সিরিয়ায় আরেকটি গণহত্যার সাক্ষী বিশ্ববাসী by ঈশান থারুর

সিরিয়ার পূর্ব গৌতায় অসংখ্য মানুষের করুণ মৃত্যুতে মানবতা আজ বিপন্ন। সেখানে প্রতি মুহূর্তে বৃষ্টির মতো মানুষের লাশ পড়ছে। রাজধানী দামেস্কের বাইরে এটি নিকটস্থ অবশিষ্ট সর্বশেষ ভূখণ্ড। এটা পাঁচ বছর ধরে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। অবরুদ্ধ করে সেখানকার মানুষের ওপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করা হচ্ছে। বোমার আঘাতে বাড়িঘর ও জনবসতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আর যেসব হতভাগ্য মানুষ এখনো সেখানে জীবিত, ক্ষুধা ও অনাহারে তারা মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুনছেন। গত নভেম্বরে সেখানে সর্বশেষ মানবিক সহায়তা কনভয়ের আগমন ঘটেছিল। এলাকাটি বিরামহীন আক্রমণের মধ্যে রয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টে আমার সহকর্মীরা রিপোর্ট করেছেন : সিরীয় সরকার এবং তাদের রুশ মিত্ররা গত সপ্তাহের পর থেকে এ পর্যন্ত গৌতার পূর্বাঞ্চলে জঙ্গিবিমান, ড্রোন ও হেলিকপ্টারের মাধ্যমে হাসপাতাল, স্কুল এবং আবাসিক ভবনে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্রোহী তথা সরকারবিরোধীদের অধিকৃত এলাকায় প্রায় চার লাখ লোক আটকা পড়েছে। তারা জীবন বাঁচানোর জন্য অট্টালিকার ভূগর্ভস্থ অংশে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছে। জীবন রক্ষাকারী বিপুল ওষুধ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। চিকিৎসকেরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরা এবং সাহায্য সংস্থাগুলো জানিয়েছে, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বিমান হামলা চালিয়ে তিন শতাধিক লোককে হত্যা ও শত শত লোককে আহত করা হয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না, পূর্ব গৌতায় ২০১৩ সালে সিরীয় সরকার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে কয়েক শ’ লোককে হত্যা করেছিল। কিন্তু বর্তমান মুহূর্তগুলো আরো ভয়ঙ্কর। পূর্ব গৌতার একটি হাসপাতালের পরিচালক সিএনএনকে বলেন, ‘আমরা গৌতায় পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিমান হামলার সাথে পরিচিত। এটা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু আমরা এবারের মতো ব্যাপক হামলা আগে কখনো দেখিনি।’ আমার সহকর্মী লুসিয়া লাভলক লিখেছেন, ‘পূর্ব গৌতায় মৃতের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। ওই ভূখণ্ডটির প্যাথোলজিস্ট এবং কবর খোঁড়ার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, সহিংসতা জোরদার হওয়ার আগে তাদেরকে ২০ থেকে ৫০টি কবর খুঁড়তে হয়েছে। এক ব্যক্তি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণভাবে চাপা দিয়েছি বা ঢেকে ফেলেছি। গণকবরে লাশের বিভিন্ন অংশ ছুড়ে ফেলেছি।’ এই সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহল থেকে নিন্দার ঝড় উঠেছে। পশ্চিমা কলামিস্টরা এই হত্যাকাণ্ডকে স্রেব্রেনিসার যুদ্ধাপরাধের মতোই অপরাধ বলে উল্লেখ করে নিন্দা করেছেন। পশ্চিমা সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে জাতিসঙ্ঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে আর্তনাদ করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস পূর্ব গৌতার পরিস্থিতিকে ‘পৃথিবীর জাহান্নাম’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বহুবার এই বিরোধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। গুতেরেস বলেন, সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আমার আবেদন- পূর্ব গৌতায় অবিলম্বে যুদ্ধ ও এর তৎপরতা স্থগিত করুন। সেখানে প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা যাতে দ্রুত পৌঁছতে পারে, সে জন্য সহায়তা করুন। তিনি আরো বলেন, ‘পূর্ব গৌতা আর অপেক্ষা করতে পারছে না।’ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোনোভাবে বন্ধ করা যাবে না।’ বিদ্রোহী গ্রুপ বেসামরিক লোকদের ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে দাবি করে দামেস্ক কর্তৃপক্ষ তাদের নাগরিকদের দুর্দশাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকার পূর্ব গৌতায় চূড়ান্ত হামলা চালানোর কারণে হামলার শুরুতেই হয়তো বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সরকারের অভিমত হচ্ছে, ইসলামপন্থী বিদ্রোহী গ্রুপ ঠিক যেন সন্ত্রাসী হিসেবে ভূখণ্ডটিকে দখল করে রেখেছে। সিরীয় বার্তা সংস্থা সানা দাবি করে, গত দুই দিনে এই উপদল অনেকবার রকেট এবং কয়েক দফা মর্টার হামলা চালায়।
