যে প্রশ্ন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের by জি এম রাজিব হোসেন

ভয়ঙ্কর ও লোমহর্ষক যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে ইকবাল নামের পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, “গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিটি যায় না। এটাই হলো স্যার সবচেয়ে আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।” ইকবালের এ বর্ণনা শুনছেন পুলিশ প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারও। ৪৩ সেকেন্ডের এ ভিডিও ক্লিপটি পুলিশের বর্বরতার একটা অকাট্য প্রমাণ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে ১৯৩৭ সালে সারাবিশ্বের মানুষ একটি লোমহর্ষক প্রতিযোগিতার কথা জানতে পারেন। এটির নাম ছিল- “শত মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতা”। জাপানের দু’টি পত্রিকায় এ সংক্রান্ত দু’টি খবর বের হয়। যার মাধ্যমে চীনে আগ্রাসনের সময় তৎকালীন জাপানি বাহিনীর বর্বরতার চিত্র কিছুটা অনুধাবন করেছিল বিশ্ব। চীনের নানচিং যাওয়ার পথে জাপানের রাজকীয় বাহিনী ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় যা ইতিহাসে ‘নানচিং হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত। এ হত্যাকাণ্ড চালানোর সময় জাপানের দুই সেনা কর্মকর্তা তোশিয়াকি মুকাই ও তশুয়োশি নোদা একটি মাত্র তরবারি দিয়ে দ্রুততম সময়ে একশ’ মানুষ হত্যার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। উভয় কর্মকর্তা তাদের এ লক্ষ্য ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তবে কে বিজয়ী হয়েছিলেন তা জানা যায়নি। মানুষ হত্যার মতো নির্মম একটা ঘটনাকে এখানে ওই দুই কর্মকর্তা যেন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। হত্যাকাণ্ডকে তারা নিজেদের খেয়াল খুশির বিষয়ে পরিণত করেছিলেন। একশ’ হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য পূরণে তারা সামনে যাকে পেয়েছেন তাকে তরবারি দিয়ে শিরচ্ছেদ করেছেন। সাধারণত যুদ্ধের সময় এ ধরনের বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এবং এ ধরনের হত্যাকাণ্ড একটি জাতির ওপর আরেকটি জাতি দ্বারা সংঘটিত হয়। যেমনটা হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা।

কিন্তু সম্প্রতি শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনরত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা যে ভয়াবহ তাণ্ডব ও হত্যাযজ্ঞ চালায় তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আর ঘটেনি। এ সময় প্রতিদিন নিরাপরাধ মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আধুনিক অস্ত্র নিয়ে মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করেছে। স্নাইপার ব্যবহার করা হয়েছে। সবকিছুতেই যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব। ঠিক যেন জাপানি ওই দুই সেনা কর্মকর্তার হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু এখানে পার্থক্য একটাই। জাপানিরা ওই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল চীনাদের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশে নিজ দেশের নিরীহ জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একটি নির্দিষ্ট দলের সরকারকে টিকিয়ে রাখতে কতিপয় অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের গুলিবর্ষণের নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়েছেন সাধারণ অনেক পুলিশ সদস্য। অবশ্য অনেক পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সদস্য আওয়ামী লীগের প্রতি অতি দায়বদ্ধতার অজুহাতে নিজেও অতি উৎসাহী হয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছেন। এক্ষেত্রে একেকজন যেন অন্যজনের চেয়ে মানুষ হত্যায় অনন্য হয়ে উঠেন। যেন প্রতিযোগিতা চলছিল কে কতো জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ভিডিওচিত্রে হত্যাকাণ্ড চালানোর সময় তাদের মধ্যে এক ধরনের নায়কোচিত ভাব ও তাদের চোখেমুখে স্বস্তির অভিব্যক্তিও দেখা গেছে- যেটা মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।

ঘটনা এক: স্পট রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে সারা দেশের মতো আন্দোলনকারীরা ১৬ই জুলাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের একটি রাস্তায় সমবেত হয়ে অন্যান্য দিনের মতো বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনাও বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এ সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাইদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায় পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার আগে তিনি বুক চিতিয়ে দুইহাত দুইদিকে প্রসারিত করে দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় তিনি নিরস্ত্র ছিলেন। তার অবস্থান স্পষ্টতই প্রমাণ করছিল যে তিনি কোনোভাবেই পুলিশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিলেন না। তারপরও তাকে হত্যা করা হলো।

ভিডিওটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হয় যে কমপক্ষে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা শটগান দিয়ে রাস্তার অপর পাশ থেকে সরাসরি সাইদকে গুলি করেন। স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে মানবাধিকার সংগঠনটি জানায়, গুলিবর্ষণের সময় পুলিশ কর্মকর্তা ও সাইদের মধ্যে দুরত্ব ছিল মাত্র ১৫ মিটার। এমনকি সাইদ পুলিশের জন্য স্পষ্টত কোনো হুমকিই ছিল না।

ঘটনা দুই: সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও লোমহর্ষক যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে ইকবাল নামের পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, “গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিটি যায় না। এটাই হলো স্যার সবচেয়ে আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।” ইকবালের এ বর্ণনা শুনছেন পুলিশ প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারও। ৪৩ সেকেন্ডের এ ভিডিও ক্লিপটি পুলিশের বর্বরতার একটা অকাট্য প্রমাণ।

