যুদ্ধের আড়ালে ফিলিস্তিনিদের ভূমি যেভাবে দখল করছে ইসরাইল
নয়া দিগন্তঃ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে একটা হলো ফিলিস্তিনের বাত্তির। সেখানকার জলপাই বাগান এবং আঙুরক্ষেতের জন্য পরিচিত এই গ্রাম। সেখানে প্রাকৃতিক ঝর্ণার পানি ব্যবহার করা হয় সেচের কাজে। কয়েক শতাব্দী ধরে এইভাবেই জীবন বয়ে চলেছে সেখানে।
প্রকৃতির কোলঘেঁষা সেই গ্রামই অধিকৃত ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক’ বা পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের সর্বশেষ ‘ফ্ল্যাশপয়েন্টে’ পরিণত হয়েছে।
ইসরাইল সেখানে একটা নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন বা ‘সেটলমেন্ট’-এর অনুমোদন দিয়েছে। এই নতুন বসতির জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে বহু মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি। শুধু তাই নয়, অনুমোদন ছাড়াই নতুন ইসরাইলি ফাঁড়িও স্থাপন করা হয়েছে।
যাদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি এই নতুন বসতি স্থাপনের জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের তালিকায় রয়েছে ঘাসান ওলিয়ান। তিনি বলেন, ‘নিজেদের স্বপ্ন গড়তে আমাদের জমি চুরি করছে ওরা।’
ইউনেস্কো জানিয়েছে, বাত্তিরকে ঘিরে বসতি স্থাপনকারীদের পরিকল্পনা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। তবে ওই গ্রাম কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ জাতীয় ‘সেটলমেন্ট’কে অবৈধ হিসেবে দেখা হয়। যদিও এই বিষয়ে ইসরাইল সহমত পোষণ করে না।
ওলিয়ান বলেন, ‘ওরা আন্তর্জাতিক আইন, স্থানীয় আইন, এমন কী আল্লাহর আইনকেও তোয়াক্কা করে না।’
গত সপ্তাহে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা প্রধান রোনেন বার মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে তাদের সতর্ক করেছিলেন। সেই চিঠিতে রোনেন বার উল্লেখ করেন, পশ্চিম তীরের ইহুদি চরমপন্থীরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী’ কাজ চালাচ্ছে এবং দেশের ‘অবর্ণনীয় ক্ষতি’ করছে।
গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীরে দ্রুত বসতি স্থাপন হচ্ছে।
ইসরাইল সরকারের থাকা চরমপন্থীরা অবশ্য ‘গর্ব’ করে বলেন এই পরিবর্তন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাধা দেবে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিজেদের ‘লক্ষ্য’ পূরণের জন্য গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চাইছে এই চরমপন্থীরা।
বসতি স্থাপনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণকারী ইসরাইলি সংস্থা ‘পিস নাও’-এর ইয়োনাতান মিজরাহি বলেন, ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের চরমপন্থী ইহুদিরা ইতিমধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরো বাড়িয়ে তুলছে এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটানোর বিষয়টাকেও কঠিন করেছে।’
তার মতে, ৭ অক্টোবরের হামলা পর ইসরাইলি সমাজে ‘ক্রোধ ও ভয়ের মিশ্রণ’ রয়েছে। ওই হামলার পর থেকে জমি দখল করে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে ‘গতি এসেছে’ বলেও জানান তিনি। তার কারণ যারা জমি দখল করছেন, তাদের প্রশ্ন করার কেউ নেই।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জুন মাসের একটা সমীক্ষা বলছে ৪০ শতাংশ ইসরাইলের মানুষ বিশ্বাস করেন, এই বসতি স্থাপন তাদের দেশকে নিরাপদ করেছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭ শতাংশ।
অন্যদিকে জুন মাসের ওই জরিপে অংশ নেয়া ৩৫ শতাংশ মানুষ আবার মনে করেন, বসতি স্থাপনের কারণে ইসরাইলের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগের জরিপে ওই পরিসংখ্যান ছিল ৪২ শতাংশ।
ইয়োনাতান মিজরাহি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, পশ্চিম তীরের ইহুদি চরমপন্থীরা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। একইসাথে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটানোর বিষয়টাকেও আগের চেয়ে কঠিন করে তুলছে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে ঘৃণা বাড়ছে।’
