কোটা ব্যবস্থা ও সংবিধান লঙ্ঘন by মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান

আমাদের দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা চালু আছে। এটা সংবিধান স্বীকৃত একটি রীতি। সংবিধানের ২৯(৩)(ক)(খ)(গ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- অনগ্রসর শ্রেণী, ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত সম্প্রদায়গত ব্যক্তি এবং কর্মের বিশেষ প্রকৃতির কারণে নারী-পুরুষ উপযুক্ত বিবেচনায় নিয়োগ দিতে কোনো বাধা নেই। কোটার ক্ষেত্রে স্পষ্ট- ০১. অনগ্রসর শ্রেণী; ০২. ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে উক্ত সম্প্রদায়গত ব্যক্তি এবং ০৩. কর্মের বিশেষ প্রকৃতির কারণে নারী-পুরুষ উপযুক্ত বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। এই তিনটি ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং মহিলাদের সাধারণ ক্ষেত্রে এটা অবৈধভাবে প্রয়োগ করছে। অথচ সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতার বিষয়ে সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে’। ২৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ‘কেবল ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবেন না, কিংবা সে ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না’।  সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে’ এবং ১৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে’।
২০(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়’ এবং ‘প্রত্যেকের নিকট হতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’- এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবে’। ২১(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য’। সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীরা সংবিধানের ১৪৮(২)ক অনুচ্ছেদ মতে, পদের শপথ (বা ঘোষণা) গ্রহণ করে থাকেন। সেখানে শপথের সময় বলা হয়Ñ ‘আমি সংবিধান রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করব এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করব’। কিন্তু কার্যত হচ্ছে উল্টো। বিচার বিভাগের এটা দেখার দায়িত্ব থাকলেও তারা নানা কারণে এটা দেখছেন না। ফলে সরকার যা ইচ্ছা, তাই করতে পারছে। এই সংবিধান লঙ্ঘনের মহড়া শুধু এই সরকারই করছে না, বরং প্রতিটি সরকারই এই কাজ অবাধে করে গেছে। হীন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সরকার সংবিধানের ২৯(৩)(ক)(খ)(গ) অনুচ্ছেদের অজুহাত দিয়ে ১৯(১), ১৯(২), ২০(১), ২১(১), ২৭, ২৯(১), ২৯(২), ও ১৪৮(২)ক অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এভাবে রাজনীতি করা মোটেও সমীচীন নয়। জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা আজ সম্মান পাচ্ছেন না; কিন্তু মৃত্যুর পর তাদের স্যালুট দেয়া হচ্ছে। এক ধরনের পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়। কোটার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সাথে সাংবিধানিক কোটা পদ্ধতির সম্পর্ক নেই এবং তারা রাষ্ট্রের কোনো অনগ্রসর শ্রেণীও নন। সমাজের সব শ্রেণীর সম্মান ও গর্বের ধন।
নারী কোটার ক্ষেত্রে বলা যায়, ২৯(৩) (গ)-তে নারীদের যে কোটা পদ্ধতির কথা বলা আছে, তা বিসিএসের সাধারণ পরীক্ষার বিষয় নয়। এটা মহিলাদের কর্মের বিশেষ প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত। বাংলাদেশে এখন ২৫৮ ধরনের কোটা পদ্ধতি চালু আছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ, যার মোট পদের ৫৬ শতাংশ। কোটাই যদি ৫৬ শতাংশ হয়, তখন কোটাকে নিয়োগের সাধারণ রীতি করে এবং মেধাকে কোটায় আনাই যুক্তিসঙ্গত ছিল। তখন বলা যেত, নিয়োগে ৪৪ শতাংশ পদ মেধা কোটা সংরক্ষিত। সরকারি বিধি অনুযায়ী, সরকার নিয়োগ পরীক্ষাকালে প্রথমেই মেধা ও পরে ওই তিনটি বিষয়ে কোটা প্রথা প্রয়োগ করবে, এইটা সবাই আশা করে। বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় প্রার্থীরা মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হয়েও কোটার কারণে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে সরকারি পদগুলোতে কম মেধার লোকজনের সমাবেশ ঘটছে। এটা সরকারি প্রশাসন যন্ত্রকে দুর্বল করছে। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭২ সালের পাবলিক পরীক্ষা ও ১৯৭৩ সালের বিসিএস পরীক্ষাকে এ ব্যাপারে বিতর্কিত করেছিল। চাকরির ক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে পাস করা পাবলিক পরীক্ষা এবং ১৯৭৩ সালে বিসিএস পাস করা লোকদের দেখলে যৎসামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো লোকজন হেয়চক্ষে দেখে এবং টিপ্পনি কাটে। সরকারের কোটা নীতির কারণে প্রায়ই কোটা পূরণ হচ্ছে না। এতে বোঝা যায়, সরকারের কোটা পদ্ধতি কতটা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য। অসাংবিধানিক ও অনৈতিক কোটা পদ্ধতি চালু থাকায় এভাবে নিয়োগ পাওয়া জনশক্তি নৈতিকভাবে দুর্বল থাকছে। যার নিয়োগ অসাংবিধানিক ও অনৈতিক, তার থেকে কিভাবে নৈতিক আচরণ বা নৈতিক সেবা আশা করা যায়? চাকরি গ্রহণ কালে যারা তাকে অনৈতিক নিয়োগ দিয়েছে, সঙ্গত কারণে যেকোনো মূল্যে এর প্রতিদান দিতে তাদের কুণ্ঠিত হওয়ার কথা নয়। এ জন্য প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না।
জনগণও প্রশাসনের কাছে সম-আচরণ পাচ্ছে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে একই মনোভাব কাজ করছে। সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় হলো- সংবিধান লঙ্ঘনের এই অনৈতিক কাজে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যারা, তারা আজ সরকারের এই অনৈতিক পদ্ধতি বাতিলের দাবি জানাতে গিয়ে পুলিশ ও সরকারি দলের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। সংবিধান লঙ্ঘনকারীরা দাপট দেখাচ্ছে এবং সংবিধানের অধিকার রক্ষার কাজে যারা, তারা আজ নিগৃহীত। বিসিএস পরীক্ষায় লিখিত ও মৌখিক প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তথ্য যাচাইয়ের নামে অহেতুক রাজনৈতিক পরিচয় ঘাটাঘাটির মহড়া চলছে। তা দেখলে মনে হয়, এ দেশে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো দলের লোকজন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার অধিকার নেই। কর্তৃপক্ষ ভুলে যায়, দেশটা কোনো দলের নয় এবং স্বাধীনভাবে দল করা বা সমর্থন করা বেআইনিও নয়। পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে বিরোধী দল-মতের লোকদের কৌশলে বাদ দেয়া হচ্ছে। শুধু কোটার মাধ্যমে নয়, ভেরিফিকেশনের নামে সেখানেও সংবিধানের ১৯(১), ১৯(২), ২০(১), ২১(১), (২), ২৭, ২৮(১), (২), ২৯(১) ও ২৯(২) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হচ্ছে। সরকার বেমালুম ভুলে যাচ্ছে- বিরোধী দল করা কোনো বেআইনি কাজ নয় এবং যোগ্যতম প্রত্যেক নাগরিকের কর্মের অধিকার রয়েছে। এখানে সবারই যোগ্যতা অনুসারে কর্মের অধিকার সাংবিধানিক বিধান।

No comments

Powered by Blogger.