কথা রেখেছেন আট ‘অদম্য মেধাবী’

আট অদম্য মেধাবী
অঙ্গীকার পূরণ করে আবার চমক দেখিয়েছেন আট ‘অদম্য মেধাবী’। এইচএসসি পরীক্ষায়ও তাঁরা জিপিএ-৫ পেয়েছেন। ২০০৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পান তাঁরা। তাঁদের দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতার বাধা ডিঙিয়ে সাফল্য পাওয়ার কথা যখন প্রথম আলোয় ছাপা হয়, প্রত্যেকেই বলেছিলেন, আর্থিক সহায়তা পেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। অঙ্গীকার করেছিলেন, এইচএসসিতেও তাঁরা ভালো ফল উপহার দেবেন। গত দুই বছর প্রথম আলোর সহায়তায় পড়াশোনা চালিয়ে যান তাঁরা, পৌঁছে যান কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। শোনা যাক তাঁদের শিক্ষক, অভিভাবক ও নিজ নিজ অনুভূতির কথা।
তানজিলা খাতুন: রাজশাহীর বাঘার সোদপুর গ্রামের দিনমজুর ওমর আলীর মেয়ে তানজিলা। এবার মোজাহার হোসেন মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। কলেজের অধ্যক্ষ এনামুল হাসান বলেন, ‘মেয়েটি যে পরিবেশে পড়াশোনা করেছে, তা সত্যি অকল্পনীয়। কলেজের পক্ষ থেকে তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। পড়াশোনার সুযোগ পেলে মেয়েটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
তানজিলার কথা, প্রথম আলোর পক্ষ থেকে নিয়মিত যে আর্থিক সহায়তা তিনি পেয়েছেন, তা দিয়ে বইপত্র কেনাসহ পড়াশোনার খরচ চালিয়েও পড়ার জন্য চেয়ার-টেবিল কিনেছেন। এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে ইচ্ছুক। এ ব্যাপারে তাঁর আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। তাঁর ইচ্ছা আইন বিষয়ে পড়ে বিচারক হওয়া।
রাশেদুল ইসলাম: দুপচাঁচিয়ার তালোড়া লাফাপাড়া গ্রামের রিকশাচালক ইয়াকুব আলীর ছেলে রাশেদুল। তালোড়া সরকারি শাহ এয়তেবারিয়া কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। অধ্যক্ষ দেবাশীষ রঞ্জন রায় বলেন, ‘পড়াশোনার খরচ চালানোর সামর্থ্য ছিল না তার পরিবারের। প্রথম আলোর সহায়তা তাকে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে উত্সাহিত করে। আমরাও তাকে সহযোগিতা করেছি।’
রাশেদুলের বাবা বলেন, “আপনাকেরে প্রথম আলো পেপার হামার ছলের লেকাপড়ার খরচ না দিলে কলেজে ছলের লেকাপড়া করান গেলোনানি। আপনাকেরে সাহায্য লিয়্যা হামার ছল আবার ‘এ’প্লাস পাচে। হামার যে কী ভালো লাগিচ্চে, সেডা কওয়ার মতো লয়।” উচ্চশিক্ষা নিয়ে রাশেদুল দেশের সেবা করতে ইচ্ছুক।
রেনু ফাতেমা: রংপুর সদর উপজেলার বাহারকাছনা গ্রামের দিনমজুর আব্দুল কুদ্দুসের মেয়ে রেনু ফাতেমা। বেগম রোকেয়া সরকারি মহিলা কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে তিনিই একমাত্র এ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। অধ্যক্ষ রিজিয়া খাতুন বলেন, রেনু কলেজের মুখ উজ্জ্বল করেছে।
মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে নিজের কৃতিত্বের খবর জানাতে গিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন রেনু। বলেন, প্রথম আলো সহায়তা না করলে হয়তো বা তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া হতো না। ভবিষ্যতে শিক্ষক হয়ে গ্রামের হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিনা খরচে পাঠদানের ইচ্ছা আছে তাঁর। বাবা কুদ্দুস বলেন, ‘নিজে খাবার পাই না, ছাওয়াক ফির কেমন করি লেখাপড়া শিখাই। হামার ছাওয়াক তো প্রথম আলোই পড়াশোনা করাইল।’
দীপক কুমার: জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার হারুঞ্জা গ্রামের দরিদ্র বাদাম বিক্রেতা সুশীল চন্দ্রের ছেলে দীপক কুমার। জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কলেজের অধ্যক্ষ হাবিবুল্লাহ মিঞা বলেন, দীপকের এ ফলাফলে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই গর্বিত ও আনন্দিত।
স্থানীয় হাটবাজারে বাদাম বিক্রি করে ওই টাকায় পড়াশোনা করে এসএসসিতে একই ফল অর্জন করেন দীপক। জানান, আর্থিক দৈন্যের কারণে তাঁর কলেজে ভর্তি হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় পাশে এসে দাঁড়ায় প্রথম আলো। পাশাপাশি যমুনা ব্যাংক এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কুতুব উদ্দিন আহম্মেদও তাঁকে সহায়তা দেন। দীপক ভবিষ্যতে চিকিৎসক হয়ে বিনামূল্যে গরিব-দুখীর সেবা করতে ইচ্ছুক।
সুভদ্রা রায়: রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর কালিবাড়ি গ্রামের দরিদ্র কৃষক হলধর রায়ের মেয়ে সুভদ্রা রায়। পার্বতীপুর ক্যান্ট. পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সুভদ্রা বলেন, “পরীক্ষার ফল প্রকাশের কথা শুনে ওই দিন সকাল থেকেই কাঁদছিলাম। যদি ভালো ফল করতে না পারি, তাহলে প্রথম আলোসহ যাঁদের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা করলাম, তাঁরা কী মনে করবেন। কান্নাকাটি দেখে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘মা রে, তুই কোনোটে আটকিবু না’।”
