ট্রাম্পিজম ও গণতন্ত্রের গোধূলি by মারুফ মল্লিক

ট্রাম্প সাহেব হামেশাই বিশ্বকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। ওদিকে ইউরোপে লোকরঞ্জনবাদীরা অভিবাসীদের বের করে দেওয়ার কথা বলছে। ভারতেও শিবসেনারা কম যায় না। চীনের সি চিন পিং আজীবন ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত পাকা করলেন বলে। কয়েকটি দেশে আবার উন্নয়নের জন্য সীমিত গণতন্ত্রের কথাও বলা হচ্ছে। আরবে তো গণতন্ত্রই নেই। জার্মানিতে লোকরঞ্জনবাদীদের উত্থান বা যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় কিংবা ব্রেক্সিটের পর একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে, গণতন্ত্র কি গোধূলিলগ্নে উপনীত? প্রশ্ন যখন সামনে হাজির, তখন চলমান বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এর উত্তর খোঁজাও জরুরি। ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক মডেল কি এক সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে? হার্ভার্ড তাত্ত্বিক ইয়াশা মৌঙ্ক ট্রাম্পের বিজয়, ব্রেক্সিটে ইউরোপীয় বিরোধীদের জয়লাভ বা ইউরোপজুড়ে লোকরঞ্জনবাদের উত্থানকে চিহ্নিত করেছেন অগণতান্ত্রিক উদারতাবাদের পর্ব হিসেবে। তিনি মনে করেন, আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বেশ কিছু দিন উদার গণতন্ত্রের চক্রে আটকে ছিল। উদার গণতন্ত্রের ঝুঁকি হচ্ছে, এটি কখনো কখনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূচনা করতে পারে। মৌঙ্ক ভোটের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের নাম দিয়েছেন ‘ট্রাম্পিজম’। এই কর্তৃত্ববাদী অগণতান্ত্রিক উদাররা বিরোধী মতকে উপেক্ষা করে। আইনের শাসন, বাক্‌স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা সংখ্যালঘুর অধিকারকে পুরোপুরি অস্বীকার করে না। তবে সীমিত করে দেয়। নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। ইউরোপজুড়ে লোকরঞ্জনবাদীদের উত্থান বা ট্রাম্পের বিজয় কিন্তু এই রকম একটি রাজনৈতিক ধারার বিকাশকেই স্পষ্ট করে দেয়। কারণ, কখনোই বলা যাবে না যে ট্রাম্প অগণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। বা ইউরোপে লোকরঞ্জনবাদীরা ভোটকেন্দ্র দখল করে নিজেদের পক্ষে ব্যালটে সিল মারছে। বা এদের কেউ বিনা ভোটে জয়লাভ করেছে। এরা জনসাধারণের ভোটেই নির্বাচিত হচ্ছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক দলগুলোর ভোট কমে যাচ্ছে কেন? তত্ত্ব ও দর্শন হিসেবে ইউরোপীয় গণতন্ত্রের মডেলকে বাতিল করার সময় আসেনি এখনো। বরং অনেকেই সমস্যা খুঁজে পাচ্ছেন এর প্রায়োগিক পদ্ধতিতে। উদার গণতন্ত্র ও লোকরঞ্জনবাদকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলেই মনে করা হচ্ছে। আসলে মূল সমস্যা অর্থনৈতিক। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে উদার গণতন্ত্রের সুযোগ নেয় লোকরঞ্জনবাদীরা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন হতে পারে এর একটি চমৎকার উদাহরণ।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সমন্বয় ছাড়াই একটি একক বাজার ও মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন করেছে। এই একক বাজার ও মুদ্রা সম্পর্কে আবার সিদ্ধান্ত আসছে টেকনোক্র্যাটদের পক্ষ থেকে। ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ইউরোপীয় আদালত টেকনোক্র্যাটদের সিদ্ধান্ত জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এখানে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে জনসাধারণের একধরনের দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে। এ কারণেই ইউরোজোনের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার পরও ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ব্রেক্সিটের পক্ষাবলম্বনকারীদের স্লোগানই ছিল ‘নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আন নিজের হাতে’। ইউরোপজুড়ে একই মানসিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ, ব্রাসেলস থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত