আসামে বিদেশী চিহ্নিত করে বন্দী শিবিরে পাঠানো হলো ৪০ মুসলমানকে
এদের মধ্যে নয়জন নারী আছেন। এর একজনের সন্ধান পেয়েছে বিবিসি বাংলা, যার পরিবার দাবি করছে যে তার নাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে। অর্থাৎ তিনি যে ভারতেরই নাগরিক, তা এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পরে ভারত সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছে।
অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, আগস্টের ৮, ৯ তারিখে ২২ জনকে আর ২ সেপ্টেম্বর আরো ২৮ জনকে এভাবে থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে হেফাজতে নেয়া হয়েছে। বিদেশী চিহ্নিতকরণের যে ট্রাইব্যুনাল আছে আসামে, সেখানে হাজির করানোর পরে তাদের সবাইকে গোয়ালপাড়ার মাতিয়ায় চিহ্নিত হওয়া বিদেশীদের জন্য যে ট্রানজিট ক্যাম্প আছে, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ওই ট্রানজিট ক্যাম্পটি ভারতের সবথেকে বড় ডিটেনশান সেন্টার, যদিও এটির নাম পরিবর্তন করে এখন ট্রানজিট ক্যাম্প রাখা হয়েছে।
শিবিরে পথে বাসে কান্নাকাটি নারী-পুরুষদের
বরপেটার পুলিশ সুপারের অফিস থেকে ওই নারী-পুরুষদের একটি বাসে কড়া নিরাপত্তা দিয়ে গোয়ালপাড়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, ওই সময়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
সেটিতে দেখা যাচ্ছে, চিহ্নিত হওয়া ‘বিদেশী’দের পরিবার-পরিজন যেমন কান্নাকাটি করছেন, তেমনই বাসের ভেতরে বসা চিহ্নিত হওয়া ‘বিদেশী’রাও চিৎকার করে কাঁদছেন। আত্মীয় পরিজনদের কেউ কেউ রাস্তায় শুয়ে পড়েও কান্নাকাটি করছেন, এমনটাও দেখা গেছে ওই ভিডিওতে।
বরপেটার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট বিদ্যুৎ বিকাশ বরা ভুইঞা বার্তাসংস্থা এএনআইকে জানান, ‘জেলার সীমান্ত পুলিশ সোমবার বরপেটার বিভিন্ন থানায় বসবাসকারী ২৮ জন চিহ্নিত বিদেশীকে আটক করেছে। বিদেশী ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে বিদেশী বলে চিহ্নিত হওয়ার পরেই এদের গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে নয়জন নারী ও ১৯ জন পুরুষ আছেন। সব আনুষ্ঠানিকতার শেষে এদের গোয়ালপাড়ার শিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। গত মাসেও একইভাবে ২২ জন চিহ্নিত হওয়া বিদেশীকে আটক করা হয়েছিল।’
সই করতে ডাকা হয়
বরপেটা জেলার কলগাছিয়া থানা এলাকার ডিমাপুর গ্রামের বাসিন্দা নুরজাহান খাতুনের স্বামী জাহেদুল ইসলামকে পুলিশ থানায় দেখা করতে বলেছিল কিছু সই-সাবুদ করার জন্য।
নুরজাহান খাতুন বলেন, ‘থানা থেকে বলেছিল যে কিছু কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে, সই করতে হবে। সেই মোতাবেক আমার স্বামী থানায় যায়। কিন্তু সেখান থেকে পুলিশ সুপারের অফিসে পাঠানো হয়, আর তারপরেই গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।’
ওই নারীর সাথে যে অ্যাক্টিভিস্টের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া গেছে, সেই ফারুক খান বলছিলেন, ‘আমরা কাগজপত্র সব পরীক্ষা করে দেখতে পাই যে ২০০৪ সালে থানা থেকে একটি রিপোর্ট দেয়া হয় যে জাহেদুল ইসলাম নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন। এর ভিত্তিতে তার ট্রাইব্যুনালে গিয়ে মামলা লড়া দরকার ছিল কিন্তু তার যুক্তি ছিল যে মিথ্যা অভিযোগের মামলা কেন লড়ব, কেন ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও সেটা প্রমাণ করতে হবে! তবে জাহেদুল ইসলাম ছাড়া বাকিরা কিন্তু ট্রাইব্যুনালে গিয়েছিলেন। তাদেরও একই পরিণতি হয়েছে।’
