পদ্মার দুর্গম চরে বিল্লালের রাজত্ব টর্চারসেলে চলতো নির্যাতন by রিপন আনসারী

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মার দুর্গম  চরের একটি ইউনিয়ন আজিমনগর। আওয়ামী লীগের জামানায় ত্রাসের রাজত্বের রাজা ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিল্লাল  হোসেন। তার হাতেই জিম্মি ছিল নিরীহ চরবাসী। জমি দখল, চাঁদাবাজি, সালিশ বাণিজ্য এবং সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ টর্চারসেল বানিয়ে  চালানো হতো নির্যাতন। তার হুকুমই ছিল সেখানকার আইন। শুধু নিরীহ মানুষজনই নয়, বিএনপি’র নাম শুনলেই তেলে-বেগুনি জ্বলে উঠতেন তিনিসহ তার বাহিনীর লোকজন। বিএনপি অধ্যুষিত এই চর থেকে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার সব ধরনের চেষ্টা চালিয়েছেন। ইউনিয়নের সাবেক দু’বারের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি হান্নান মৃধাকেও দীর্ঘদিন চরে প্রবেশ করতে দেয়নি বিল্লাল ও তার বাহিনী। তাছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান একজন সদস্য বিএনপি ঘরানার হওয়ায় তাকে আড়াই বছরে ইউনিয়ন পরিষদের আঙিনায় ঢুকতে দেয়নি। চেয়ারম্যানের হাতিয়ার হিসেবে যাদের নাম সরাসরি উঠে এসেছে তাদের মধ্যে তার ছোট ভাই ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মোশারফ হোসেন, আলমগীর মেম্বার, তারাব আলী মেম্বার, এনায়েত ফকির মেম্বার, মতিয়ার ও আতিরের নাম। তাছাড়া চরে মাদক সিন্ডিকেটের হোতা হিসেবে তাদের নাম উঠে এসেছে। আজিমনগর ইউনিয়নটি পদ্মার দুর্গম চরাঞ্চলে হওয়ায় হবিরামপুর উপজেলা সদর থেকে প্রশাসনিক লোকজনের বেশির ভাগ সময়ই কার্যত পা পড়ে না। ফলে চেয়ারম্যান বাহিনীর একক আধিপত্য বিস্তার করে আসলেও সেটা দেখার কেউ নেই বলে অভিযোগ চরবাসির।

সরজমিন মানবজমিনের অনুসন্ধানে এমন চিত্র পাওয়া গেল আজিমনগর ইউনিয়নে। চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন ও তার বাহিনীর  নির্যাতন ও অপকর্মের রাজসাক্ষী হিসেবে মানবজমিনের কাছে তুলে ধরেন স্বয়ং তার পরিষদের একজন গ্রাম পুলিশ শেখ মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান বিলাল হোসেন ও তার বাহিনী চরে এমন কোনো অপকর্ম নেই যে করেনি। আমি তার অপকর্মের প্রত্যক্ষদর্শী। আমাকে দিয়েও অনেক অন্যায় অবিচার কাজ করিয়েছেন। বাড়িতে একটি টর্চার সেল বানিয়ে তার অবাধ্য চরাঞ্চলের নিরীহ মানুষজনকে শারীরিক প্রহার করা হতো। আমি সবই নিজ চোখে দেখেছি কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। তিনি বলেন, প্রকল্পের ঘর দেয়ার নাম করে মানুষজনের কাছ থেকে ৪০-৫০ হাজার  টাকা  নিয়েছে আমি সেটার রাজসাক্ষী। তাছাড়া ভূমি দেয়ার কথা বলে ৩০০ মানুষের কাছে ১০ হাজার করে টাকা নিয়েও কাউকে জমি দেয়নি।  ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের মাধ্যমে সেই টাকাগুলো নিয়েছে। সেখান থেকে সচিব ভাগ পেয়েছে। তার কাছে সেই তালিকা এখনো রয়েছে। চোখের সামনে তার এই অপকর্ম দেখে আমি চাকরি করবো না বলে তাকে জানিয়ে দিই। তখন চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বলে, ‘তুই করবি না, তোর বাপে চাকরি করবে’। পরে আমার দুই মাসের বেতন আটকে দেয়া হয়। উপজেলার নাজিমুদ্দীন স্যারকে বলে আমাকে চাকরি থেকে বাদ দেন। সরকার পতনের পর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আমাকে ডেকে বলে, ‘তোমার চাকরি কেউ খায়নি।’

