শ্রমিকরাও বৈষম্যের শিকার তাদের দিকেও তাকাতে হবে by নাজমুস সাকিব

বৈষম্য। এক শব্দের আন্দোলন। অহিংস কিন্তু শ্রমিক-মধ্যবিত্তসহ সর্বস্তরের মানুষ নাড়ির টান অনুভব করলো। ডাক দিলো ছাত্ররা, রাজপথে মুহুর্মুহু স্লোগান, নেমে আসলো অভিভাবকরাও। কেঁপে ওঠে ১৬ বছরের জুলুমশাহীর মসনদ। রাজাকারের বাচ্চা, নাতি অভিধা। বিভাজনের কার্ড। সব ব্যর্থ। শেষমেশ অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ। পৃষ্ঠ প্রদর্শনের বদলে আবু সাঈদের বুক পেতে দেয়া, অবিশ্বাস্য গুলির নজির। সাহসের সঞ্চারণ, সরকার পতনের সূত্রপাত। সরকার প্রধান দিগ্বিদিক। হেলিকপ্টার থেকে গুলি, বাসা বাড়িতেও গুলি, মাছুম বাচ্চারাও বাদ গেল না। মরবোই যখন তাহলে রাজপথেই মরি। যার যত বঞ্চনা, সবাই সবই রাজপথে উগরে দিলো। পুলিশ মেরে ঝুলিয়ে দিলো, পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দিলো। পুলিশ ডিমোরালাইজড। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তো শ্রমিক-কৃষকের সন্তান, ছাত্ররা ভাই-বোন, কীভাবে তারা নিরপরাধ ভাই-বোনদের বুকে গুলি চালাবে আর পাশে না থেকে উপায়ই বা কী? অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড সিংহভাগ নেতাকর্মীদের পাশে পেলো না... মার খাওয়ার ভয়ে কিংবা প্রতিরোধ করার ন্যায্যতা না পেয়ে। ফলে গুণ্ডা-মাস্তান লেলিয়েও বাঁচতে পারলো না। কিন্তু লাশ ফেললো হাজারের ওপরে, গুরুতর  আহত ২০ হাজারের ওপরে, কারও হাত নাই, পা নাই, চোখ নাই। লাগলে আরও লাখ খানেক লাশ ফেলতো গদি রক্ষার্থে। কিন্তু লাখে লাখে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা ঢাকার রাজপথ দখল হাসিনা রানীর কপালে পতনের সিল মেরে দিলো। হারার উপক্রম রাজাদের মতো সে পলায়ন করলো। ছাত্র-শ্রমিক জনতার গণঅভ্যুত্থান সফল হলো।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সামনের সারির নেতৃত্ব এবং বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ শ্রমিকদের বিপুল অংশগ্রহণের বিষয়টা উল্লেখ করলেন বার বার। সর্বশেষ ১১ই সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এই অভ্যুত্থানকে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিপ্লব হিসেবে মূল্যায়ন করেন। এটা অনস্বীকার্য বর্তমান সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশার শেষ নাই। তারপর ড. ইউনূস হাল ধরাতে এবং সরকারে ছাত্র প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হওয়াতে, যদিও ছাত্র প্রতিনিধিত্বের মাত্রা খুবই কম, সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে। কিন্তু সরকার সবে হাল ধরেছে এক মাস হলো। অর্থনীতির ত্রাহী অবস্থা করে রেখেছিল বিগত সরকার, প্রতিবাদ করলেই গুম, খুন, জেল। ফলে এখনো কিছুটা এলোমেলো অবস্থা।

