সরজমিন গুলিস্তান: মার্কেটে দখলদারি, ফুটপাথে স্বস্তি by সুদীপ অধিকারী
সরজমিন গুলিস্তান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জাকের প্লাজা, নগর প্লাজা ও সিটি প্লাজার সমন্বয়ে ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট। এর মধ্যে দুই যুগের বেশি সময় ধরে জাকের প্লাজার নিয়ন্ত্রণ রেখেছেন ফিরোজ আলম নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি আগে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিতেন। এখন বিএনপি’র কর্মীদের সহায়তায় মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। আর ট্রেড সেন্টার উত্তর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন মোজাম্মেল মজু ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হুদা। নাজমুল হুদা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য। সভাপতি মোজাম্মেল মজুও আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিতেন। আর ট্রেড সেন্টার দক্ষিণের সভাপতি ছিলেন হুমায়ুন কবির মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম। তারা দুজন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তবে ৫ই আগস্টের পর বিএনপি পরিচয় দিয়ে মার্কেট সমিতির দখল নেন আব্দুল বাসেত, আক্তার হোসেন রানা ও মীর আল মামুন। যদিও এতদিন মীর আল মামুনকে আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে সবাই চিনতেন। এখন তারা মার্কেট সমিতির কার্যালয়ে নিয়মিত বসছেন। দোকানিরা জানান, ট্রেড সেন্টার উত্তর ও দক্ষিণের চতুর্থ তলায় দোকান মালিক সমিতির কার্যালয়ে বাসেত, রানা ও মামুন একেক দিন একেক জন যান। অনেকের অভিযোগ তারা মার্কেটের চারপাশে হকার বসিয়েও দোকান ভাড়ার নামে চাঁদাবাজি করছেন। অপরদিকে অভিযোগ উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও আত্মগোপনে থেকে গুলিস্তানের নিয়ন্ত্রণ করছেন ৩৩নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আউয়াল হোসেন। এখনো তার বাহিনী দিয়ে জাকের সুপার মার্কেটেসহ গুলিস্তানের কিছু কিছু মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ রেখেছেন তিনি। বিদ্যুৎ বিল, গার্ড বিল, পানির বিল ও ফুটপাথে দোকান বসিয়ে অবৈধ চাঁদা আদায় করছে আউয়ালের লোকজন। রাসেল, শরীফসহ মার্কেটের বেশকিছু দোকানি বলেন, ২২ সালের ৩রা মার্চ যুবলীগ নেতা আউয়াল তার লোকজন নিয়ে মার্কেটের নির্বাচিত সভাপতিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপুর্যপরি কুপিয়ে মার্কেট থেকে বের করে দিয়ে অবৈধভাবে মার্কেট মালিক সমিতির কার্যালয় দখল করে। শেখ হাসিনার পতনের পর গত ৬ই আগস্ট মার্কেটের সেই সাবেক সভাপতি ফিরোজ ও কমিটির অন্যান্যরা তাদের নিজ নিজ ব্যবসা দেখার জন্য মার্কেটে প্রবেশ করলে আউয়ালের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য তাজুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, জুবায়ের আহমেদ, মোহাম্মাদ মাসুম, শাহিনরা তাদের ওপর হামলা চালায়। এরপর গত ১০ই আগস্ট দোকান মালিক সমতির কার্যালয়ে আবারো হামলা চালায় আউয়ালের লোকজন। মোস্তাক আহমেদ নামে মার্কেটটির এক ব্যবসায়ী বলেন, এই মার্কেটের ৪৫১ জন দোকান মালিক ও দুই হাজার কর্মচারী চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। আমরা সাধারণ ব্যবসায়ী, আমরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে চাই। চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে চাই না। ব্যবসায়ী মো. কামরুল বলেন, নির্যাতনের ভয়ে কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হয় না। মার্কেটের বিদ্যুৎ বিল, গার্ড বিল, পানির বিলের নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় ও অবৈধ চাঁদাবাজি বন্ধের আহ্বান জানাই।
এদিকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর চাঁদা না দিয়েই ফুটপাথে ব্যবসা করছেন গুলিস্তানের ১০-১২ হাজার হকার। তারা এখন আর কাউকেই নিজেদের উপার্জনের টাকার ভাগ দিবেন না বলে একট্টা হয়েছেন। সরজমিন দেখা গেছে, জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে বায়তুল মোকাররমের সামনে হয়ে চলে যাওয়া বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সড়ক ও পীর ইয়ামেনী মার্কেটের সামনে হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধু সড়কের দুই পাশের ফুটপাথের পুরোটা জুড়েই বিভিন্ন জামা-কাপড়ের দোকান। