গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ নিরাপত্তার বিধান বাতিল, কালোটাকা সাদা করার পথ বন্ধ, হজের অযৌক্তিক ফি কমানো ও নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার উদ্যোগসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী দিবসকে সামনে রেখে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে পরিবেশ বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সাংবাদিকদের এসব বিষয়ে ব্রিফ করেন। বলেন, একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, কালোটাকা সাদা করার যে বিধি ও রীতি সেটা বন্ধ করে দেয়া হবে। এখান থেকে সরকার যে টাকা আনতে পারে, সেটা দিয়ে সরকারের যে খুব আগায় তা না। তবে, মূল্যবোধটা বেশি অবক্ষয় হয়। ফলে এটার বিরুদ্ধে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, একটা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে। আগে যেমন একটা আদেশের মাধ্যমে বলে দেয়া হতো কালোটাকা সাদা করা যাচ্ছে। এখন আর সে রকম বলা হবে না, উল্টো বলা হতে পারে। অতিদ্রুত সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে।

বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিশেষ নিরাপত্তা বিধান বাতিল: বাতিল হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তায় প্রণীত আইন। যেটি বৈষম্যমূলক নীতি বলেই মনে করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই আইন বাতিল হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও তাদের সন্তানদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার সুবিধাটি আর থাকছে না। এ ছাড়াও এই পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথাও বলা ছিল। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমাদের এই সরকার হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আউটকাম। নিরাপত্তা সংস্থা এরকম বিশেষ নিরাপত্তার দরকার আছে বলে মনে করে না। আর এটাকে বৈষম্যমূলক মনে করা হয়েছে, সেটার ভিত্তিতে এটা রহিত করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সব বৈষম্য দূরীকরণে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েছে। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতেও বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, কেবল একটি পরিবারের সদস্যদের রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য আইনটি করা হয়েছিল, যা একটি ‘সুস্পষ্ট বৈষম্য’।

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর: এদিকে আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ সনদে স্বাক্ষর করেন। এ সময় অন্যান্য উপদেষ্টারা উপস্থিত ছিলেন। দেশে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক হারে গুমের শিকার হয়েছেন নাগরিকরা। আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী দিবসের একদিন আগে বিষয়টি নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নিলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর শেষে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এর আগে সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে ইতিমধ্যে হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করেছে। তদন্ত কমিশন আইন, ১৯৫৬ সালের ক্ষমতাবলে এই কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের’ জন্য এ কমিশন। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অল পার্সনস ফ্রম ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ সনদে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সই করেছেন। এটা মানবাধিকারকর্মীদের জন্য মাইলফলক। প্রায় সাতশয়ের ওপর মানুষ গুমের কারণে নিখোঁজ হয়ে আছেন। আর যেন কেউ কখনো নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে কোনো বাহিনীকে দিয়ে, কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো নাগরিককে গুম করতে না পারে, তার জন্য এ কনভেশনে স্বাক্ষর করেছি। সরকার এ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার করবেন। তিনি বলেন, মানবাধিকার নিয়ে শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়েছে। গুম বাংলাদেশে অহরহ ঘটেছিল, যেটা এ যাবতকালে অস্বীকার করা হয়েছিল। সরকারি পর্যায় থেকে ফ্যাসিবাদ কায়েম রাখার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে বিরুদ্ধ মতকে দমন করার জন্য গুম করে ফেলা হতো। সেটাতেও একটা শক্ত বার্তা গেল যে, এসব আর হবে না। গুম তো করার কথা না। সেটা করেছেন (হাসিনা সরকার) বলে আমাকে অবস্থান নিতে হয়েছে। সরকারি বাহিনীর জন্য গুম করার লাইসেন্স নেই। আইনগত এখতিয়ার নেই। যেসব বাহিনীর বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ কনভেনশনে অনুস্বাক্ষরের কাগজ জমা পড়ার পর থেকে কার্যকর হবে। আগের গুমের ঘটনা নিয়ে একটা কমিশন হয়েছে। সেখানে কার্যপরিধি বলে দেয়া হয়েছে। কাউকে কোথাও বাদ দেয়া হয়নি।
হজের অযৌক্তি ফি কমাতে উদ্যোগ: বর্তমানে হজের খরচ অযৌক্তিক বলে মনে করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাই হজের খরচ কমাতে উদ্যোগ নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, হজ একটা অনেক বড় ব্যাপার আমাদের বাংলাদেশি মুসলমানদের জন্য। হজের ক্ষেত্রে একটা সিন্ডিকেট দেখতে পাই। যেটা হজের প্যাকেজের মূল্য অনেক বাড়িয়ে দেয়। তাই হজের খরচ সেটি যেন যৌক্তিকভাবে কমানো যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে। কতো কমানো হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ রকম খরচের কোনো কথা হয়নি। তবে প্যাকেজটা যে অনেক বাড়তি এটা যে কমানো সম্ভব এটা দেখা গেছে প্রাথমিক বিশ্লেষণে এবং এ বিষয়ে কাজ করবে মন্ত্রণালয়।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কাজ করছে সরকার: সরকার অর্থক্ষেত্রে সংস্কারের অংশ হিসেবে কতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছে। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিতে যা যা করণীয় সরকার তা শুরু করে দিয়েছে। আগে আমাদের একটি পদ্ধতি ছিল জিও-এনজিও সমন্বয়। সেটা পুনরুজ্জীবিত (রিভাইভ) করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমরা দায়িত্বগ্রহণের সময় থেকে একমাসের মধ্যে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়, সরকার কী কী কাজ করেছে সেগুলোর ব্যাপারে একটা নোট করে আপনাদের (সাংবাদিক) দিয়ে দেবো।
এ সময় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সুবিধাভোগী অনেক কর্মকর্তা নিজেদের বঞ্চিত দাবি করে এই সরকারের সুযোগ-সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করছে- এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, বিষয়টা হচ্ছে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকলে তার ব্যাপারে আমরা আমাদের অবস্থান জানাচ্ছি। যেকোনো সরকারকে তার কাজ চালাতে গেলে ভালো কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর দরকার পড়ে। যদি আমরা দেখি কারও দক্ষতা আছে, তার ব্যাপারে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের তো কাজটা আগাতে হবে। এখন যদি আগের সময়ের কেউ ভালো পদে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা যদি অন্য কাউকেই নেবো এমন নীতিগত সিদ্ধান্তে চলে যাই, তাহলে কাজ আগাবো কেমন করে? সেটা বড় প্রশ্ন। কারও ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেটা জানাবো। এ রেজিম, সেই রেজিম, আগে রেজিম, পরে রেজিম বললে আমাদের সঙ্গে অন্যদের তফাৎটা কী? একটা তফাৎ আমাদের আনতে হবে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানাবেন। এ ছাড়াও বন্যা পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। বলেন, বন্য পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বন্যার কারণে রপ্তানিমুখী যেসব শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের যেন শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে, সেই জন্য সরকারের পক্ষে সহায়তার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.