এই জাতীয় ঘটনায় বৃদ্ধি আগেই দেখা গিয়েছিল। কিন্তু গত ১০ মাসে এমন ১ হাজার ২৭০টা হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে জাতিসঙ্ঘ। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৫৬।
ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থা বেটসেলেমের তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের কারণে অন্তত পশ্চিম তীরের ১৮টা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরাইল ও জর্ডনের মধ্যবর্তী এই ফিলিস্তিনি অঞ্চল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে সময় দখল করেছিল ইসরাইল। তখন থেকে এই অংশ তাদের দখলেই রয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাসের মধ্যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ৫৮৯ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৫৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে ইসরাইলির বাহিনীর হাতে এবং অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বসতি স্থাপনকারীদের হাতে।
জাতিসঙ্ঘের মতে, এদের মধ্যে কেউ কেউ হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে জানা গিয়েছে, আবার এই তালিকায় নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনও রয়েছে।
আবার অন্য দিকে, ওই একই সময়ে ফিলিস্তিনিরা পাঁচজন ‘সেটলার’ বা বসতি স্থাপনকারী ও ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর নয়জন সদস্যকে হত্যা করেছে।
চলতি সপ্তাহে বেথেলহেমের কাছে ওয়াদি আল-রাহেলে বসতি স্থাপনকারী ও ইসরাইলি সেনারা প্রবেশ করে। সেখানে ৪০ বছরের এক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, এর আগেও কাছাকাছি থাকা একটা ইসরাইলি গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয়েছিল।
গত মাসে জিট গ্রামে জায়গা দখলের উদ্দেশ্যে ঢুকে পড়া কয়েক কিছু লোক তাণ্ডব চালালে ২২ বছরের এক ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে নিন্দা করা হয়।
ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছ। তাদের পক্ষ থেকে একে ‘মারাত্মক সন্ত্রাসী ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কিন্তু এই পদক্ষেপ ‘দায়মুক্ত’ করার জন্য বলেই মনে করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
ইসরাইলি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী ‘ইয়েশ দিন’-এর তথ্য বলছে ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার ঘটনার আনুষ্ঠানিক তদন্তের পর মাত্র তিন শতাংশ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া রোনেন বারের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘লঘু আইনি পদক্ষেপই’ চরমপন্থী দখলদারদের ‘উৎসাহ’ দিয়েছিল।
‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’
পশ্চিম তীরের কিছু অংশে একচেটিয়াভাবে প্রতিষ্ঠিত ইহুদি সম্প্রদায়ের মাঝেই বাস করছে এই নতুন বসতি স্থাপনকারীরা।
এর মধ্যে অনেক বসতিতেই ইসরায়েলি সরকারের আইনি সমর্থন রয়েছে। অন্য বসতি যা ‘আউট পোস্ট’ বা ফাঁড়ি হিসেবে পরিচিত সেগুলো বেশিভাগই কাফেলা এবং লোহার তৈরি ছাউনির মতো সাধারণ।
এগুলো কিন্তু ইসরায়েলের আইনের চোখেও অবৈধ। কিন্তু চরমপন্থীরা আরো বেশি জমি দখলের করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো তৈরি করে।
জুলাই মাসে, যখন জাতিসঙ্ঘের শীর্ষ আদালত প্রথমবার জানতে পারে পূর্ব জেরুসালেম-সহ পশ্চিম তীরে ইসরাইলের দখল অবৈধ, তখন ওই দেশকে বসতি স্থাপন সংক্রান্ত সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ এবং যত দ্রুত সম্ভব সেনা প্রত্যাহার করতে কথা বলা হয়।
ইসরাইলের পাশ্চাত্যের মিত্ররা কিন্তু বারবার এই বসতি স্থাপনকে শান্তি আনার পথে অন্তরায় বলে আখ্যা দিয়ে এসেছে। ইসরাইল অবশ্য এই নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে জানায়, ‘ইহুদিরা তাদের নিজেদের জমিতে কোনোভাবেই দখলদার নয়।’
এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের এই পদক্ষেপকে যাতে কোনোভাবেই বন্ধ না করা যায়, তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে চরমপন্থীরা।
ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্র-ডানপন্থী সরকারের সমর্থন পেয়ে ওই অঞ্চলে দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেছে।
পশ্চিম তীরে সংযুক্তির পরিকল্পনাকে আরো মজবুত করছে এই চরমপন্থীরা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে গাজায় বসতি স্থাপনের জন্য প্রকাশ্যে আহ্বানও জানাচ্ছে।
নতুন বসতি স্থাপনকারীদের অনেকেই এখন ইসরাইল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।
একদিকে পশ্চিম তীরে এই বসতি স্থাপনের বিরোধিতাকারী বিশ্বনেতারা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য নতুন করে উৎসাহ দিচ্ছেন, শান্তি আনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপের কথা বলছেন।
আর অন্যদিকে ইসরায়েলের জাতীয়তাবাদীরা যারা বিশ্বাস করে এই পুরো জমি তাদের (ইসরায়েলের) মালিকানাধীন, তারা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে ‘অসম্ভব’ করে তুলতে সচেষ্ট।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ কারণেই কিছু রাজনীতিবিদ যুদ্ধবিরতি চুক্তি মানতে নারাজ।
টাইমস অফ ইসরাইলের রাজনৈতিক সংবাদদাতা টাল স্নাইডার বলেন, ‘তারা সংঘাতের অবসান ঘটাতে চায় না বা জিম্মি চুক্তিতে যেতে চায় না কারণ তারা বিশ্বাস করে যে ইসরাইলের লড়াই চালিয়ে যাওয়া উচিত যতক্ষণ না তারা গাজার ভেতরে থাকতে পারে। তারা দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা পোষণ করেন এবং মনে করে তাদের মতাদর্শ বেশি ন্যায়সঙ্গত। এটা অবশ্য তাদের নিজস্ব যুক্তি।’
ইতোমধ্যে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ পাঁচটা নতুন বসতির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে বাত্তিরের বসতি এবং রাষ্ট্রের জন্য কমপক্ষে ২৩ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্র।
এর অর্থ হলো ইসরাইল এই জমিকে তাদের নিজেদের বলে মনে করে, তা সে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলেই হোক বা ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হোক কিংবা দু’টিই।
স্থলভাগে তথ্য পরিবর্তন করে এই দখলদাররা বিপুল সংখ্যক ইসরাইলিদের ওই জমিতে স্থানান্তরিত করতে চায় যাতে তাদের উপস্থিতির জানান দেয়া যেতে পারে। এবং দীর্ঘমেয়াদে এই ভূখণ্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা দখল করবে।
এদিকে, রাষ্ট্র অনুমোদিত ভূমি দখলের বাইরে চরমপন্থীরাও কিন্তু ওই অঞ্চলে দ্রুত বসতি স্থাপন করেছে।
হেবরনের উত্তরে আল-কানুবের একটা স্যাটেলাইট চিত্র অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে নতুন কাফেলা এবং রাস্তা নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে ওই অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
ইব্রাহিম শালালদা (৫০) এবং তার ৮০ বছর বয়সী চাচা মোহাম্মদের সাথে আমরা আল-কানুবের দিকে রওনা হলাম। তারা আমাদের জানিয়েছিলেন কিভাবে গত বছরের নভেম্বরে বসতি স্থাপনকারীরা তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিয়েছে।
আমরা কাছাকাছি আসতেই একজন চরমপন্থী (ওই অঞ্চলে দখলদারদের মধ্যে একজন) তার গাড়ি নিয়ে আমাদের রাস্তা আটকায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সশস্ত্র ইসরাইলিরা সেখানে পৌঁছে যায়। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কয়েকজন সৈন্য এবং সেটেলমেন্ট সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তি তল্লাশির জন্য আমাদের থামায়।