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে পাতাল মার্কেটের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বরের দিকে যেতে ফুটপাথের ওপর ছাউনি দিয়ে দুই পাশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে স্থায়ী দোকান। মানুষ চলাচলের ফুটপাথে তৈরি হওয়া এসব অস্থায়ী দোকানগুলো বছরের পর বছর ধরে রূপ নিয়েছে স্থায়ী দোকানে। আর বঙ্গবন্ধু চত্বরের পেছন থেকে শুরু করে গোলাপ শাহ্ মাজার পর্যন্ত গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনের পুরো রাস্তা জুড়েও রয়েছে একাধিক হকারি দোকান। এসবের মধ্যে জুতা-স্যান্ডেল ও বাচ্চাদের জামা-কাপড়ই বেশি। এসব দোকান থেকে আগে দিনে দুইশো থেকে তিনশো টাকা করে চাঁদা আদায় করা হতো। গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ড থেকে পাতাল মার্কেটের দিকে যেতেও রাস্তার পাশ দিয়ে রয়েছে অসংখ্য জামা-কাপড়ের দোকান। আর গুলিস্তান স্কয়ার থেকে গোলাপ শাহ্ মাজার পর্যন্ত পুরো রাস্তা জুড়েই শত শত জুতা-স্যান্ডেল, জামা-কাপড়, ব্যাগ, ছাতাসহ শত শত দোকান। স্টেডিয়ামের চারপাশ, বাইতুল মোকাররম মসজিদের সামনে-পেছনে, জিপিও’র সামনের ফুটপাথসহ পুরো এলাকা জুড়েই রয়েছে কয়েক হাজার ভাসমান দোকান। এসব দোকানের আকার ও সময়ভেদে প্রতিদিন লাইনম্যানের মাধ্যমে ৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হতো। চাঁদার হার গড়ে ২০০ টাকা করে হলে প্রতিদিন ২০ লাখ টাকার উপরে চাঁদা আদায় করতো আওয়ামী লীগ সমর্থীতরা। কিন্তু এখন চাঁদা দেয়া লাগছে না এসব ব্যবসায়ীদের। জোবায়ের নামে এক হকার বলেন, আগে চাঁদা ছাড়া আমরা ব্যবসা করতে পারতাম না। গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর আর কেউ চাঁদা নিতে আসেনি। এখনো পর্যন্ত চাঁদা দেয়া ছাড়াই ব্যবসা করছি। চাঁদার অতিরিক্ত টাকা না দেয়ায় আমরা এখন অনেক ভালো আছি। ব্যবসা করে কয়টা লাভের মুখও দেখছি। আব্দুল ওহাব নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আন্দোলনে আমাদের অনেক ভাই মারা গেছে। তাই আমরাও সকলে এক হয়েছি। কাউকেই আমরা আর চাঁদা দিবো না। চাঁদার টাকা চাইতে আসলেই তার বিরুদ্ধে সমন্বিত ব্যবস্থা নেয়া হবে। চাঁদাবাজদের আইনের হাতে তুলে দেয়া হবে। পারভেজ নামে আরেক ব্যবসায়ি বলেন, অর্ন্তবর্তী সরকার থাকায় এখন পর্যন্ত কাওকে চাঁদা দেয়া লাগছে না। তবে কতোদিন এই পরিস্থিতি থাকবে জানি না।
অপরদিকে পীর ইয়ামেনী মার্কেট থেকে গোলাপ শাহ্ মসজিদের দুই পাশের ফুটপাথ থেকে দেড় মাস আগেও চাঁদা তুলতেন তসলিম নামের স্থানীয় এক লাইনম্যান। গোলাপ শাহ্ মসজিদ থেকে শুরু করে নগরভবন হয়ে টিএন্ডটির দক্ষিণ পর্যন্ত ফুটপাথ থেকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব ছিলো আমীরের। ঢাকা ট্রেড সেন্টারের পশ্চিম পাশ হয়ে হানিফ ফ্লাইওভার পর্যন্ত ফুটপাথে চাঁদা নিতেন বিমল, হান্নান এবং মিন্টু। আর মতিঝিল আইডিয়াল, রূপালী ব্যাংক, জীবন বীমা, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জীবন বীমার মাঝের সড়কে আগে চাঁদা আদায় করতেন শীর্ষ সন্ত্রাসী নাসির ওরফে ফেন্সি নাসির। বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর পাশে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত দোকান প্রতি দৈনিক ৩০০ টাকা করে চাঁদা তুলতেন হারুন, মকবুল ও দেলোয়ার। এ ছাড়া বামপন্থি নেতা আবুল হোসেনের শেল্টারে অ্যালিকো (আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি) ভবনের সামনের ফুটপাথ থেকে লাইনম্যান ছাদেককে দিয়ে চাঁদা নিতো ইসলামী হকার্স শ্রমিক আন্দোলনের নেতা আবুল কালাম ওরফে জুয়েল এবং মান্নান। সোনালী ব্যাংকের সামনের সড়ক নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন জাতীয় শ্রমিক লীগের মতিঝিল থানা কমিটির কিছু নেতা। জনতা ব্যাংকের সামনের শতাধিক দোকান থেকে চাঁদা তুলতেন ফারুক। ব্যাংক পাড়ার বক চত্বরের দোকান থেকে চাঁদা তুলতেন শ্রমিক লীগের নুরুল ইসলাম। জীবন বীমার প্রধান কার্যালয় আর ডিআইটি মসজিদের সামনে থেকে চাঁদা তুলতেন কালা কাশেম, দুলাল আর রহমান। পুরানা পল্টন মোড় থেকে আজাদ প্রোডাক্টের সামনে হয়ে দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত দোকানের চাঁদা তুলতেন আবুল হোসেন। দৈনিক বাংলা থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত চাঁদা তুলতেন পুলিশের সোর্স সাকিব ও খোকন মজুমদার। মতিঝিল শাপলা চত্বর থেকে আরামবাগ হয়ে আইডিয়াল স্কুল পর্যন্ত অংশে চাঁদা নিতেন পুলিশের সোর্স সাইফুল মোল্লা, শিবলু, আক্তার, যুবলীগ নেতা সাগর, যুবলীগ নেতা সনি। তবে গত ৫ই আগস্ট থেকে চাঁদার টাকা নিতে এদের কাওকেই দেখা যায়নি। মাঝে কিছুদিন কয়েকজন নিজেদেরকে বিএনপিপন্থি পরিচয় দিয়ে চাঁদার কথা বললেও তাতে পাত্তা দেয়নি ব্যবসায়ীরা। এখন পর্যন্ত চাঁদা ছাড়াই ব্যবসা করছেন এসব ফুটপাথের দোনানিরা।
No comments