আজিমনগর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীর শিকদারের ক্ষোভের শেষ নেই। তার অপরাধ সে বিএনপি করে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, গত ইউপি নির্বাচনে এলাকার জনগণ আমাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু গত আড়াই বছরে একদিনও আমাকে ইউনিয়ন পরিষদে ঢুকতে দেয়নি চেয়ারম্যান বিল্লাল হোসেন ও তার লোকজন। যার কারণে আমার ওয়ার্ডের জনগণের জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। তার ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আমার জায়গা জমি দখল করে নিয়েছে। আমার জমিতে আবাদ করা ৩০০ মণ ভুট্টা লুট করেছে। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে এভারেজে আমি ৮ বছরও বাড়িতে থাকতে পারিনি। কয়েকটি মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে বাড়িছাড়া করেছে। ভূমি দখল থেকে শুরু করে মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেয়া, নির্যাতনসহ এমন কোনো কাজ নেই যা বিল্লাল চেয়ারম্যান ও তার লোকজন করেনি। চেয়ারম্যানের ভাই মোশারফ হোসেন এলাকার নিরীহ মানুষের শত শত বিঘা জমি দখল করেছে। ভূমিহীনদের কাছ থেকে জায়গা জমির কাগজ করে দেয়ার কথা বলে ১০ হাজার ২০০ টাকা করে প্রায় ৬০০ জনের কাছ থেকে নিয়েছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বাবদ একেকজনের কাছ থেকে ৭০-৮০ হাজার করে টাকা লুটে নিয়েছে। চেয়ারম্যানের প্রধান ক্যাডার বাহিনীদের মধ্যে তার ভাই মোশাররফ, আতি মতি, আতোর আলীসহ আরও অনেকে। এনায়েতপুর গ্রামের বৃদ্ধ লাল মিয়া বলেন, বছর তিনেক আগে চেয়ারম্যান তার লোকজন দিয়ে আমার ছয় বিঘা জমি দখল করে নিয়েছে। প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোনো বিচার পাইনি। আমার মতো এলাকার অনেক মানুষকেই সে অত্যাচার করেছে। এলাকার মহিলারাও তার ভয়ে বাড়ির বাইরে বের হতে সাহস পেত না। রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা সোবহান খান।

৩০ বছর ধরে তিনি তার জায়গা জমিতে বসবাস করছিলেন। বিল্লাল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর আমার জমিতে তার চোখ পড়ে। মাস তিনেক আগে আমাকে হুমকি দেয়। বলেন, ‘জমিতে থাকতে হলে তোকে ৬ লাখ টাকা দিতে হবে। তা না হলে রাতারাতির মধ্যে বাড়িঘর ভেঙে তোকে চলে যেতে হবে।’ পড়ে বাধ্য হয়ে ৫ লাখ টাকা বিল্লাল চেয়ারম্যানের হাতে তুলে দিই। যুবক সোহেল রানা মানবজমিনকে বলেন, বিল্লাল হোসেনের বাবা ছিলেন একজন সামান্য ইউপি সদস্য। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পদ-পদবি ভাগিয়ে নিয়ে নেয়। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মারধর ও হামলা চালিয়ে এলাকা থেকে বিতাড়িত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর আগে তাদের গ্রামে তেমন অস্তিত্ব ছিল না। চেয়ারম্যান হওয়ার পর সে এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। চরের ভেতর বিলাসবহুল ৩ তলা বাড়ি। বাবার নামে রেকর্ডভুক্ত কোনো সম্পত্তি না থাকলেও তারা ১০-২০ হাজার মণ ভুট্টা পায়। রয়েছে বড় বড় ছয়টি গাড়ি। ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২০ কাঠা জমির উপর ছয় তলাবিশিষ্ট ভবন রয়েছে। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানের ছোট ভাই মোশারফ হোসেন স্থানীয় যুবলীগের সভাপতি।  তিনি ও তার লোকজন এলাকার মাদকের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। এলাকার অনেক পরিবারের সন্তান মাদকে আক্রান্ত হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। শিকারীপুরের সৌদি প্রবাসী আলহাজ মোল্লা বলেন, ২০২১ সালে আমার মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের দাওয়াত করায় বিল্লাল চেয়ারম্যানের লোকজন আমার বাড়িতে ঢুকে হামলা চালিয়ে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়।

