয়েবসাইটে প্রকল্পের যে পরিবেশ সমীক্ষা প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তাতে ফুলেরতলে ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ড্যাম নির্মাণের পর বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পানি বেশি পাবে বলে ভারতের পক্ষ থেকে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের লাভ হবে না বলে মনে করেন তিনি।
যৌথ ব্যবস্থাপনা চান আইনুন নিশাত: টিপাইমুখ প্রকল্প বিষয়ে ভারত সরকারের দেওয়া তথ্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে পানিবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বাংলাদেশ সরকারকে আরও সাবধানে এগোনোর পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, বরাক নদ থেকে বাংলাদেশ কী পরিমাণ পানি পাবে, তা ভারতকে নির্ধারণ করতে দেওয়া ঠিক হবে না। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ বেশি না কম পানি পাবে, তা অভিন্ন সমীক্ষা না করে বোঝা যাবে না।
আইনুন নিশাত গতকাল প্রথম আলোকে আরও বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বরাক নদের ওপর যৌথ ব্যবস্থাপনায় বন্যানিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এখন ভারত বলছে, তারা ড্যাম নির্মাণের সব সমীক্ষা ও প্রস্তুতি শেষ করেছে। ভারতের অধিকার নেই ভাটির দিকে থাকার সুযোগ নিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করা।
বরাকসহ সব অভিন্ন নদীতে যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে হলে প্রথমে যৌথ সমীক্ষা করতে হবে। এরপর আলোচনার মাধ্যমে যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন আইনুন নিশাত। তাঁর মতে, তা না হলে উজানের দেশ সব সময় পানি প্রত্যাহারের সুযোগ পাবে। অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব বাংলাদেশের দিক থেকে তোলার সুপারিশ করেন তিনি।
শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ বেশি পানি পাবে বলে ভারতের দিক থেকে যে কথা বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে বেশি পানি দরকার নেই। কেননা এ সময় হাওরের প্রধান ফসল বোরোর চাষ হয়। এ মৌসুমে বাংলাদেশের কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন, তা নিয়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। ফলে আগের চেয়ে বেশি পানি এলে দেশের বেশির ভাগ হাওরে জলাবদ্ধতা হবে। ধান চাষ করা যাবে না।
ভারতের বিশিষ্ট পানিবিশেষজ্ঞ বি জি ভার্গিস টিপাইমুখ প্রকল্পসহ অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, নদীর ওপর যেকোনো বড় অবকাঠামোই পরিবেশগত সমস্যা তৈরি করবে। ফলে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হতে পারে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে। ভারতের হিসেবে বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পানি বেশি পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এতে বাংলাদেশে কৃষির কিছুটা ক্ষতি হলেও পানি বেশি আসায় মাছের পরিমাণ বাড়বে।

No comments

Powered by Blogger.