জাহেদুল ইসলামের স্ত্রী নুরজাহান খাতুনের কথায়, ‘আমার স্বামীর এনআরসি-তে নাম আছে, তার নাম ডি-ভোটার তালিকাতেও ছিল না। সে জন্যই নিশ্চিন্ত ছিলাম আমরা। তবে সেই পুরনো রিপোর্টের ভিত্তিতে এখন তাকে বিদেশী বলে দেয়া হলো।’
তার দাবির সমর্থনে বেশ কিছু নথি বিবিসি বাংলাকে পাঠিয়েছেন নুরজাহান খাতুন।
ডি-ভোটার, বিদেশী ট্রাইব্যুনাল
আসামে ডি-ভোটার অথবা ডাউটফুল, অর্থাৎ সন্দেহজনক ভোটারদের চিহ্নিত করার নিয়ম চালু হয় ৯০ দশকের শেষ দিক থেকে। এর উদ্দেশ্য ছিল কথিত বাংলাদেশীদের ভোটার তালিকায় চিহ্নিত করে তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখা।
প্রথমের দিকে কয়েক লাখ ডি-ভোটারকে চিহ্নিত করা হলেও পরে ধীরে ধীরে সই সংখ্যা কমতে থাকে। সম্প্রতি আসাম সরকার রাজ্য বিধানসভায় জানিয়েছে, এই মুহূর্তে সেখানে এক লাখ ১৯ হাজার ৫৭০ জন ডি-ভোটার আছেন।
অন্যদিকে ডি-ভোটার বলে চিহ্নিত করার পরে এক ব্যক্তিকে বিদেশী ট্রাইব্যুনালে যেতে হয় নিজেকে ভারতীয় বলে প্রমাণ করতে।
এই ট্রাইব্যুনালগুলো আধা-বিচারালয় এবং এখানে বিচারকাজ পরিচালনা করেন যে ট্রাইব্যুনাল সদস্যরা, তারা আদতে বিচারক নন। আসাম সরকার এদের চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ করে।
প্রায় ১০০টি এমন ট্রাইব্যুনাল আসামে কাজ করে।
ওই ট্রাইব্যুনালগুলোতে মামলা লড়েন যেসব উকিল, তারাও মক্কেলদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ নিয়েও যথার্থভাবে মামলা উপস্থাপন করেন না বলে অভিযোগ ওঠে। নানা সময়ে মক্কেলদের সঠিক শুনানির তারিখ বা ট্রাইব্যুনালের নির্দেশও পাঠান না, এমন অভিযোগও শোনা গেছে।
ট্রাইব্যুনালে বিদেশী বলে চিহ্নিত হলে গুয়াহাটি হাইকোর্টে আবেদন করা যায়। হাইকোর্ট আর সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করে বহু চিহ্নিত হওয়া ‘বিদেশী’ ছাড় পেয়েছেন।
একই গ্রামের তিন নারী আটক
বরপেটা জেলার অন্তর্গত হাওলি থানার কালাজার গ্রামের তিন নারীকে ২ সেপ্টেম্বর একইভাবে আটক করা হয়।
বুধবার ওই গ্রামে গিয়েছিলেন আসামের রাজ্যভিত্তিক দল, ‘রাইজর দল’-এর সম্পাদক ও অ্যাক্টিভিস্ট মনিরুজ্জামান।
সেখানে তাদের পরিবারের সাথে কথা বলেন তিনি।
মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এখানে জবেদা খাতুন, সুফিয়া খাতুন ও রায়জান বেগম নামের তিন নারীকে আটক করে ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। তাদের নথিপত্র সব আমি দেখলাম। এদের মধ্যে জবেদা খাতুনের ব্যাপারটা হলো ২০১৬-১৭ সালে মামলা দেয়া হয়েছিল তার নামে। ট্রাইব্যুনালে পর্যাপ্ত নথি দিতে পারেননি বলে বিদেশী বলে চিহ্নিত হয়ে যান তিনি। সেটা ২০১৯ সালের ঘটনা। তবে তার উকিল সেই নির্দেশের কথা জানাননি জবেদা খাতুনকে। ওই নির্দেশের ব্যাপারে সময়মতো জানা গেলে গুয়াহাটি হাইকোর্টে যাওয়া যেত। অন্যদের ক্ষেত্রেও দেখতে পাচ্ছি ট্রাইব্যুনালের উকিলদের একই রকম খামখেয়ালিপনা ছিল।’
তিনি বলেন, ‘এমন অনেক ঘটনাই সামনে আসে, যেখানে উকিলরা অর্থ নিয়েও মক্কেলদের সঠিক পরামর্শ বা শুনানির দিন সম্বন্ধে জানান না। যার ফলে একতরফা অর্ডার দিয়ে দেয় ট্রাইব্যুনাল। ভুগতে হয় এমন সাধারণ গরীব মানুষকে।’
সূত্র : বিবিসি
No comments