চট্টগ্রামে গুলি করে হত্যা: বৈঠকের কথা বলে সকালে বের হন, রাতে এল মৃত্যুর খবর by ফাহিম আল সামাদ

বৈঠকে যাচ্ছেন বলে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন মোহাম্মদ আনিস (৩৮)। দুপুর ও বিকেলে দুবার খোঁজও নেন স্ত্রী এনি আক্তার। তখন পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। আর রাত আটটায় আসে স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ।

গতকাল সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রামের অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় আনিসকে। একই সঙ্গে গুলিতে খুন হন আনিসের সব সময়ের সহচর মাসুদ কায়সারও (৩২)।

আনিসের স্ত্রী এনি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি বৈঠকে গেছে, এটা জানতাম। সঙ্গে মাসুদও ছিল। কিন্তু কার সঙ্গে বৈঠক, কারা ছিল সেই বৈঠকে, এসবের কিছুই আমরা জানি না। আমার স্বামীর সঙ্গে এলাকার কোনো বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে বিরোধ ছিল বলে আমাদের জানা নেই। কেন আমার স্বামীকে এভাবে মারল? আমি খুনিদের ফাঁসি চাই।’ আজ শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের সীমান্তবর্তী হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের পশ্চিম কুয়াইশ এলাকায় আনিসের বাড়িতে গেলে কথা হয় তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে।

পেশায় বালু ও পোলট্রি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আনিস পশ্চিম কুয়াইশ এলাকার ওসমান আলী মেম্বারের বাড়ির মৃত মো. ইসহাকের ছেলে। সেখানে দেখা যায় আনিসের মা সায়রা বেগম বাড়ির সামনে পেতে রাখা সোফায় বসে বিলাপ করছিলেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় সায়রা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে মেরে ফেলেছে। দোসরেরা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে।’ তবে কে বা কারা তাঁকে ডেকে নিয়ে গেছেন, তা স্পষ্ট করে বলতে পারেনি পরিবার।

দাদির পাশেই বসা ছিল নিহত আনিসের দুই সন্তান মোহাম্মদ আনাস (৪) ও হুমাইরা আক্তার (৮)। সবার চোখে কান্না দেখে তাদের চেহারায়ও মলিন ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘বাবা আর নেই’—এটুকু বুঝে থেমে থেমে কান্নায় ভেঙে পড়ছে দুজন।

আনিসের সঙ্গে একইভাবে খুন হন একই এলাকার বিল্লাবাড়ির বাসিন্দা মাসুদ কায়সার। তাঁর গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলায় বলে জানা গেছে। তিনি তাঁর নানাবাড়িতে থেকে পড়ালেখা করেছেন এবং সেখানেই থাকতেন। আনিস ও মাসুদ সব সময় একসঙ্গে থাকতেন বলে জানা গেছে। দুজনই স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন।

মাসুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে পুরো বাড়িতে। মাটিতে বসে কান্নায় বিলাপ করেছিলেন তাঁর খালা ইয়াসমিন আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমার বোনের ছেলেকে এভাবে হত্যা করা হলো, আমি এর বিচার চাই। সে রাজনীতি করত, এটা অপরাধ? এর জন্য তাকে মেরে ফেলতে হবে?’—প্রশ্ন ইয়াসমিন আক্তারের।

স্থানীয়রা বলছেন, আনিস ও মাসুদ স্থানীয় রাজনীতিতে হাটহাজারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা ইউনুস গণি চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তাঁরা। তবে এলাকায় প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে তাঁরা জানেন না। এলাকায় সবার সঙ্গে তাঁদের সখ্য ছিল।

কেন এই হত্যাকাণ্ড—জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ওয়াসিম ফিরোজ প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, আগের বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছে।

রাজনৈতিক বিরোধের কারণে হত্যাকাণ্ড হয়েছে কি না, তা জানতে স্থানীয় অন্তত পাঁচজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, এলাকায় দুটি পক্ষ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে নানা বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল দুই পক্ষের। এর একটি পক্ষে ছিলেন আনিস ও মাসুদ।

আনিস ও মাসুদকে যে স্থানে গুলি করা হয় সেটি নগরের পাঁচলাইশ ওয়ার্ড ও হাটহাজারী উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকা। এটি নগরের বায়েজীদ বোস্তামী থানার আওতাধীন। নগরের অনন্যা আবাসিক হয়ে কুয়াইশ সড়কের শেষ প্রান্তে এটি। সড়কের এক পাশে নাহার গার্ডেন রেস্তোরাঁ। অপর পাশে কিছু দূরে চট্টগ্রামের এভারকেয়ার হাসপাতাল।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের ভাষ্য, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়ক ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন আনিস ও মাসুদ। নাহার গার্ডেন রেস্তোরাঁ এলাকায় পৌঁছালে মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা তাঁদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। দুর্বৃত্তরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন গুলিবিদ্ধ দুজনকে উদ্ধার করেন। আনিস ঘটনাস্থলে ও মাসুদকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

বায়েজীদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সনজয় কুমার সিনহা প্রথম আলোকে বলেন, ময়নাতদন্তের পর লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এ ঘটনায় মামলার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। কী কারণে এ ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে পুলিশ বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছে।

No comments

Powered by Blogger.