তাদের হামলায় দামেস্কের পাশের এলাকাগুলোতে বেশ কিছু লোক নিহত হয়েছে। এই দৃশ্য ২০১৬ সালে বিদ্রোহী অধিকৃত আলেপ্পো পুনর্দখলের জন্য সরকারের ধীর ও ধ্বংসাত্মক হামলার মতোই। ওই সময় সিরীয় ও রুশ কর্মকর্তারা তাদের ভাষায় ‘ইসলামি’ চরমপন্থীদের কাছ থেকে শহরটি মুক্ত করাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং বেসামরিক লোকদের মুক্ত করে তাদের কাছে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ায় উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তখনকার মতো অবরুদ্ধ এলাকার ভেতর থেকে যে ফুটেজ ও ছবি পাওয়া যাচ্ছে,তা ভিন্ন কাহিনীর ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে, পাশের সব কিছু নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে এবং গোটা পরিবারকে মুছে দেয়া হচ্ছে। আহত শিশুদের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে একাকী নিভৃত স্থানে রাখা হচ্ছে। এর লক্ষ্য কী? সবার মাথার ওপরে আলেপ্পোকে ধ্বংস করার মতোই কি গৌতাকে ধ্বংস করা হবে? সরকারবিরোধী বিখ্যাত এক ব্যক্তি ওসামা নাসের আমার সহকর্মীদের কাছে এই প্রশ্ন করেছেন। ক্রসফায়ারের সময় বেঁচে যাওয়া যেসব ব্যক্তিকে ধরা হয়েছে- তাদের কী হবে, সেটা নিয়েই এখন তারা বেপরোয়া। সিরিয়ার অলাভজনক গ্রুপ ওম্যান নাউ ফর ডেভেলপমেন্টের ত্রাণকর্মী হুদা কায়াতি বলেন, ‘সেখানে বহু গণহত্যা হয়েছে। ভবনের ভূগর্ভে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার কথা বলতে পারব না। কারণ, বোমা হামলা চালানোর পর ছাদের নিচে কত লোকের মৃত্যু হয়েছে তা আমি ধারণা করতে পারি না।’ মালেক নামক একজন চিকিৎসক মিডলইস্টআই ওয়েবসাইটকে বলেন, ‘আমাদের কাছে বেশি অ্যাম্বুলেন্স ছিল না, যাতে আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়া যায়। এর অর্থ হলো, আমাদের কাছে নিয়ে আসার আগেই বহু লোক মৃত্যুবরণ করেছে। হাসপাতালে রক্তবন্যা বয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আহতদের সহায়তায় আমরা কী করতে পারি? পরিস্থিতি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।’ স্থানীয় কাউন্সিলের সাবেক সদস্য ২৬ বছর বয়সী নাজির ফালিতানি বাজফিডকে বলেন, ‘গতকাল সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, সব ধরনের যুদ্ধবিমান গৌতায় গুলি বর্ষণ করছে। আর্টিলারি ও রকেট লঞ্চারের গোলাবর্ষণ কখনো বন্ধ হবে না। আমরা রাস্তায় যেতে পারি না। সব দোকান বন্ধ। আমরা নৈরাজ্যের মধ্যে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছি।’ ওই নৈরাজ্যের ফলাফল অত্যন্ত মারাত্মক হতে পারে। সাহায্য গ্রুপগুলো আটকে পড়া যুবক, বয়স্ক লোক ও শিশুদের ব্যাপক হতাশার কথা উল্লেখ করে জানিয়েছে, কেউ কেউ এমনকি আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছে। পরিস্থিতির কারণে পূর্ব গৌতার মানুষ মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বেশির ভাগ শিশু হত্যার শিকার এবং আহত অথবা নিখোঁজ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতি সেখানকার মানুষের ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। যুবকদের কেউ কেউ আত্মহত্যায় প্ররোচিত হচ্ছে। বয়স্ক লোকেরা হতাশায় ভুগছেন। ‘আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটি’র সাথে সম্পৃক্ত একজন মেডিক্যাল কর্মী লিখেছেন, ‘কেউ সুখে নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমি এবং আমার পরিবার অব্যাহত চাপ ও হতাশার মধ্যে আছি। প্রতিদিন প্রার্থনা করি এবং আশা করি, যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয়, পূর্ব গৌতা থেকে চলে যাই, এমনকি সিরিয়ার বাইরে চলে যাওয়ার চিন্তা আমাকে পেয়ে বসে। সত্যিই এখন আমি ভাবতে পারি না যে, আমাদের জন্য ভালো ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’
লেখক : পররাষ্ট্রবিষয়ক নিবন্ধকার
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

No comments

Powered by Blogger.