খেলাপি ঋণের দায় কার? by ইকতেদার আহমেদ

বাংলাদেশে দুই ধরনের বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। এর একটি হলো রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং অপরটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলধনের জোগানদাতা সরকার, অপর দিকে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলধনের জোগানদাতা উদ্যোক্তা পরিচালকগণ। যে পরিমাণ মূলধন নিয়ে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়, পরবর্তীকালে ব্যাংকে আমানতকারীদের আমানতের পরিমাণ ও ঋণগ্রহীতাদের ঋণের পরিমাণ বাড়লে পর্যায়ক্রমে মূলধনেরও পরিমাণ বাড়ে। মূলধন বাড়ানো একটি চলমান প্রক্রিয়া। বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা পরিচালকগণ মূলধনের ১০ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকেন। বর্তমানে প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংকে আমানতকারীদের যে পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে, উদ্যোক্তা পরিচালকদের মূলধনের সাথে তার হিসাব করলে এর অনুপাত দাঁড়ায় ৯৭.৫ : ২.৫। একজন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে বাধা থাকায় বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের দেখা যায়, সমঝোতার ভিত্তিতে এক ব্যাংকের পরিচালক অপর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিচালক সমন্বয়ে গঠিত। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা সরকারের নিয়োগ পান। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে উদ্যোক্তা পরিচালকদেরই প্রাধান্য। পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্য থেকে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য যিনি, তাকে নির্বাচিত করা হয়। অতীতে একজন উদ্যোক্তা পরিচালক তিন বছর ব্যাপ্তিকালের দুই মেয়াদে অর্থাৎ ছয় বছর দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। বর্তমানে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করে পরিচালকদের তিন বছর ব্যাপ্তিকালের পরপর তিন মেয়াদে অর্থাৎ ৯ বছর পদে বহাল থাকার বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। অতীতে একই পরিবারের দু’জনের অধিক একসাথে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। সম্প্রতি আইন সংশোধন করে এ সংখ্যাটি ২ থেকে বাড়িয়ে ৪ করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ বড় অঙ্কের ঋণগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে। মাঝারি ও ক্ষুদ্রপর্যায়ের ঋণ অনুমোদনের ব্যাপারে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের অনুমোদন দেয়া আছে। ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপকেরা যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করেন, পরিচালনা পর্ষদের ক্ষেত্রে প্রায়ই তার ব্যাঘাত পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। এ খেলাপি ঋণের একটি অংশ অনাদায়যোগ্য হওয়ার কারণে অবলোপন করা হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত বা বাণিজ্যিক ব্যাংক একজন ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিতে হলে তাকে নির্ধারিত আইন ও বিধিবিধান মেনে ঋণ দিতে হয়। জামানত ছাড়া কোনো ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দেয়ার সুযোগ নেই। বড় অঙ্কের ঋণের ক্ষেত্রে স্থাবর সম্পত্তি অথবা স্থাবর সম্পত্তির ওপর নির্মিত স্থাপনা বন্ধক রেখে ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত বন্ধকী সম্পত্তির মালিকানা রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে ব্যাংক বরাবর হস্তান্তর করা হয়। ঋণ অনুমোদনের আগে ব্যাংকের কর্মকর্তারা বন্ধকী সম্পত্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে এর ওপর স্থাপনা পরিদর্শন করে এর মূল্য নিরূপণ করেন। বন্ধকী সম্পত্তির মালিকানা বিষয়ে ব্যাংকের আইন শাখা ও আইন উপদেষ্টার মতামত নেয়া হয়। একজন ঋণগ্রহীতাকে ঋণ নেয়ার সময় যেসব কাগজপত্র দাখিল করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো জমি খরিদের দলিল, নামজারি ও জমা ভাগ এবং হালনাগাদ খাজনার দাখিলা। রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক বন্ধকী সম্পত্তির মূল্যমানের এক-তৃতীয়াংশ থেকে এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ অঙ্কের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঋণ দেয়ার কথা থাকলেও প্রায়ই এর ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হয়। উদ্যোক্তা পরিচালক ও বড় ধরনের প্রভাবশালীরা ঋণ নেয়ার সময় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বন্ধকী সম্পদের মূল্যমানের ২-৪ গুণ অধিক পরিমাণ অর্থ ঋণ নিয়ে থাকেন। এ ধরনের ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ না করা হলে অচিরেই দেখা যায় সুদে-আসলে ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এ ধরনের অনেক ঋণগ্রহীতা তাদের গৃহীত ঋণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে সম্পদ কেনায় ব্যয় করছেন। এদের বিদেশী নাগরিকত্ব রয়েছে এবং দেশে ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে এরা বিদেশে পাড়ি জমানোর জন্য সদাপ্রস্তুত। এ ধরনের অনেক ঋণগ্রহীতা ইতোমধ্যে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এবং ব্যাংকের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বড় অংশের সাথে যারা সম্পৃক্ত, এদের