এরপর আমাকে চৌকিদার দিয়ে ধরে তার বাড়িতে নিয়ে আয়নাঘরের মতো একটি রুমে নিয়ে ইচ্ছেমতো মারধর করে। চেয়ারম্যান নিজে এবং তার বাহিনীরা মারতে মারতে আমাকে অচেতন করে ফেলে। পরে আমার আত্মীয়স্বজন উদ্ধার করে ফরিদপুর মেডিকেল নিয়ে যায়। আমার মতো এলাকার যারা বিএনপি করে তাদের ধরে মারধর করতো। এলাকার মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি একজন ব্যবসায়ী। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানা, মানিকগঞ্জ সদর থানা, হরিরামপুর, সাটুরিয়া ও সিংগাইরসহ বিভিন্ন থানায় এ পর্যন্ত আমার বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশত মামলা দিয়েছে। রাজনৈতিক, চাঁদাবাজিসহ এমন কোনো মামলা নেই যেটা বিল্লাল চেয়ারম্যান ও তার লোকজন দেয়নি। গত ১৫ বছরে হামলা মামলা দিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। কৃষক সেকেন খাঁ বলেন, জমি দেয়ার কথা বলে চেয়ারম্যানের নির্দেশে এনায়েত মেম্বার আমার কাছ থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়েছে। অল্প কিছু জমি দিলেও কথা অনুযায়ী বাকি জমি দেয়নি। এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি হান্নান মৃধা মানবজমিনকে বলেন, আমি পরপর দু’বার চেয়ারম্যান ছিলাম আজিমনগর ইউনিয়নে। জবরদখল করে বিল্লাল চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই ইউনিয়নে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছে। এলাকার মানুষের স্বাধীনতা ও শান্তি সবটুকুই কেড়ে নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আমি আমার এলাকায় ঢুকতে পারিনি। চেয়ারম্যান ও তার লোকজন আমাকে ঢুকতে দেয়নি। তাছাড়া বিএনপি’র নাম শুনলেই অত্যাচার নির্যাতন করতো। চরে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে একটি বাহিনী তৈরি করেছিল। টর্চারসেল বানিয়ে সেখানে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। এখনো চরে তার লোকজন প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করছে। তাছাড়া সাবেক চেয়ারম্যান আলী আকবর খানও বর্তমান বিল্লাল চেয়ারম্যানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চরে অশান্তি সৃষ্টি করছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহরিয়ার রহমান মানবজমিনকে বলেন, চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ শোনার পর আমরা এসিল্যান্ড এবং কৃষি কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছিলাম। আশ্রয়ণ প্রকল্পের কয়েকটি ঘরে সার এবং ভুট্টা পাওয়া গেছে। সেগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য বলা হয়েছে। তাছাড়া ভূমি দেয়ার অধিকার চেয়ারম্যানের নেই। মানুষজন যদি কোনো টাকা পয়সা দিয়ে থাকে তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম রয়েছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, ইউনিয়নটি  দুর্গম চরাঞ্চল হাওয়ায় সেখানে যাওয়া আসায় এক ধরনের সমস্যা। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকায় প্রশাসনিকভাবে সেখানে তেমন কোনো তৎপরতাও চালানো সম্ভব হয় না। চরে একটি পুলিশ তদন্তকেন্দ্র থাকলেও সেটি এখনো চালু হয়নি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.