ঘটনা তিন: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কতোটা বর্বর ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছিল তার আরও একটি প্রমাণ ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। এতে দেখা যায় তরুণদের গুলি করে হত্যার পর লাশ ভ্যানের ওপর স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার থানা রোডের গলিতে। গুলিতে নিহত সাত ছাত্রের লাশ একটি ভ্যানের ওপর তুলে একটি ব্যানার দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। পরবর্তীতে লাশগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।

ঘটনা চার: ৫ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ টু ঢাকা’  কর্মসূচির অংশ হিসেবে কয়েক হাজার মানুষ রাজধানীর চাঁনখারপুল হয়ে শাহবাগে আসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আগে থেকে অবস্থান নিয়ে থাকা সশস্ত্র একদল পুলিশ তাদের ওপর হামলা করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছাত্রদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছুড়ছিল, কেউ সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করছিল আবার কেউ রাবার বুলেট ছুড়ছিল। কিন্তু এই টিমে আরও কয়েকজনের হাতে চাইনিজ রাইফেল ছিল। আরটিভি’র একটি ভিডিওতে তাদেরকে বন্দুকের ভিতরে তাজা গুলি লোড করে সাধারণ মানুষের দিকে ছুড়তে দেখা যায়। ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার নির্দেশে তারা নিরস্ত্র নিজ দেশের মানুষের ওপর গুলি ছুড়ছিল। গুলিতে কেউ মারা পড়লে তাদের চোখে মুখে যেন শান্তির আভা ফুটে উঠছিল। মনে হচ্ছিল নিজ দেশের নিরাপরাধ মানুষ হত্যা যেন কতো আনন্দের।

হত্যাকাণ্ডের প্রত্যেকটি ঘটনায় একেকজন যেন অন্যজনের চেয়ে ছিল সুনিপুণ। তাইতো বাসার ছাদে বাবার কোলে থাকা শিশু রিয়াকে নিখুঁত নিশানা বানিয়েছেন হয়তো কোন স্নাইপার। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে লাশের পর লাশ ফেলেছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। অর্ধমৃত এক তরুণকে পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন। অনেককে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করে রক্তের হোলিখেলা করেছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররাও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সারা দেশে লাশের সংখ্যা বাড়িয়েছেন। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা চালিয়ে সারা দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছেন।
শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা অপরাধ নয়, বরং এটা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৭নং অনুচ্ছেদে দেশের প্রত্যেকটা নাগরিকের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। উল্লেখ আছে, “জনশৃঙ্খলা বা জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।’ ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২০নং ধারায় প্রত্যেকেরই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশগ্রহণের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ ঘোষণাপত্রের ৩০টি ধারার মধ্যে ১৯নং ধারায়ও বলা হয়েছে-প্রত্যেকেরই মতামত পোষণ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তাদের সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করা তো দূরের কথা বরং বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে শতশত মানুষের প্রাণ গেছে এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছে। পুলিশ এক্ষেত্রে তাদের নীতিবাক্য শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও প্রগতি অনুসরণ তো করেইনি, বরং ভক্ষকের অবস্থান নিয়েছে।
আওয়ামী ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থান অহিংস ও সহিংস মিলে চলেছে মোট ২৬ দিন। এত অল্প সময়ে এত রক্ত দেশের মানুষ আগে কখনো দেখেননি। সম্প্রতি ঢাকার এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও এত অল্প সময়ে এত লোক মারা যাননি। স্বাধীনতার পূর্বে ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে মাত্র ৬১ জন মারা গেছেন। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় ১২ জন মারা গেছেন। শ্রীলঙ্কায় যে আন্দোলন হয়েছে তাতে মাত্র ৭ জন মারা গেছেন। বেলারুশে বিখ্যাত আন্দোলনে মাত্র এক ডজন লোক মারা গেছেন। পাকিস্তানে ইমরান খানের সঙ্গে শাহবাজের যে দ্বন্দ্ব হয়েছে তাতে ১২ জন মারা গেছেন।”

অথচ শুধু শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর উৎসাহী উচ্ছৃঙ্খল কিছু সদস্যদের প্রত্যক্ষ মদতে কতো মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে তার সঠিক হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। প্রথম আলোর ৪ঠা আগস্টের এক প্রতিবেদনে ওই সময় পর্যন্ত প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৭৫৭। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি এক প্রতিবেদনে সারা দেশে ৮১৯ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে।
গত ১৬ই আগস্ট জাতিসংঘের প্রাথমিক রিপোর্টে মৃতের সংখ্যা ৬৫০ জন উল্লেখ করে অভিযোগ করেছে যে আন্দোলন দমন করতে বিচার বহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও আটক, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ শান্তিপূর্ণ সমাবেশে কঠোর বিধিনিষেধের মতো গুরুতর মানবাধিকার লংঘন করেছে নিরাপত্তা বাহিনী (মানবজমিন)।

নিরাপত্তা বাহিনীর প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষের জানমাল রক্ষা করা। কিন্তু তারা কী তা করেছিল? কেন তারা সেদিন মানুষের পাশে না থেকে ফ্যাসিস্টদের পক্ষ নিয়েছিল? কেন তারা মানুষ হত্যার নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল? এ প্রশ্ন আমার মতো বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.