আমরা তোমাদের ভুলবো না by সাজেদুল হক
জিহাদ হাসান মাহিম। আমাদের কলিগ পিন্টু আনোয়ারের আত্মীয়। ১৯শে জুলাই একবার গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। বাবা-মা সতর্ক করেছিল তাকে। বাবা আর যাইস না। সে বলেছিল, আমরা না গেলে দেশ পরিষ্কার হবে কীভাবে! ৫ই আগস্ট সকাল থেকেই উত্তেজনা। মাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য মাহিম বলেছিল, ডিম সিদ্ধ বসাও। মা যেন বুঝতে না পারে মোবাইলটাও বাসায় রেখে বের হয়ে যায়। সেই ডিম নিয়ে মায়ের অপেক্ষা শেষ হয়নি। মাহিম তার ঘরে ফিরতে পারেনি। কোনোদিন পারবেও না।
আবু সাঈদ, মুগ্ধদের নাম আমরা জানি। অসংখ্য শহীদের নাম আমরা কেউ জানি না। বাংলা মায়ের মাটিতে কোথাও কি তাদের কবর হয়েছে? নাকি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদের? ভ্যানগাড়িতে ময়লার মতো লাশ ফেলা হচ্ছে। এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ক’দিন আগে। আরও ভিডিও সামনে আসছে। আসছে লোমহর্ষক সব ছবি।
৫ই আগস্ট থেকে ৫ই সেপ্টেম্বর। একদা অসম্ভব মনে হওয়া হাসিনার পতনের এক মাস হলো। রাষ্ট্র এখনো পুরোপুরি স্থির হয়নি। একের পর এক চ্যালেঞ্জ আসছে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে। কেউ কেউ বলছেন, ষড়যন্ত্র। ভিনদেশি শেয়ারহোল্ডাররা চেষ্টা করছেন সবকিছু অচল করার। রাজনৈতিক দলগুলোও যথাযথ ভূমিকা রাখছে কি-না সে প্রশ্নও উঠছে।
রক্ত নদী পেরিয়ে আসা বিজয়ের পর প্রধান কর্তব্য কী? আমরা মনে করি এ নিয়ে কোনো দ্বিধা-সংশয় থাকা উচিত নয়। শহীদদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে। সরকার, সমন্বয়ক, রাজনীতিবিদ, মিডিয়া সবাইকেই এটা করতে হবে। যারা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য তাদের বর্তমানকে বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের যেন আমরা কোনোদিনও ভুলে না যাই। শিক্ষার্থী, শ্রমিক, দিনমজুর যারাই নিহত হয়েছেন তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে হবে। অনতিবিলম্বে তাদের পরিবারকে একটি প্রাথমিক অর্থ সম্মানী দিতে হবে। গুরুতর আহত, পঙ্গু হওয়াদের পাশেও রাষ্ট্র, সমাজকে সর্বশক্তি নিয়ে দাঁড়াতে হবে। ভিডিওগুলো পুরোটা দেখতে পারি না। কারও হাত কেটে ফেলতে হয়েছে, কারও পা। চিরতরে অন্ধ হয়ে গেছেন অনেকে। সরকার তাদের চিকিৎসায় পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে গুরুতর আহতদেরও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিতে হবে। নিহতদের পরিবার এবং আহতদের পাশে রাষ্ট্রকে সারা জীবন থাকতে হবে। এ ব্যাপারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন ফাউন্ডেশন সম্ভাব্য সবকিছু করবে বলেই প্রত্যাশা আমাদের। শহীদদের বিশেষ মর্যাদা দিতে হবে।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গড়ে উঠেছে মূলত জুলাই ‘গণহত্যার’ বিচারের দাবিতে। এরইমধ্যে জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এ ঘটনার তদন্তে। যেটি নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক পদক্ষেপ। সারা দেশে নিহতের ঘটনায় বেশ কিছু মামলাও করা হয়েছে। অনেকে বলছেন, এসব মামলা বিশৃঙ্খল। আইন উপদেষ্টা এরইমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। আইনবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য এ আইনে কিছু সংশোধনী আনতে হবে। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দৃশ্যমান হওয়া প্রয়োজন।
জুলাই-আগস্টের শহীদদের প্রতি সমাজ, মিডিয়া, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবক্ষেত্র থেকেই যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। ঢাকার মিডিয়ায় এখন পর্যন্ত শহীদদের পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে আসেনি। এটা অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামর্থ্যেরও ঘাটতি। গান, সিনেমা, নাটকে, পাঠ্যপুস্তকে শহীদদের অবদান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের আন্দোলনের যে মূল চেতনা বৈষম্যমুক্ত সমাজ এবং মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করা তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
কী করে শেখ হাসিনার পতন সম্ভব হলো তা নিয়ে এখনো নানা গবেষণা চলছে। চারদিকে এখনো বিস্ময়! মানুষ তো দূরের কথা অনেক রাষ্ট্রই এখনো এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। যার গায়ে গুলি লাগে শুধু সেই সরে আর কেউ কেন সরে না- এটা আসলে বুঝা কঠিন, দুঃসাধ্য। সাদা চোখে যা বুঝা যায় আওয়ামী লীগ ও কিছু সহযোগী ছাড়া বাংলাদেশের সব মানুষকে এ আন্দোলন একই ছাতার নিচে আনতে সক্ষম হয়েছে। এ আন্দোলনে অংশ নেয়া নারী শিক্ষার্থীদের পোশাকের বৈচিত্র্য প্রমাণ করে তা কতো বিস্তৃত ছিল। আন্দোলনে নিহতদের তালিকায় রয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ ভূমির মানুষ ইতিহাস তৈরি করেছে। যার নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররা। যারা জীবন দিয়েছে তাদের চেয়ে বড় ত্যাগ আর কারোরই নেই। তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না। ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’।
No comments