সহসাই রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার ইঙ্গিত নেই -এপির রিপোর্ট

ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সহসাই তাদের দেশে ফিরে যাচ্ছেন এমন ইঙ্গিত নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এরই মধ্যে। কিন্তু প্রক্রিয়ায় এখনও রয়েছে অস্পষ্টতা। রয়ে গেছে ঝুুঁকি। স্যাটেলাইটে ধারণ করা নতুন সব ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।
তাতে দেখা যায়, গ্রাম-গাঁ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা আগে যেসব স্থানে বসবাস করতেন তার প্রমাণ মুছে দেয়া হয়েছে। ২৫শে আগস্টের পর প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু এখনও তাদের ঢল থামছে না। আরো রোহিঙ্গা আসছেন পালিয়ে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতি কাজ করছে। তাদের অনেকেই বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে যেতে চান না। অন্যদিকে আশ্রয়শিবিরে নানা জটিলতায় তাদের দুর্ভোগ বাড়ছে। বার্তা সংস্থা এপির এক রিপোর্টে এসব কথা বলা হয়েছে। এ রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গাদের ঘরগুলো প্লাস্টিক শিটে নির্মিত। তাদের বেশির ভাগ খাবার আসে সাহায্য সংস্থার পক্ষ থেকে। হাতে কোনো কাজ নেই। তাদের কিছু করার মতো পথও নেই। তবে আছে আতঙ্ক, ভীতি। এই ভয়াবহতার শুরু ছয় মাস আগে। কক্সবাজারের কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নিয়েছেন মোহাম্মদ আমানুল্লাহ। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে দেশছাড়া হওয়ার সামান্য আগে তার গ্রাম ধ্বংস করে দেয়া হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা শান্তিতে আছি। যদি বাংলাদেশ আমাদেরকে ফেরত পাঠাতে রাজি হয়, তা তো ভালো কথা। কিন্তু বিষয়টি কি এত সোজা? আমাদেরকে নাগরিকত্ব দিতে হবে মিয়ানমারকে। মিয়ানমার আমাদের ঠিকানা। নাগরিকত্ববিহীন সেখানে গেলে তারা আমাদেরকে আবারও নির্যাতন করবে। আবারও হত্যা করবে। তিনি জানান, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তার অধীনেই কেবল তিনি ফিরে যেতে চান। মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বলেন, মিয়ানমারে আমাদেরকে নিরাপত্তা দিতে হবে। তা না-হলে আমাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে কোনো ফল হবে না। উল্লেখ্য, বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে নিজের দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তাদেরকে সরকারিভাবে কোনো জাতি হিসেবেও স্বীকৃতি দেয় না। উল্টো তাদের ওপর রয়েছে তীব্র বৈষম্য ও নির্যাতন। ওদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এম. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, কোনো রোহিঙ্গাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাবে না বাংলাদেশ। তবে তিনি টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে আহ্বান জানান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি। এখনও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছেন- এমন খবরে অসন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি। বার্তা সংস্থা ইউএনবি তার বক্তব্য উদ্ধৃত করে রোববার একটি রিপোর্ট দিয়েছে। তাতে বলা হয়, শাহরিয়ার আলম বলেছেন- আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে যে, সমস্যার মূল নিহিত রয়েছে রাখাইনে। ফলে সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে সেখানে। অন্যায্যভাবে সেখানকার ভার টানছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে এপির রিপোর্টটি লিখেছেন তোফায়েল আহমেদ ও জুলহাস আলম। এতে তারা লিখেছেন, রোববার কক্সবাজারে আশ্রয় শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছেন দু’জন নোবেলজয়ী। তারা কথা বলেছেন ধর্ষিতাদের সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে হামলার সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নারী ও বালিকাদের ধর্ষণ করেছে। কক্সবাজারে ওই আশ্রয় শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন ইয়েমেনের নোবেলজয়ী তাওয়াক্কুল কারমান ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের মাইরিড মাগুইরে। তাদের সঙ্গে ছিলেন কাতিয়া গিয়ানেচি। তিনি নোবেল ওমেনস ইনিশিয়েটিভ-এর মুখপাত্র। তিনি এক ইমেইল বার্তায় বলেছেন, ওই নোবেলজয়ীরা নির্যাতিত নারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। শুনেছেন তাদের নির্মম কাহিনী। আরেকজন নোবেলজয়ী ইরানের শিরিন এবাদি সোমবার তাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে। উল্লেখ্য, নোবেল ওমেন্স ইনিশিয়েটিভ প্রতিষ্ঠা হয় ২০০৬ সালে। এটি হলো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ৬ জন নারীর সম্মিলিত উদ্যোগ। এই সংগঠনের ওই তিন নোবেলজয়ী এক সপ্তাহ পরিদর্শন করবেন বাংলাদেশে। এ সময়ে তারা উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলবেন। তারা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচিকে নৃশংসতার জন্য দায়ী করেন। দায়ী করেন তার দেশের সেনাবাহিনীকে। দায়ীদেরকে বিচারের আওতায় আনার জন্য তারা আহ্বান জানান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি। ওই নোবেলজয়ীদের সফরের পর রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মিনারা বেগম (২৫)। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী তাকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। তিনি বলেছেন, সেনারা তাকে জড়িয়ে ধরে। তাকে শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। তার নৃশংসতার কথা শুনে তারা কেঁদেছেন। মিনারা বলেন, আমার কাহিনী শুনে তারাও কেঁদেছেন। তারা তাদের অশ্রু ধরে রাখতে পারেন নি। আমাদের এসব কাহিনী তারা আগ্রহ নিয়ে শুনেছেন এতে আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। শনিবার তাওয়াক্কুল কারমান ই-মেইলে বলেছেন, তিনি এবং তার সহকর্মীরা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছেন এবং রোহিঙ্গা নারীদের আর্তনাদে অন্যদের কান দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা নারীরা দু’দফায় নির্যাতিত হচ্ছেন। তারা একদিকে রোহিঙ্গা হওয়ার কারণে নির্যাতিত হচ্ছেন। আবার নারী হওয়ার কারণে নির্যাতিত হচ্ছেন। জাতি নিধনে তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই তাদের ওপর চালানো হচ্ছে যৌন নৃশংসতা।

No comments

Powered by Blogger.