টাকা ছাড়া কাজ করতেন না মন্ত্রীর পিএ বাবু by জাবেদ রহিম বিজন

আলাউদ্দিন বাবু। এই নামেই মুখর ছিল গত ক’বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও আখাউড়া উপজেলা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিল বাবু-বন্ধনা। তাকে তুষ্ট করাই যেন ছিল সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্বাচনী এলাকার এই দুই উপজেলার সুযোগ-সুবিধাকাঙ্ক্ষী মানুষের কাজ। চাকরি, বদলি, দলের পদ-পদবি, মামলা-মোকদ্দমার তদবির, এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট পরিচালনা, পাহাড় কাটা-সব কিছুতেই বাবুর নাম। সাব-রেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রারের পোস্টিংয়ের অগ্রনায়কও সে। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট (পিএ) বাবু গত কয়েক বছরে অসীম ক্ষমতাধর হয়ে উঠেন। টাকার বান্ডিল ছাড়া কোনো কাজ করেননি। এই ক’বছরে প্রায় শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন। জায়গা-সম্পত্তিও হয়েছে তার অঢেল।

মন্ত্রীর গুলশান অফিসে যাওয়া-আসা ছিল এমন সূত্রগুলো জানায়, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ওই অফিসে যারা গিয়েছেন তাদের চা পরিবেশন করতেন বাবু। ২০১৮ সালে পিএ নিয়োগ হওয়ার পর বাবুর অন্যরূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে। কর্কশ আচরণের কারণে তার কাছে মান-সম্মান হারানোর ভয়ে মন্ত্রীর গুলশানের অফিসে যাওয়া ছেড়ে দেন সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে। কথা আছে মন্ত্রণালয়ের সচিবও একসময় ওই গৃহভৃত্যের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। সম্মান হারানোর ভয়ে গুলশান অফিসে যাওয়া বাদ দেন। সেখানে এলাকার লোকজনের সঙ্গেও তার দুর্ব্যবহার ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।

স্থানীয় সূত্র জানায়, একাধিকবারে এসএসসি পাস করা বাবু জীবিকার জন্য ২০১৩ সালে বাহরাইনে পাড়ি জমান। আনিসুল হক প্রথম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি এবং মন্ত্রী হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসেন। এরপর মন্ত্রীর বাসায় কাজে যোগ দেন। মন্ত্রীর সাবেক এপিএস রাশেদুল কাওসার ভূঁইয়া জীবন কসবা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে এলাকায় চলে আসার পর বাবু হয়ে উঠেন সবকিছুর হর্তাকর্তা। মন্ত্রীর পিএসসহ অন্য স্টাফরা হয়ে পড়েন ঠুঁটো জগন্নাথ। তাদের কথায় কোনো কাজ হতো না। পিএ হওয়ার পরই আলাদীনের চেরাগ হাতে পান বাবু। সাব-রেজিস্ট্রার, জেলা রেজিস্ট্রার বদলি বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেয়ার দোকান খুলে বসেন। কামাই করতে শুরু করেন কোটি কোটি টাকা। সাব-রেজিস্ট্রার বদলির ক্ষেত্রে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়।  জেনে যাওয়ার ভয়ে এসব পদে কর্মরত এলাকার  লোকদের দূরে সরিয়ে রাখেন। বরং তাদের সঙ্গে চাকরের মতো আচরণ করতে শুরু করেন।

সূত্র জানায়, পিএ হওয়ার আগে ৫শ’-১ হাজার টাকাতেই তার হাসিমুখ দেখা গেছে। কিন্তু পরে আর বান্ডিল ছাড়া তুষ্ট করা যায়নি তাকে। সাব-রেজিস্ট্রার বদলির শতকরা ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে বাবু আর আরেক পিএ সফিকুল ইসলাম সোহাগের মাধ্যমে। স্থান ভেদে ৩০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০-৬০ লাখ, এমনকি দুই/আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত নেয়া হয় সাব- রেজিস্ট্রার বদলির ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে দরকষাকষি করে টাকা নেয়া হতো। যে বেশি টাকা দিতো তাকেই ভালো জায়গায় পোস্টিং দেয়া হতো। টাকা কম দিলে বেশি টাকা দেয়ার লোক আছে বলে টাকার অঙ্ক বাড়ানো হতো। তেজগাঁও রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্সে খিলগাঁও, উত্তরা, বাড্ডা, পল্লবী, গুলশান, শ্যামপুর, মিরপুর, সাভার, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এসব স্থানে বদলির জন্য একেকজন সাব-রেজিস্ট্রারকে ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। সাব-রেজিস্ট্রার ছাড়াও বিচারাঙ্গনের লোকজনও ভালো পোস্টিংয়ের জন্য ধরনা দিয়েছেন বাবুর কাছে।

বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে পিএ আলাউদ্দিন বাবু ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ ছাড়াও মন্ত্রীর বান্ধবী তৌফিকা করিম এবং এক যুগ্ম সচিব ও জেলা রেজিস্ট্রারের নাম আলোচিত। সূত্র আরও জানিয়েছে, টাকা না দেয়ায় বদলি-পদায়ন আটকে গেছে অনেকেরই। সাব-রেজিস্ট্রার মাহফুজ রানা মেহেরপুরের গাংনীতে দীর্ঘদিন থাকার পরও কোনো পোস্টিং পাননি। জেলা রেজিস্ট্রার অনেকের পদায়নের আদেশ হলেও তাদের আগের কর্মস্থলেই রাখা হয়। এমন কয়েকজন ঝালকাঠির আবদুল বারী, হবিগঞ্জের মো. মিজানুর রহমান, মেহেরপুরের সাইফুল ইসলাম, সিলেট মৌলভীবাজারের সোহেল রানা মিলন, সুনামগঞ্জের মফিজুল ইসলাম,  নেত্রকোনার আবদুল খালেক, জামালপুরের জহিরুল ইসলাম। অথচ টাকার জোরে একই সময়ে পদায়ন হওয়া এক জেলা রেজিস্ট্রার হবিগঞ্জ থেকে গাজীপুর, এরপর ঢাকায় সুবিধাজনক স্থানে বদলি হন। অভিযোগ রয়েছে বদলি সিন্ডিকেটে থাকা প্রভাবশালী এক জেলা রেজিস্ট্রার তার ’৯৪ ব্যাচের নিজস্ব লোকজনকে সুবিধা দিয়েছেন।  ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর এমন ভালো ভালো জেলায় পোস্টিং করিয়েছেন তাদের। ওই জেলা রেজিস্ট্রার নিজে ২০১৮ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরে চাকরি করে আসছেন।
পিএ হলেও এপিএসের চেয়ারেই বসতেন আলাউদ্দিন বাবু। তার জন্য গুলশান অফিসে এসি রুম এবং একটি জীপ বরাদ্দ ছিল।

স্থানীয়ভাবে চাকরি বাণিজ্যে জড়িত ছিল তার বাবা ইদ্রিস মিয়া, শ্বশুর ফরিদ মুহুরী, ভগ্নিপতি আমজাদ হোসেন। তাদের মাধ্যমেই চুক্তি হতো টাকার। স্থানীয় সূত্র জানায়, এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই চাকরির জন্য টাকা নেয়া হতো। টাকা নেয়ার সময় কারও কাছে বলবে না বলে কোরআন শরীফ ছোঁয়ানো হতো। চাকরি প্রার্থীকে বলা হতো ৮/১০ জায়গায় আবেদন করতে। এরমধ্যে একটিতে নিয়োগ নিশ্চিত করার আশ্বাস দেয়া হতো। চাকরি ভেদে সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ২৫/৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। বাবুর পিতা ইদ্রিস মিয়া মন্ত্রীর গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার।

ঢাকার গুলশানে আমেরিকান অ্যাম্বাসির পাশে বাবুর রয়েছে কয়েকটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া কসবা পৌর এলাকার কদমতলা এলাকায় কোটি টাকায় দোকান ভিটি ক্রয় করেন। গোপীনাথপুরের ধ্বজনগরে রয়েছে ১২/১৫ কানি জমির ওপর মাল্টা বাগান। সেখানে যাওয়ার জন্য করা হয়েছে পাকা রাস্তা। এ ছাড়াও আরও অনেক জমি রয়েছে এলাকায়।  ৫ই আগস্টের পর আত্মগোপনে বাবু। অনেকে বলছেন বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.