বৈষম্য। শব্দটাতেই আবার ফেরত আসি। আমরা শুধু রপ্তানির ডলার দেশে ঢুকতে দেখি, বাংলাদেশ আরএমজি সেক্টরে বিশ্বে দ্বিতীয় হওয়া দেখি। কিন্তু যাদের হাড় ভাঙা খাটুনিতে, রক্তশূন্য করা পরিশ্রমে, পুষ্টিশূন্য কঙ্কালের শ্রমিক ভাই-বোনদের কি দেখি? দেখি কি তাদের মানবেতর জীবনযাপন, সূর্যের আলো দেখতে না পাওয়া, দিন-রাত একাকার হয়ে যাওয়া? করোনা হোক কিংবা যেকোনো দুর্যোগ, তাদের মেশিন চালানো কি বন্ধ থাকে? আমরা দেখি কি একটি সুন্দর জীবনের জন্য গ্রাম থেকে ফ্যাক্টরিতে আসা লোকজন শ্রমিকরা তাদের জীবন হারিয়ে ফেলে দুমুঠো ভাতের থালায়? আমরা দেখি কি বিশ্রাম বলতে কোনো শব্দ তাদের ডিকশনারিতে আছে কিনা? আমরা দেখি কি মালিকদের খাঁচায় তারা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি কিংবা তাজরিন অগ্নিকাণ্ডে লাশের স্তূপ হয়ে থাকেন। এতকিছুর পরও তারা ভদ্দরলোকের ভাষায় কয় টাকা বেতন পায় যেটা আসলে মজুরি। গার্মেন্টস শ্রমিকরা আসলে চোখে লাগার মতো বৈষম্যের শিকার।

পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ১৯৮৪ সালে প্রথম ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করেছিল তৎকালীন সরকার, ৬২৭ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে ১০৬২ টাকা ৫০ পয়সা, ২০১০ সালে ৩০০০ টাকা, ২০১৩ সালে ৫৩০০ টাকা, ২০১৮ সালে ৮০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় যা কার্যকরের ঘোষণা হয় ২০১৯। সর্বশেষ চরম আন্দোলনের মুখে বিগত সরকার ২০২৩ সালের ১লা ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি বোর্ড চালু করে এবং ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে ১২৫০০ টাকা। এখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। সেটা হলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রায় ৫০ ভাগের উপরে কাজ করে নতুন শ্রমিক যাদেরকে শিক্ষানবিশ শ্রমিক বলা হয়। মজুরি বোর্ডে কিংবা শ্রম আইনে শিক্ষানবিশ সময়কাল ৩ মাস বলা হলেও বাস্তবে তা মানা হয় না, দেখা যায় বছরের পর বছর তারা শিক্ষানবিশ থেকে যাচ্ছেন। শিক্ষানবিশ শ্রমিকের মজুরি হলো সর্বসাকুল্যে ৯৮৭৫ টাকা।

শ্রমিকদের মজুরি ফিগারে বাড়লেও প্রকৃত মজুরি কমেই চলেছে মূল্যস্ফীতির কারণে। ৪০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের সঙ্গে আরও লাখ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনে শ্রমিকরা অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে যা ড. ইউনূসও গুরুত্বের সঙ্গে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। আবার ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পরও রাস্তায় নামতে বাধ্য হয় গার্মেন্টস শ্রমিকরা। তবে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কোনো মতেই না। তবে এখানে কোনো মহল উস্কানি দিচ্ছে বলে চাউর হয়েছে। ষড়যন্ত্র চলছে।

তবে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বিগত ১৬ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট রেজিমের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজপথে থেকেছে প্রতিনিয়ত তার অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া নিয়ে, ছাত্রদের মতো স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন করে। প্রায় প্রতি মাসেই আন্দোলন করতে হয়েছে শুধু মাসের বেতনটা ঠিকমতো না পাওয়াতে। গার্মেন্টস শ্রমিকরা আন্দোলন তুঙ্গে নিলেই দালাল ট্রেড ইউনিয়নগুলো পিঠে ছুরি মারে, বিশ্বাসঘাতকতা করে, যেমনটা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ছাত্রদের আন্দোলনে করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয় নাই। ছাত্রদের কোটা সংস্কারের আন্দোলন তো মূলত চাকরি পাওয়ার আন্দোলন তথা পেটের আন্দোলন, শ্রমিকদের আন্দোলনও তাই।

শ্রম উপদেষ্টা বলেছেন শ্রমিকদের কাছ থেকে সম্মিলিত দাবি-দাওয়া দফা পাচ্ছেন না তারা। কথা হচ্ছে আপনারা যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখন কিন্তু বারেবারে আপনাদের দফা পাল্টেছে, সমন্বয়হীনতাও দেখা দিয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান চাপে, অত্যাচারে। শ্রমিক আন্দোলনেও তা-ই হচ্ছে। কয়েকদিন আগে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের ২৫টি দাবি চিহ্নিত করে যার মধ্যে আছে- প্রতি মাসের ৭ তারিখে মজুরি, বার্ষিক ১০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্ট, অর্জিত ছুটির টাকা মাসের ১৮ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে পরিশোধ, চলতি সেপ্টেম্বর থেকে টিফিন বিল ৫০ টাকা, শিফটের জন্য নাইট বিল ১৫০ টাকা ও দুপুরের খাবার বিল টাকা ৪০ টাকা করা; রোজার সময় ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হলে ৫০ টাকা ইফতার বিল দেয়া; পরবর্তী বছর থেকে পয়লা বৈশাখের ছুটি দেয়া; বার্ষিক উৎসব ছুটি ১৪ দিন করা; ঈদের ছুটি ১১ দিন করা;  কারখানাগুলোয় ৭০ শতাংশ পুরুষ কর্মী নিয়োগ দেয়া; কেউ অনুপস্থিত থাকলে চাকরি থেকে বাদ না দেয়া।

