বাবাকে খুঁজছে তাসফিয়া by ফাহিমা আক্তার সুমি

ছোট্ট শিশু তাসফিয়া। সাড়ে ৪ বছর বয়স। নীরবে খুঁজে ফিরছে বাবাকে। জানার চেষ্টা করছে তার বাবা কোথায়? দু’বছর আগে শিশুটির মা ইতি ইসলাম মারা যান। এরপর  থেকে অবুঝ শিশুটি বাবার কোলেই ঘুমাতো। প্রাণচাঞ্চল্যতায় মাতিয়ে রাখতো ঘর। মায়ের মৃত্যুর পর শিশুটির বাবাই ছিল একমাত্র ভরসাস্থল। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে হারাতে হলো বাবাকেও। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ৫ই আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় বের হয়েছিলেন তাসফিয়ার বাবা বাপ্পী আহমেদ। এরপর থেকে আর বাসায় ফেরেননি তিনি। পরিবারের সদস্যরা রাতভর খোঁজাখুঁজি করে পাননি তাকে। পরদিন সকাল থেকে হাসপাতালের মর্গে মর্গে বাপ্পীর খোঁজে ছুটেছেন স্বজনরা। সেখানেও মেলেনি তার সন্ধান। পরে ওইদিন দুপুরের পর হাতিরঝিলে খোঁজ মেলে বাপ্পীর নিথর দেহ। তার শরীরে ছিল ছররা গুলির চিহ্ন।

শিশু তাসফিয়া কখনো বাবার রুমে দৌড়ে যাচ্ছে, আবার কখনো অ্যালবাম বের করে বাবার ছবি দেখছে। মায়ের মৃত্যুর সময় কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও বাবার অভাবটি বুঝতে পারছে। তাসফিয়া বলে, বাবা কোথায়? বাসায় আসেনা কেন? বাবাকে খুব মনে পড়ে। সবার বাবা বাসায় আমার বাবা কোথায়। এসব সারাক্ষণ বাপ্পীর বাবা-মা ও বোনের কাছে বলতে থাকে তাসফিয়া। তখন তার জন্য খেলনা আনতে ভারতে গেছেন বলে শান্ত্বনা দিয়ে রাখেন। বাপ্পীর বাবা শহিদ উদ্দিন সৌদিতে থাকেন। বাপ্পী পড়াশোনার জন্য ৪ বছর যুক্তরাজ্যে ছিলেন। মিরপুরের পল্লবীতে তাদের বাড়ি। সেখানে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন। একমাত্র মেয়েকে সময় দিতে চাকরি ছেড়ে শুরু করেছিলেন ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ।

বাপ্পীর মা সুরাইয়া বেগম মানবজমিনকে বলেন, আমার ছেলেটি খুব শান্তসিষ্ট ছিল। কারও সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক কিছুই করতো না। ঘরে থাকতো কম্পিউটার চালাতো। ৫ই আগস্ট রাত সাড়ে ১০টায় বের হয়ে আর ফেরেনি। হাতিরঝিলে লাশ পড়ে ছিল আমার সন্তানের। ৫ই আগস্ট দুপুরে বের হয়ে আনন্দ মিছিলে যায় সেখান থেকে সন্ধ্যা ৬টার সময় এসে ভাত খায়। আমার সন্তান ওইদিন শেষ খাবার খেয়েছে আমার হাতের। সারারাত ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না। আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।

রাজধানীর কমার্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছিলেন বাপ্পী। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যে যান। সেখান থেকে ২০১৩ সালে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর বাপ্পীকে বিয়ে দেন বাবা-মা। ২০১৯ সালে তাদের কোল জুড়ে আসে একমাত্র সন্তান তাসফিয়া। এরপর কয়েকটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। পরবর্তীতে মেয়েকে সময় দিতে বাসায় বসে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ শুরু করেন। খুব ভালো সময় কাটছিল পরিবারের সঙ্গে। বাপ্পীর বোন উমাইমা বলেন, ভাবী মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেনি ভাইয়া। পরে সব চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ করতো অনলাইনে। বাবাকে সংসারে সাহায্যে করতো। নিজের বাচ্চার খরচ চালাতো, মায়ের মেডিসিনের খরচ দিতো। আমার বাবা এখন দেশে একটা কোম্পানিতে কাজ করে। আমার ভাই বাবা-মায়ের ও মেয়ের শেষ বয়সের ভরসা ছিল। স্বপ্ন ছিল আগামী বছর মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাবে।

তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় যখন ইন্টারনেট বন্ধ ছিল তখন আমার ভাই বলতো বাইরে কি যে হচ্ছে চল একটু দেখি আসি। আমার খালাতো ভাইয়েরও বুলেট লাগে বাম পায়ে। ১৯শে জুলাই আড়াইটার সময় মিরপুরের ঘটনা ছিল এটি। তখন পর্যন্ত বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল সরকার নিজের জনগণের ওপরে এভাবে গুলি মারতে পারলো। ভাই সবসময় শুধু বলতো আন্দোলনে যাই। একদিন দশ নম্বারে গিয়ে ছাত্রদের পানি দিয়ে এসেছে। যখন আগস্ট মাস শুরু হয় তখন ভয়াবহতা আরও বাড়তে ছিল। তখন পুলিশ ও ছাত্রলীগ মিলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মারছিল। আমার ভাই আমার থেকে দশ বছরের বড় ছিল তবুও আমাদের সঙ্গে অনেক মিল ছিল। ৪ঠা আগস্ট সকালে যখন বাইরে যায় তখন আমরা ভেবেছি ও বাইরে গেছে আন্দোলনে যায়নি। বাসায় আসার পর দেখি ও খুব অসুস্থ চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। জানতে চাইলে বলে মিরপুর দশ নম্বরে গিয়েছিলাম টিয়ার গ্যাসে আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ৫ই আগস্ট নেট বন্ধ দেখে ভয়ে আমার চিন্তা হচ্ছিল। আমার ভাই তখন বলে নেটে যেহেতু কিছুৃ দেখা যাচ্ছে না আমি তাহলে দশ নাম্বার গিয়ে একটু দেখে আসি কী অবস্থা। এ সময় আমি বলি তুমি যেও না। কিন্তু সে শুনেনি দুপুর আড়াইটা বের হয়ে যায়। এরপর তো শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ভাইকে ফোন দেয়া হয় সে তখন জানায় আমি দশ নম্বরে বিজয় মিছিলে আছি। তখন আম্মু তাকে গণভবনে যেতে নিষেধ করে। আমি আবার এ সময় গণভবনে যাই। বিজয় মিছিল থেকে ৬টায় ভাই বাসায় ফিরে এসে আমার জন্য চিন্তা করতে থাকে। আমিও সন্ধ্যার পর ফিরে আসি বাসায়। রাত সাড়ে ৯টায় বাসা থেকে বের হয়ে আবার বাসায় আসে। ১০টা পয়তাল্লিশের সময় ওইযে আবার বাসার বাইরে গেল আমার ভাই আর ফিরে আসেনি।
বোন উমাইমা বলেন, ভাইয়া বাসায় না ফেরায় ওর বন্ধুদের কাছে ফোন দেই। রাত যত বাড়তে থাকে তত আমাদের মন খারাপ হতে থাকে। রাত আড়াইটার দিকে আমার বন্ধুদের কাছে ভাইয়ার কিছু ছবি পাঠিয়ে খুঁজতে বলি। কখনো বিশ্বাস করিনি আমার ভাইয়ের এমন কিছু হবে। মা তখন বলে, কেমন যেন মনে হচ্ছে আমার সন্তানের খারাপ কিছু হয়েছে। কখনো ভাবিনি ও এভাবে মারা যাবে। পরের দিন সকালে আমরা ঢাকা মেডিকেলের দিকে রওনা দেই। কুর্মিটোলাসহ কয়েকটি হাসপাতালে খুঁজে কোথাও পাওয়া যায়নি। প্রথমে গিয়ে ঢামেকের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে খুঁজেছি ভেবেছি হয়তো আহত হতে পারে। এরপর সেখানে থাকা একজন বলেন, আপনারা একটু মর্গে খুঁজে আসেন। তখন ভাবলাম মর্গে কেন খুঁজবো সেখানে তো খোঁজার কোনো কারণ নেই। তারপর আমার খালা মর্গে ফ্রিজারের দরজা খুলে দেখার পরে তো অবস্থা খারাপ। সব অল্প বয়সী ছেলেদের মরদেহ পড়ে আছে। এত লাশ আগে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছিল ভিতরে থাকা মরদেহগুলো হাত বাড়িয়ে দিয়ে এখনি বলবে যে আমাদের এখান থেকে নিয়ে যাও। এই মর্গে না দেখে আরেকটি মর্গে খুঁজতে থাকি। এরপর সোহরাওয়ার্দীর মর্গে গিয়েও খুঁজে পাই না সেখানেও লাশের সারি। তখন বিকাল ৪টা বাজে আম্মু ফোন দিয়ে বলে বাপ্পীকে পেয়েছি কিনা। তখন আমি বলি আম্মু পাইনি এ সময় আম্মু বলে, বাপ্পীতো আর বেঁচে নেই বলে অনেক কান্না করে। তখন নাকি দুইজন শিক্ষার্থী বাসায় এসে খবর দেয় যে ভাইয়ার মরদেহ হাতিরঝিলে পেয়েছে। পরে আমরা হাতিরঝিলে যাই সেখানে গিয়ে দেখি সে আর নাই। ওইদিন মেডিকেলে গিয়ে কোনো রিপোর্টই ঠিকমতো পাইনি। পানিতে ফেলে দেওয়ায় ভাইয়ার শরীর ফুলে যায় ওর গায়ে ছররা গুলি ছিল। নাক-মুখ থেকে বের হচ্ছিল রক্ত। তখন থানাতে পুলিশের কোনো কার্যক্রম ছিল না। আমরা ২১শে আগস্ট হাতিরঝিল থানায় একটা মামলা করি। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ছররা গুলি উল্লেখ ছিল। ওর শরীর অর্ধগলিত হওয়ায় ভালোভাবে বোঝাও যাচ্ছিল না। আমরা বিচার প্রাপ্য আমরা তো এদেশের নাগরিক। কে বা কারা এই কাজ করলো বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, আমার ভাতিজীটাতো এমনিতেই এতিম ছিল মা হারিয়ে এখন বাবাকেও হারালো। কীভাবে বড় হবে বাবা-মা ছাড়া। আমার এই ভাইকে বাবা-মা অনেক কষ্ট করে বড় করেছে। মেয়েটি সারাদিন ওর বাবাকে খুঁজতে থাকে।
mzamin

No comments

Powered by Blogger.