সেটেলমেন্ট গার্ড আমাদের গাড়ির অন্য দুই যাত্রীকে (দুজন ফিলিস্তিনি) গাড়ি থেকে নামিয়ে তল্লাশি করেন। দু’ঘন্টা পরে, আইডিএফ সৈন্যরা বসতি স্থাপনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং আমাদের (গণমাধ্যমকর্মী) গাড়িকে যেতে দেয়া হয়।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে জর্ডনের কাছ থেকে পশ্চিম তীর দখল করার পরপরই সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে ইসরাইল। তারপর থেকে ক্ষমতায় আসা প্রতিটা সরকারই সেখানে ক্রমবর্ধমান বসতি সম্প্রসারণের অনুমতি দিয়েছে।
বর্তমানে সেখানে (ইসরাইল অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেম বাদে) আনুমানিক ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি ৫ লাখ ইহুদি ইসরাইলির সাথে ১৩০টারও বেশি বসতিতে থাকে।
তবে ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়া একজন সুপরিচিত উগ্র-ডানপন্থী সরকারি নেতা এই সংখ্যা দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
উগ্র-ডানপন্থী নেতা বেজালেল স্মোট্রিচ বিশ্বাস করেন, ওই জমিগুলোতে ইহুদিদের ‘সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অধিকার’ রয়েছে। তিনি দুটি উগ্র-ডানপন্থী বসতি স্থাপনকারী দলের মধ্যে একটার প্রধান। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০২২ সালের নির্বাচনের পরে তাকে ক্ষমতায় আনেন।
স্মোট্রিচ অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও তিনি একইসাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদাধিকারী, যা তাকে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার সুযোগ করে দিয়েছে।
নতুন রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোসহ এই বসতিগুলোতে রাষ্ট্রের অর্থ থেকে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছেন তিনি। দ্রুত বসতি নির্মাণের জন্য নতুন আমলাতন্ত্রও তৈরি করেছেন।
গোপনে রেকর্ড করা কথোপকথনে তাকে সমর্থকদের কাছে গর্ব করে বলতে শোনা গিয়েছে, তিনি সিস্টেমের ‘ডিএনএ পরিবর্তন’ করেছেন এবং পশ্চিম তীরে সংযুক্তির জন্য তার যে পদক্ষেপ তা ‘আন্তর্জাতিক এবং আইনি প্রেক্ষাপটে’ নিরিখে কার্যকর।
‘আমার জীবনের উদ্দেশ্য’
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা কয়েক দশক ধরে ইসরাইলি রাজনীতির একেবারে প্রান্তে ছিল। কিন্তু তাদের মতাদর্শ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের নির্বাচনে এই দলগুলো ১২০টা আসনের ইসরাইলি সংসদে ১৩টা আসন দখল করে। নেতানিয়াহুর ডানপন্থী জোটে ‘কিংমেকারে’ পরিণত হয় এই দলগুলো।
যুদ্ধের সময়, বেজালেল স্মোট্রিচ এবং সহকর্মী উগ্রপন্থী ইতামার বেন-গভির, বর্তমানে ইসরায়েলের জাতীয় সুরক্ষা মন্ত্রী, বারবার সামাজিক বিভাজনমূলক মন্তব্য করেছেন যা তাদের পাশ্চাত্যের মিত্রদের উসকে দিয়েছে।
এক ফিলিস্তিনি বন্দীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ‘রিজারভিস্ট’ বা অতিরিক্ত বাহিনীভুক্ত সৈনিকদের গ্রেফতার করার পর বেন গভির বলেন, ‘আমাদের সেরা বীরদের’ গ্রেফতার করার পদক্ষেপ ইসরাইলের জন্য ‘লজ্জাজনক’।
চলতি মাসে স্মোট্রিচ বলেছিলেন, গাজাবাসীকে অনাহারে রাখা ‘ন্যায়সঙ্গত ও নৈতিক’ হতে পারে।
কিন্তু পশ্চিম তীর ও গাজায় উগ্র ডানপন্থীরা স্থায়ী পরিবর্তন আনতে চাইছে।
প্রবীণ ইসরাইলি সাংবাদিক ও দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদদাতা আনশেল ফেফার বলেন, ‘ইসরাইলিদের এই গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি বা ইসরাইলের অন্যান্য আরব প্রতিবেশীদের সাথে কোনো রকমের সমঝোতার বিরোধী।’
আর গাজায় যুদ্ধের কারণে উগ্র-ডানপন্থীরা নতুন সুযোগ পেয়েছে।
স্মোট্রিচ ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ইসরায়েলিদের জন্য পথ প্রশস্ত হয়।
যদিও নেতানিয়াহু গাজায় ইহুদি বসতি পুনঃস্থাপনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও উগ্র-ডানপন্থী দলগুলোর সাথে তার বর্তমান সমীকরণ লক্ষ্যনীয়। তারা নেতানিয়াহুকে ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে যে তিনি যদি হামাসের হাতে আটক ইসরাইলি পণবন্দীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে ‘বেপরোয়া’ যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তবে এই জোট তারা ভেঙে দেবে।