দাবির মধ্যে আরও আছে- ছুটি পাস হলে হাজিরা বোনাস পুরোপুরি এক হাজার টাকা করে দেয়া; মাতৃত্বকালীন ছুটির সম্পূর্ণ টাকা ছুটি শুরুর আগেই পরিশোধ করা; শুক্রবার বা কোনো বন্ধের দিন কাজ করলে ওভারটাইমের দ্বিগুণ টাকা পরিশোধ করা; পাঁচ বছরের বেশি চাকরি করে কেউ রিজাইন করলে প্রতি বছরের জন্য এক মাসের মূল বেতন দেয়া; শ্রমিকদের দাবি আদায়ে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের বহিষ্কার না করা। সরকারকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে-মালিক শ্রমিকের মধ্যে কখনো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্ভব নয়। এখানে দরকার পেশাগত সম্পর্ক। সরকারের নেয়া পদক্ষেপ অনেকটা ইতিবাচক কিন্তু যথেষ্ট নয়। এরমধ্যে সমকাল পত্রিকা ১৩ই সেপ্টেম্বর রিপোর্ট ছেপেছে- মালিকরা আরও যৌথ বাহিনীর উপস্থিতি চান এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে নাকি মোবাইল কোর্ট বসিয়ে ‘বিশৃঙ্খলাকারীদের’ সাজা দিবেন। খুবই উদ্বেগের খবর এবং অদূরদর্শী পদক্ষেপও বটে। ছাত্র প্রতিনিধি শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে বলবো- আপনি যেটা বলেছেন শ্রমিকদের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান মিটিং করবেন এটাই কার্যকরী পদক্ষেপ, আপনাদের মধ্যে বিপ্লবী স্পিরিট রয়েছে যেটা আমলাদের মধ্যে নাই, তাদের কথায় তেমন একটা কান দিবেন না। আপনাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যে পথে হেঁটেছে সেই পথে হাঁটবেন না, আলোচনার দুয়ার খোলা বলে তাদেরকে আহ্বান না জানিয়ে আপনি নিজেই তাদের কাছে যান। দেখবেন সহজ হয়ে গেছে। শ্রমিকরা বিপ্লবী শক্তি, ছাত্র-শ্রমিকের একতা গড়ুন, দেশ গড়ার কাজে লাগান। যেখানে গার্মেন্টস মালিকরা পালিয়ে গেছে, সেখানে আপাতত হলেও সরকারি উদ্যোগে ম্যানেজমেন্ট ঠিক করুন, শ্রমিকদের ম্যানেজমেন্টে রাখুন। মনে রাখবেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও দুষ্কৃতকারী ঢুকেছে, কোমলমতি ছাত্ররা এসব করতে পারে না বলে আপনাদের বিভক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এখনো সরকারি আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, মালিকপক্ষ একই সুরে বিবৃতি দিচ্ছে। আন্দোলনে শুধু শ্রমিকরা থাকে না, শ্রমিকদের রিজিকের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের রিজিকও জড়িত থাকে, বাসা ভাড়া, দোকান, বাজার ইত্যাদি, তারাও আন্দোলনে যুক্ত থাকতেই পারে যেমনটা ছাত্র আন্দোলনে সর্বস্তরের জনতা ছিল কারণ একেকজনের একেক রকম স্বার্থ ছিল। কিছু আসলেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী পাণ্ডা থাকতেই পারে, আছেও, কাউকে কাউকে ধরতেও সমর্থ হয়েছেন কিন্তু তাদেরকে সুযোগ দিবেন কেন?
লেখক: আইনজীবী
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
mzamin

No comments

Powered by Blogger.