আসক্তির নাম যখন ইন্টারনেট by মো: কফিল উদ্দিন চৌধুরী

ইন্টারনেটের বদৌলতেই পৃথিবী আজ যেন একটি নিরবচ্ছিন্ন একক গ্রাম। মানব সমাজে এর উপকারী ভূমিকা এতই ব্যাপক যে, তা স্বল্পপরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব। মূলত তথ্যপ্রাপ্তি, শিক্ষা, সামাজিক যোগাযোগ, গবেষণা ও বিনোদনের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাধ্যম এই ইন্টারনেট। এর ওপর আধুনিক মানব সমাজের নির্ভরশীলতার বাধ্যবাধকতার ফলে আমাদের হৃদয়ে প্রতিনিয়তই প্রতিধ্বনিত হয় যেন কবির সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই। দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।’ আবার প্রতিটি প্রদীপের নিচেই যেমন কিছু অন্ধকার থাকে, তেমনি ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারেরও রয়েছে ক্ষতিকারক প্রভাব। ইন্টারনেটের তেমনি এক প্রভাবের নাম তীব্র আসক্তি। ইন্টারনেটের অযাচিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে অনেকেই এর প্রতি তীব্রভাবে হয়ে পড়ে আসক্ত। তার মেধা-মনন ও চিন্তা-চেতনার সব কিছু আচ্ছন্ন থাকে ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল কালো মেঘে। শিক্ষাগত, পারিবারিক ও সামাজিক দায়দায়িত্ব পালনের চেয়ে ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই হয়ে ওঠে ‘অত্যাবশ্যকীয়’। এতে শিক্ষাগত জীবনে নেমে আসে ব্যর্থতা। পারিবারিক ও সমাজ জীবনে দেখা দেয় নানা টানাপড়েন। কর্মক্ষেত্রে নেমে আসে স্থবিরতা। বিয়ে বিচ্ছেদ ও কর্মক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতি যেন ইন্টারনেট আসক্তদের সাধারণ ব্যাপার। ভুক্তভোগী ব্যক্তির অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যাপক দৈন্যদশা।
দেখা দেয় একাকিত্ব ও হতাশা। এদের একটি বড় অংশই নিদ্রাহীনতা, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কোমর ব্যথা প্রভৃতি এক বা একাধিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আসক্তির পরিণামে আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক আত্মহত্যা কিংবা খুন করার ঘটনাও বিরল নয়। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে মাদকাসক্তির মতোই ইন্টারনেট আসক্তি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সাধারণত মানসিকভাবে অপরিপক্ব, উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজগামী শিক্ষার্থীরাই এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত। এক জরিপে দেখা যায়, ২.১ শতাংশ দক্ষিণ কোরীয় ও ১৩.৭ শতাংশ চীনা তরুণ-তরুণী এই মারাত্মক সমস্যায় আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এই সমস্যায় আক্রান্তদের হার যথাক্রমে ১.৫ ও ৮.২ শতাংশ। বাংলাদেশে ব্যাপকতা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত ব্যাপক কোনো জরিপ করা হয়নি। ২০১৫ সালে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ৪০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে করা এক সংক্ষিপ্ত জরিপে দেখা যায়, ২৫.৩ শতাংশ ইন্টারনেটের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ২০১৬ সালে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬০ মিলিয়ন ও মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আর এই ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশই সদ্য বয়োপ্রাপ্ত কিংবা তরুণ-তরুণী। কাজেই আমাদের দেশে এই সমস্যা যে নিকট ভবিষ্যতে মহামারী রূপ ধারণ করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত ইন্টারনেটের অপব্যবহারের ফলে আজ বিশ্বব্যাপী অবৈধ যৌনাচার, অশ্লীলতা, ভার্চুয়াল সম্পর্ক, কম্পিউটার খেলা, তথ্যপ্রাপ্তি, অনলাইন জুয়া প্রভৃতির প্রতি অন্যায় অপরাধ যেন এক বৈশ্বিক রূপ পেয়েছে। নতুন প্রযুক্তির প্রতি তীব্র কৌতূহল, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শৈশব ও কৈশোর, সামাজিক ও পারিবারিক টানাপড়েন, মাদকাসক্তি, নৈতিক অবক্ষয়, একাকিত্ব, উপযুক্ত সামাজিক ও পারিবারিক সাপোর্টের অভাব, ব্যক্তির আচরণগত সমস্যা, ইন্টারনেটের সহজপ্রাপ্যতা, সঙ্গদোষ, ইন্টারনেট ব্যবহারে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাব প্রভৃতি এই সমস্যার বড় কারণ। পিতা-মাতা সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি সন্তানকে যথেষ্ট সময় আর নৈতিক শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে এই সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সেই সাথে সমাজ তথা শিক্ষাজীবনে নৈতিক শিক্ষার প্রচলন, সুস্থ বিনোদনের পরিবেশ এবং ইন্টারনেটের পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেটের ব্যবহার যাতে অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত না হয়, সেজন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে। আবার হতাশা, মাদকাসক্তি, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা প্রভৃতি মানসিক রোগ যেহেতু এই সমস্যা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে; তাই এসব রোগের যথাযথ চিকিৎসা একান্ত প্রয়োজন। ইন্টারনেট আসক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে যোগ্য মনোসামাজিক সাপোর্টের পাশাপাশি উপযুক্ত চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে একজন মনোচিকিৎসক গুরুত্বপূর্ণ পথ প্রদর্শক হতে পারেন। রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকপর্যায়ে ইন্টারনেটে যৌনতা, জুয়া ও আসক্তি সৃষ্টিকারী খেলা তৈরি ও প্রচারের সাথে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। সরকারের পাশাপাশি নানা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এই ইন্টারনেট আসক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ও অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক : সরকারি চিকিৎসক
kafil_cmc@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.