চরমপন্থীদের যুক্তি হয়তো সংখ্যালঘু ইসরাইলিরাই অনুসরণ করে। কিন্তু এটা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে এবং নাটকীয়ভাবে পশ্চিম তীরের দৃশ্যপট বদলে দিচ্ছে- যা শান্তি স্থাপনের পথে বাধা হয়েও দাঁড়াচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি
ইসরাইল সেখানে একটা নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন বা ‘সেটলমেন্ট’-এর অনুমোদন দিয়েছে। এই নতুন বসতির জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে বহু মানুষের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি। শুধু তাই নয়, অনুমোদন ছাড়াই নতুন ইসরাইলি ফাঁড়িও স্থাপন করা হয়েছে।
যাদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি এই নতুন বসতি স্থাপনের জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে তাদের তালিকায় রয়েছে ঘাসান ওলিয়ান। তিনি বলেন, ‘নিজেদের স্বপ্ন গড়তে আমাদের জমি চুরি করছে ওরা।’
ইউনেস্কো জানিয়েছে, বাত্তিরকে ঘিরে বসতি স্থাপনকারীদের পরিকল্পনা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। তবে ওই গ্রাম কিন্তু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ জাতীয় ‘সেটলমেন্ট’কে অবৈধ হিসেবে দেখা হয়। যদিও এই বিষয়ে ইসরাইল সহমত পোষণ করে না।
ওলিয়ান বলেন, ‘ওরা আন্তর্জাতিক আইন, স্থানীয় আইন, এমন কী আল্লাহর আইনকেও তোয়াক্কা করে না।’
গত সপ্তাহে ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা প্রধান রোনেন বার মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখে তাদের সতর্ক করেছিলেন। সেই চিঠিতে রোনেন বার উল্লেখ করেন, পশ্চিম তীরের ইহুদি চরমপন্থীরা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী’ কাজ চালাচ্ছে এবং দেশের ‘অবর্ণনীয় ক্ষতি’ করছে।
গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীরে দ্রুত বসতি স্থাপন হচ্ছে।
ইসরাইল সরকারের থাকা চরমপন্থীরা অবশ্য ‘গর্ব’ করে বলেন এই পরিবর্তন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাধা দেবে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিজেদের ‘লক্ষ্য’ পূরণের জন্য গাজায় যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চাইছে এই চরমপন্থীরা।
বসতি স্থাপনের বিষয়ে পর্যবেক্ষণকারী ইসরাইলি সংস্থা ‘পিস নাও’-এর ইয়োনাতান মিজরাহি বলেন, ‘ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের চরমপন্থী ইহুদিরা ইতিমধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরো বাড়িয়ে তুলছে এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটানোর বিষয়টাকেও কঠিন করেছে।’
তার মতে, ৭ অক্টোবরের হামলা পর ইসরাইলি সমাজে ‘ক্রোধ ও ভয়ের মিশ্রণ’ রয়েছে। ওই হামলার পর থেকে জমি দখল করে বসতি স্থাপনের ক্ষেত্রে ‘গতি এসেছে’ বলেও জানান তিনি। তার কারণ যারা জমি দখল করছেন, তাদের প্রশ্ন করার কেউ নেই।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জুন মাসের একটা সমীক্ষা বলছে ৪০ শতাংশ ইসরাইলের মানুষ বিশ্বাস করেন, এই বসতি স্থাপন তাদের দেশকে নিরাপদ করেছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৭ শতাংশ।
অন্যদিকে জুন মাসের ওই জরিপে অংশ নেয়া ৩৫ শতাংশ মানুষ আবার মনে করেন, বসতি স্থাপনের কারণে ইসরাইলের নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগের জরিপে ওই পরিসংখ্যান ছিল ৪২ শতাংশ।
ইয়োনাতান মিজরাহি উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, পশ্চিম তীরের ইহুদি চরমপন্থীরা পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। একইসাথে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের অবসান ঘটানোর বিষয়টাকেও আগের চেয়ে কঠিন করে তুলছে।
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে ঘৃণা বাড়ছে।’
এই জাতীয় ঘটনায় বৃদ্ধি আগেই দেখা গিয়েছিল। কিন্তু গত ১০ মাসে এমন ১ হাজার ২৭০টা হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে জাতিসঙ্ঘ। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮৫৬।
ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থা বেটসেলেমের তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের কারণে অন্তত পশ্চিম তীরের ১৮টা গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরাইল ও জর্ডনের মধ্যবর্তী এই ফিলিস্তিনি অঞ্চল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে সময় দখল করেছিল ইসরাইল। তখন থেকে এই অংশ তাদের দখলেই রয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের আগস্ট মাসের মধ্যে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ৫৮৯ জন ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৫৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে ইসরাইলির বাহিনীর হাতে এবং অন্তত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বসতি স্থাপনকারীদের হাতে।
জাতিসঙ্ঘের মতে, এদের মধ্যে কেউ কেউ হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে জানা গিয়েছে, আবার এই তালিকায় নিরস্ত্র বেসামরিক লোকজনও রয়েছে।
আবার অন্য দিকে, ওই একই সময়ে ফিলিস্তিনিরা পাঁচজন ‘সেটলার’ বা বসতি স্থাপনকারী ও ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর নয়জন সদস্যকে হত্যা করেছে।
চলতি সপ্তাহে বেথেলহেমের কাছে ওয়াদি আল-রাহেলে বসতি স্থাপনকারী ও ইসরাইলি সেনারা প্রবেশ করে। সেখানে ৪০ বছরের এক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, এর আগেও কাছাকাছি থাকা একটা ইসরাইলি গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া হয়েছিল।
গত মাসে জিট গ্রামে জায়গা দখলের উদ্দেশ্যে ঢুকে পড়া কয়েক কিছু লোক তাণ্ডব চালালে ২২ বছরের এক ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক স্তরে নিন্দা করা হয়।
ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছ। তাদের পক্ষ থেকে একে ‘মারাত্মক সন্ত্রাসী ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কিন্তু এই পদক্ষেপ ‘দায়মুক্ত’ করার জন্য বলেই মনে করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
ইসরাইলি নাগরিক অধিকার গোষ্ঠী ‘ইয়েশ দিন’-এর তথ্য বলছে ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার ঘটনার আনুষ্ঠানিক তদন্তের পর মাত্র তিন শতাংশ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।
ইসরাইলি গণমাধ্যমে ফাঁস হওয়া রোনেন বারের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘লঘু আইনি পদক্ষেপই’ চরমপন্থী দখলদারদের ‘উৎসাহ’ দিয়েছিল।
‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’
পশ্চিম তীরের কিছু অংশে একচেটিয়াভাবে প্রতিষ্ঠিত ইহুদি সম্প্রদায়ের মাঝেই বাস করছে এই নতুন বসতি স্থাপনকারীরা।
এর মধ্যে অনেক বসতিতেই ইসরায়েলি সরকারের আইনি সমর্থন রয়েছে। অন্য বসতি যা ‘আউট পোস্ট’ বা ফাঁড়ি হিসেবে পরিচিত সেগুলো বেশিভাগই কাফেলা এবং লোহার তৈরি ছাউনির মতো সাধারণ।
এগুলো কিন্তু ইসরায়েলের আইনের চোখেও অবৈধ। কিন্তু চরমপন্থীরা আরো বেশি জমি দখলের করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো তৈরি করে।
জুলাই মাসে, যখন জাতিসঙ্ঘের শীর্ষ আদালত প্রথমবার জানতে পারে পূর্ব জেরুসালেম-সহ পশ্চিম তীরে ইসরাইলের দখল অবৈধ, তখন ওই দেশকে বসতি স্থাপন সংক্রান্ত সমস্ত কার্যকলাপ বন্ধ এবং যত দ্রুত সম্ভব সেনা প্রত্যাহার করতে কথা বলা হয়।
ইসরাইলের পাশ্চাত্যের মিত্ররা কিন্তু বারবার এই বসতি স্থাপনকে শান্তি আনার পথে অন্তরায় বলে আখ্যা দিয়ে এসেছে। ইসরাইল অবশ্য এই নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করে জানায়, ‘ইহুদিরা তাদের নিজেদের জমিতে কোনোভাবেই দখলদার নয়।’
এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের এই পদক্ষেপকে যাতে কোনোভাবেই বন্ধ না করা যায়, তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে চরমপন্থীরা।
ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্র-ডানপন্থী সরকারের সমর্থন পেয়ে ওই অঞ্চলে দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেছে।
পশ্চিম তীরে সংযুক্তির পরিকল্পনাকে আরো মজবুত করছে এই চরমপন্থীরা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে গাজায় বসতি স্থাপনের জন্য প্রকাশ্যে আহ্বানও জানাচ্ছে।
নতুন বসতি স্থাপনকারীদের অনেকেই এখন ইসরাইল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত।
একদিকে পশ্চিম তীরে এই বসতি স্থাপনের বিরোধিতাকারী বিশ্বনেতারা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য নতুন করে উৎসাহ দিচ্ছেন, শান্তি আনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপের কথা বলছেন।
আর অন্যদিকে ইসরায়েলের জাতীয়তাবাদীরা যারা বিশ্বাস করে এই পুরো জমি তাদের (ইসরায়েলের) মালিকানাধীন, তারা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্নকে ‘অসম্ভব’ করে তুলতে সচেষ্ট।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ কারণেই কিছু রাজনীতিবিদ যুদ্ধবিরতি চুক্তি মানতে নারাজ।
টাইমস অফ ইসরাইলের রাজনৈতিক সংবাদদাতা টাল স্নাইডার বলেন, ‘তারা সংঘাতের অবসান ঘটাতে চায় না বা জিম্মি চুক্তিতে যেতে চায় না কারণ তারা বিশ্বাস করে যে ইসরাইলের লড়াই চালিয়ে যাওয়া উচিত যতক্ষণ না তারা গাজার ভেতরে থাকতে পারে। তারা দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা পোষণ করেন এবং মনে করে তাদের মতাদর্শ বেশি ন্যায়সঙ্গত। এটা অবশ্য তাদের নিজস্ব যুক্তি।’
ইতোমধ্যে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ পাঁচটা নতুন বসতির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। এই তালিকায় রয়েছে বাত্তিরের বসতি এবং রাষ্ট্রের জন্য কমপক্ষে ২৩ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্র।
এর অর্থ হলো ইসরাইল এই জমিকে তাদের নিজেদের বলে মনে করে, তা সে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলেই হোক বা ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হোক কিংবা দু’টিই।
স্থলভাগে তথ্য পরিবর্তন করে এই দখলদাররা বিপুল সংখ্যক ইসরাইলিদের ওই জমিতে স্থানান্তরিত করতে চায় যাতে তাদের উপস্থিতির জানান দেয়া যেতে পারে। এবং দীর্ঘমেয়াদে এই ভূখণ্ডকে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা দখল করবে।
এদিকে, রাষ্ট্র অনুমোদিত ভূমি দখলের বাইরে চরমপন্থীরাও কিন্তু ওই অঞ্চলে দ্রুত বসতি স্থাপন করেছে।
হেবরনের উত্তরে আল-কানুবের একটা স্যাটেলাইট চিত্র অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে নতুন কাফেলা এবং রাস্তা নজরে এসেছে। ইতোমধ্যে ওই অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
ইব্রাহিম শালালদা (৫০) এবং তার ৮০ বছর বয়সী চাচা মোহাম্মদের সাথে আমরা আল-কানুবের দিকে রওনা হলাম। তারা আমাদের জানিয়েছিলেন কিভাবে গত বছরের নভেম্বরে বসতি স্থাপনকারীরা তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিয়েছে।
আমরা কাছাকাছি আসতেই একজন চরমপন্থী (ওই অঞ্চলে দখলদারদের মধ্যে একজন) তার গাড়ি নিয়ে আমাদের রাস্তা আটকায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সশস্ত্র ইসরাইলিরা সেখানে পৌঁছে যায়। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কয়েকজন সৈন্য এবং সেটেলমেন্ট সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তি তল্লাশির জন্য আমাদের থামায়।
সেটেলমেন্ট গার্ড আমাদের গাড়ির অন্য দুই যাত্রীকে (দুজন ফিলিস্তিনি) গাড়ি থেকে নামিয়ে তল্লাশি করেন। দু’ঘন্টা পরে, আইডিএফ সৈন্যরা বসতি স্থাপনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং আমাদের (গণমাধ্যমকর্মী) গাড়িকে যেতে দেয়া হয়।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগে জর্ডনের কাছ থেকে পশ্চিম তীর দখল করার পরপরই সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করে ইসরাইল। তারপর থেকে ক্ষমতায় আসা প্রতিটা সরকারই সেখানে ক্রমবর্ধমান বসতি সম্প্রসারণের অনুমতি দিয়েছে।