অনেকেই সমাজের বিশিষ্টজন এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। অপর অংশটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ঋণ পেতে সফল হয়েছেন। বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, যেসব ক্ষেত্রে বন্ধকী সম্পদের মূল্যমানের চেয়ে ঋণের পরিমাণ অধিক সেসব ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালক বা উভয়ে, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইন শাখার কর্মকর্তা, আইন উপদেষ্টা প্রভৃতি অবৈধ অর্থ দিয়ে বশীভূত হয়ে অন্যায়ভাবে ঋণ দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এ ধরনের ঋণগ্রহীতারা মঞ্জুর করা ঋণের ২০-৩০ শতাংশ উপরোক্তদের উৎকোচ দিয়ে থাকেন। এর একটি অংশ ঋণ মঞ্জুরের আগে এবং অবশিষ্টাংশ ঋণের কিস্তির অর্থ ছাড় করার সময় দেয়া হয়। ব্যাংক খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত, বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংক কাগজে-কলমে যে পরিমাণ অর্থ খেলাপি ঋণ হিসেবে প্রদর্শন করছে।
প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এর চেয়ে অধিক। হিসাবে গরমিল ও হেরফের করে তারা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র জনসম্মুখে উপস্থাপনে অনীহা। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে তৎপর দেশের জনমানুষসহ সাধারণ আমানতকারীদের ধারণা দেয়ার জন্য তারা মামলা দায়েরের মাধ্যমে অনাদায়ী অর্থ আদায়ে সচেষ্ট, এমন মনোভাব প্রদর্শন করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় দুর্বলভাবে মামলা পরিচালনা এবং আইনি জটিলতার কারণে মামলা দায়ের করে কাক্সিক্ষত প্রতিকার পাওয়া যায় না।এমন অনেক ঋণ রয়েছে, যেগুলো গ্রহণের সাথে জালিয়াতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। এ ধরনের অনেক জালিয়াতির সাথে ব্যাংকের চেয়ারম্যান, কিছু পরিচালক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যবস্থাপক সম্পৃক্ত থাকলেও ত্রুটিপূর্ণ তদন্তের মাধ্যমে মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করায় প্রকৃত অপরাধীরা পর্দার আড়ালে থেকে যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রয়েছে। উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে যে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা দেয়া হয়, তার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। দুই দশক ধরে দেখা গেছে, খেলাপি ঋণ প্রতি বছর ক্রমে স্ফীত হয়েছে এবং এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা সঠিক হয়ে থাকলে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আর তাই এর দায় থেকে সংশ্লিষ্ট দু’টি প্রতিষ্ঠানও অবমুক্ত নয়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আট হাজার কোটি টাকার অধিক অর্থ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পাচার সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা সংঘটন-পরবর্তী দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এর সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট যারা সম্পৃক্ত তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ সময়ে ব্যাংকটির গভর্নরের দায়িত্বে যিনি ছিলেন; তাকে অপসারণ করা হলে তিনি তার আগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে আসেন। এ ধরনের ব্যক্তি যিনি এত বড় অঘটনের সময় ব্যাংকটির শীর্ষ পদে আসীন ছিলেন এবং অঘটন-পরবর্তী এটি যেন জনসম্মুখে প্রচার না পায়, সে বিষয়ে সে সময় তার তৎপরতাকে আমলে নেয়া হলে এরূপ ব্যক্তির প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় পুনঃপ্রত্যাবর্তন নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটুকু সমর্থনযোগ্য তা বিবেচনার দাবি রাখে। এ ধরনের ঘটনা ব্যাংক খাতে জালিয়াতিকে উৎসাহিত করে ঋণখেলাপি হওয়ার পথ যে প্রশস্ত করে তা এ দেশের সচেতন মানুষ অনুধাবনে সক্ষম। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্ণধারসহ আরো কিছু ব্যাংকের শীর্ষ কর্ণধারের অপতৎপরতা, অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে এ দেশে বড় ধরনের ঋণজালিয়াতি ও ঋণখেলাপির ঘটনা সংঘটিত হলেও এদের বিরুদ্ধে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় এরা দায়মুক্ত ভাব নিয়ে মাথা উঁচু করে সমাজে চলাফেরায় উদ্যত। অথচ এদের মধ্যে ন্যূনতম বিবেকবোধ ও দায়িত্বজ্ঞান থাকলে এরা লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষার প্রয়াস নিতেন। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের কারণে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আজ অনাদায়যোগ্য, এ অর্থের মালিক এ দেশের সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ও সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারণে এর আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা তাদের ন্যায্য লাভ ও মুনাফা থেকে বঞ্চিত হলেও ঋণখেলাপির সাথে যারা সম্পৃক্ত, তারা অনেকটা দায়হীন থেকেই দেশ ও বিদেশে অবৈধভাবে আহরিত সম্পদ সুরক্ষায় নিয়োজিত। এভাবে চলতে থাকলে এ দেশের ব্যাংক খাতে ধস নেমে তা দেশের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসবে। আর তাই সময় থাকতে ঋণখেলাপির দায় যাদের ওপর বর্তায়, তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তিবিধান প্রত্যাশিত নয় কি?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.