পোল্যান্ডের প্রত্যন্ত এলাকার জনসাধারণ মানবে কেন? ব্রাসেলস যখন পোল্যান্ডের শ্রমবাজারের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে দেয়, কৃষিতে ভর্তুকির হার নির্ধারণ করে দেয়, তখন জনসাধারণ বিকল্প পথের সন্ধান করে। এই এই বিকল্প পথেরই সুযোগ নেয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো চতুর লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিবিদেরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা ঠিক ইইউয়ের মতো নয়। তবে সেখানেও শাসনব্যবস্থায় জনসাধারণের মতামত প্রতিফলিত হচ্ছে না বলেই ট্রাম্পের মতো চটকদার প্রার্থীকে ভোটাররা বেছে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন সংস্থা বা এজেন্সির মাধ্যমে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এসব সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের আগে জনসাধারণের মতামত শোনাও হয় না অনেক সময়। এসব দিক বিবেচনায় বলা যায়, উদার গণতন্ত্রের নামে যে মডেল এখন অনুসরণ করা হচ্ছে, ঐতিহ্যগতভাবেই তা ঝুঁকিপূর্ণ একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। এটি সমাজে রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির ভারসাম্য আনতে পারছে না। অভিজাত ও আমজনতার দূরত্ব থেকেই যায়। কারণ, রাজনৈতিক অভিজাতরা যখন ক্ষমতা হস্তগত করে জনসাধারণের মতামতকে এড়িয়ে যায়, তখনই উদার গণতন্ত্রের অগণতান্ত্রিক উদারবাদের দিকে মোড় নেওয়ার ঝুঁকি থাকে। ইউরোপে যদিও ইতিমধ্যেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও বিভাজন করে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে একধরনের ভারসাম্য আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, আইনের শাসন বিদ্যমান। সংখ্যালঘুর মতামতকেও যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারেই বিবেচনা করা হয়। এরপরও কোথায় যেন একটি ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এই ঘাটতি হচ্ছে রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতির সমন্বয়ের ঘাটতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে অপেক্ষাকৃত জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের দিকে যাত্রা করে ইউরোপ লোকরঞ্জনবাদী নাজি বা ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দর্শন থেকে বেরিয়ে আসে। বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, গত শতকের ৯০ দশকের শুরু থেকে যখন সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন সুবিধা হ্রাস করা হয়; এরপর থেকেই লোকরঞ্জনবাদের আবার প্রসার ঘটতে থাকবে। মূলত ওই দেশগুলোতেই দ্রুত লোকরঞ্জনবাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে সামাজিক নিরাপত্তায় কাটছাঁট করা হয়েছে এবং অভিবাসনের হার বেড়েছে। তাই সবকিছু বিবেচনায় বলা যায়, গণতন্ত্রের দিন শেষ—এই ধরনের মন্তব্য অনেকটা আগ বাড়িয়েই করা হচ্ছে। মূলত জনকল্যাণমূলক নীতি থেকে সরে গিয়ে মুনাফানির্ভর অর্থনৈতিক নীতিই গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ঠেলে নিয়েছে। তাই সময়ে এসেছে এমন ধরনের জননীতি প্রণয়নের, যেখানে আমজনতার আর্থিক নিশ্চিত হবে। সমাজ মূলত দুই ভাবে বিভাজিত। প্রথমত পরিচয়গত বিভাজন। যেমন ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক বা আদর্শ ভিত্তিক বিভাজন। অপরটি হচ্ছে অর্থনৈতিক। ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য। গণতন্ত্রের ইউরোপীয় মডেল সেই বিভাজন ঘুচিয়ে এনেছে সোশ্যালিস্ট কাঠামোর প্রয়োগের মাধ্যমে অনেকটাই। তবে সমস্যা হচ্ছে এই সোশ্যালিস্ট কাঠামো থেকে গণতন্ত্রীরা যখন সরে বাজার অর্থনীতির দিকে যায়, তখনই উদার গণতন্ত্রের সুযোগে লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষমতার নিকটবর্তী হয়। কখনো কখনো ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতেও চলে আসে।
ড. মারুফ মল্লিক, রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি

No comments

Powered by Blogger.