বর্তমানে সেখানে (ইসরাইল অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেম বাদে) আনুমানিক ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি ৫ লাখ ইহুদি ইসরাইলির সাথে ১৩০টারও বেশি বসতিতে থাকে।
তবে ২০২২ সালে দায়িত্ব নেয়া একজন সুপরিচিত উগ্র-ডানপন্থী সরকারি নেতা এই সংখ্যা দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
উগ্র-ডানপন্থী নেতা বেজালেল স্মোট্রিচ বিশ্বাস করেন, ওই জমিগুলোতে ইহুদিদের ‘সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত অধিকার’ রয়েছে। তিনি দুটি উগ্র-ডানপন্থী বসতি স্থাপনকারী দলের মধ্যে একটার প্রধান। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ২০২২ সালের নির্বাচনের পরে তাকে ক্ষমতায় আনেন।
স্মোট্রিচ অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করলেও তিনি একইসাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদাধিকারী, যা তাকে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার সুযোগ করে দিয়েছে।
নতুন রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোসহ এই বসতিগুলোতে রাষ্ট্রের অর্থ থেকে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছেন তিনি। দ্রুত বসতি নির্মাণের জন্য নতুন আমলাতন্ত্রও তৈরি করেছেন।
গোপনে রেকর্ড করা কথোপকথনে তাকে সমর্থকদের কাছে গর্ব করে বলতে শোনা গিয়েছে, তিনি সিস্টেমের ‘ডিএনএ পরিবর্তন’ করেছেন এবং পশ্চিম তীরে সংযুক্তির জন্য তার যে পদক্ষেপ তা ‘আন্তর্জাতিক এবং আইনি প্রেক্ষাপটে’ নিরিখে কার্যকর।
‘আমার জীবনের উদ্দেশ্য’
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীরা কয়েক দশক ধরে ইসরাইলি রাজনীতির একেবারে প্রান্তে ছিল। কিন্তু তাদের মতাদর্শ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের নির্বাচনে এই দলগুলো ১২০টা আসনের ইসরাইলি সংসদে ১৩টা আসন দখল করে। নেতানিয়াহুর ডানপন্থী জোটে ‘কিংমেকারে’ পরিণত হয় এই দলগুলো।
যুদ্ধের সময়, বেজালেল স্মোট্রিচ এবং সহকর্মী উগ্রপন্থী ইতামার বেন-গভির, বর্তমানে ইসরায়েলের জাতীয় সুরক্ষা মন্ত্রী, বারবার সামাজিক বিভাজনমূলক মন্তব্য করেছেন যা তাদের পাশ্চাত্যের মিত্রদের উসকে দিয়েছে।
এক ফিলিস্তিনি বন্দীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী ‘রিজারভিস্ট’ বা অতিরিক্ত বাহিনীভুক্ত সৈনিকদের গ্রেফতার করার পর বেন গভির বলেন, ‘আমাদের সেরা বীরদের’ গ্রেফতার করার পদক্ষেপ ইসরাইলের জন্য ‘লজ্জাজনক’।
চলতি মাসে স্মোট্রিচ বলেছিলেন, গাজাবাসীকে অনাহারে রাখা ‘ন্যায়সঙ্গত ও নৈতিক’ হতে পারে।
কিন্তু পশ্চিম তীর ও গাজায় উগ্র ডানপন্থীরা স্থায়ী পরিবর্তন আনতে চাইছে।
প্রবীণ ইসরাইলি সাংবাদিক ও দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদদাতা আনশেল ফেফার বলেন, ‘ইসরাইলিদের এই গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি বা ইসরাইলের অন্যান্য আরব প্রতিবেশীদের সাথে কোনো রকমের সমঝোতার বিরোধী।’
আর গাজায় যুদ্ধের কারণে উগ্র-ডানপন্থীরা নতুন সুযোগ পেয়েছে।
স্মোট্রিচ ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে ইসরায়েলিদের জন্য পথ প্রশস্ত হয়।
যদিও নেতানিয়াহু গাজায় ইহুদি বসতি পুনঃস্থাপনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও উগ্র-ডানপন্থী দলগুলোর সাথে তার বর্তমান সমীকরণ লক্ষ্যনীয়। তারা নেতানিয়াহুকে ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে যে তিনি যদি হামাসের হাতে আটক ইসরাইলি পণবন্দীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে ‘বেপরোয়া’ যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তবে এই জোট তারা ভেঙে দেবে।
চরমপন্থীদের যুক্তি হয়তো সংখ্যালঘু ইসরাইলিরাই অনুসরণ করে। কিন্তু এটা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে এবং নাটকীয়ভাবে পশ্চিম তীরের দৃশ্যপট বদলে দিচ্ছে- যা শান্তি স্থাপনের পথে বাধা হয়েও দাঁড়াচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি
No comments