ওই দিন দুপুরে কলেজের প্রভাষক মানচিত্র কুমার পাল তাঁকে ফোন করে বলেন, ‘এবার কলেজের মানবিক বিভাগে ৪৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র একজনই জিপিএ-৫ পেয়েছে। আর সেই ভাগ্যবতী ছাত্রীটি তুমি।’ সুভদ্রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে চান।
আনোয়ারুল কাদির: ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার গাবরবোয়ালি গ্রামের মৃত সেকান্দর আলীর ছেলে মো. আনোয়ার কাদির। ময়মনসিংহ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে ব্যবসা শিক্ষা বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ইটের ভাটায় মজুরি খেটে আনোয়ার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। প্রভাষক মফিজুন নূর বলেন, সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে সে আরও ভালো করবে। আনোয়ারের মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ওর ফলাফলে আমি খুব খুশি।’ আনোয়ারের কথা, এইচএসসিতে ভালো ফল করে প্রথম আলোকে দেওয়া কথা রেখেছেন তিনি। প্রথম আলো ছাড়াও এই ভালো ফল লাভের পেছনে তাঁকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুলতান স্যার ও মফিজুন নূর বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন। ভবিষ্যতে তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হতে চান।
মিনতি খাতুন: সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার নতুন ভাঙ্গাবাড়ী গ্রামের দরিদ্র কৃষক নূর মোহাম্মদ খানের মেয়ে মিনতি খাতুন। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘সংসারে অনেক ছেলেমেয়ে। মিনতিকে তেমন জোগান দিতে পারিনি। ও নিজের চেষ্টাতেই এত দূর এগিয়েছে।’
মিনতির কথা, প্রথম আলোর পাশাপাশি শিক্ষকেরাও তাঁকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চান তিনি।
আমির হামজা: মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের রিকশাচালক শাহজালাল মিয়ার ছেলে আমির হামজা। ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ছাত্র হিসেবে আমির হামজা সত্যিই এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তিনি ও তাঁর দুই সহকর্মী আমির হামজাকে বিনা টাকায় পড়িয়েছেন।
আমির জানান, এসএসসিতে ভালো ফল করার পর প্রথম আলো ও কিছু ব্যক্তির আর্থিক সহযোগিতায় ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি নতুন উদ্যমে পড়ালেখা শুরু করেন। শিক্ষকদের উত্সাহ, সহযোগিতা ও তাঁর নিজের কঠোর অনুশীলনে এই ফল অর্জিত হয়। ভবিষ্যতে তিনি প্রকৌশলী হতে ইচ্ছুক।
বাবা শাহজালাল ও মা রাবেয়া খাতুন বলেন, এত দিন আমির নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করলেও তাঁর ভবিষ্যৎ শিক্ষার ব্যাপারে তাঁরা কিছুটা চিন্তিত। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা কামনা করেন তাঁরা।
আরও যাঁরা সফল হলেন: এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া আরও ১৩ জন ‘অদম্য মেধাবী’ প্রথম আলোর সহায়তায় দুই বছর পড়াশোনা করে এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করেছেন। তবে তাঁরা জিপিএ-৫ পাননি। তাঁরা হলেন ঢাকার বদরুন্নেছা কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে মাদারীপুরের শিবচরের মিরা রানী মালো, ঝিনাইদহ সরকারি কে সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পরীক্ষা দেওয়া ঝিনাইদহ সদরের রিজভী আহম্মেদ, পাবনার বেড়া মনজুর কাদের মহিলা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে বেড়ার খাদিজা খাতুন, পঞ্চগড়ের এম আর সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পঞ্চগড় সদরের আনিসুর রহমান, মুন্সিগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে টঙ্গিবাড়ির সজিব আহমেদ, যশোরের কেশবপুর কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে কেশবপুরের মেহেদি হাসান, খুলনার বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে রূপসার পুতুল রানী ঘোষ, ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ঠাকুরগাঁও সদরের আফসানা মল্লিক, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সদর উপজেলার আনোয়ার হোসেন, ঢাকার বোরহানউদ্দিন কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে কুড়িগ্রামের উলিপুরের শাহজাহান আলী, নওগাঁ সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সদর উপজেলার শেহতাজ সাদমানী, জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে কালাইয়ের নূপুর কুমার ও ঢাকার উদয়ন কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ঢাকার সোবহানবাগের সেঁজুতি সনিমা।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহী, ঝিনাইদহ ও রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক; সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ময়মনসিংহ অফিস এবং নওগাঁ, দুপচাঁচিয়া (বগুড়া), কালাই (জয়পুরহাট), ঈশ্বরগঞ্জ (ময়মনসিংহ), গজারিয়া (মুন্সিগঞ্জ), শিবচর (মাদারীপুর) ও বদরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি]

No comments

Powered by Blogger.