অসমতা

সম্পদ ও অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে অসমতা মানবসভ্যতার এক চিরায়ত সমস্যা। যুগ যুগ ধরে মানুষ অসমতা দূর করার স্বপ্ন দেখেছে। মার্ক্সীয় রাজনৈতিক দর্শনের মূল প্রতিপাদ্যই অসমতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মানুষ সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিপ্লব করেছে। কিন্তু কোথাও সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। অসমতা যেন এক অনিবার্য বাস্তবতার মতো পুরো মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো মতভেদ এখন আর নেই যে অসমতা শুধু অনৈতিক নয়, মানবসমাজের উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রতিবন্ধকও বটে। অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকদের প্রায়োগিক গবেষণায় ইতিমধ্যে পরিষ্কার হয়েছে যে কোনো দেশ বা অঞ্চলের মানুষের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণির মধ্যে অসমতা বেড়ে গেলে পুরো জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। তাই উন্নত ও অনুন্নত সব দেশেই অসমতা কমানোর ওপর এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। গত রোববার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘চ্যালেঞ্জিং ইনজাস্টিস ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক যে সংলাপের আয়োজন করেছিল, তার প্রধান প্রতিপাদ্যই ছিল অসমতা। সেখানে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে মানুষে মানুষে অসমতাও বেড়ে গেছে। এই অভিজ্ঞতা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে চলেছে। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি ক্রমবর্ধমান হারে করারোপের যে প্রস্তাব তাঁর ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে করেছেন, অধ্যাপক রেহমান সোবহান মনে করেন তা যথেষ্ট নয়। তাঁর মতে, এটা মাঝারি মাত্রার হস্তক্ষেপ, অসমতা দূর করার জন্য আরও তীব্র কর্মসূচি প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, আমাদের গোড়ায় হাত দিতে হবে। রেহমান সোবহান দক্ষিণ এশিয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে দারিদ্র্যের চারটি কাঠামোগত উৎস চিহ্নিত করেন।
সম্পদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসমতা, বাজারে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যায্যতা, মানব উন্নয়নের সুযোগ প্রাপ্তিতে অসমতা ও অন্যায্য শাসনব্যবস্থা—অসমতার এই চারটি উৎসে হাত দিতে হবে বলে তিনি মনে করেন। সে জন্য ছয়টি ক্ষেত্রে কাজ করা দরকার: কৃষি খাতে সংস্কারে অগ্রগতি সাধন করতে হবে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূল্য সংযোজন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে বাজারব্যবস্থায় তাদের অংশগ্রহণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে, শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, বাজেটের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য আর্থিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে এবং যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে সম্পদের মালিকানা সম্প্রসারণ করতে হবে। আমাদের মতে, এর প্রতিটি ক্ষেত্রে ফলদায়ক কার্যসম্পাদনের জন্য সুশাসন নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। সুশাসন নিশ্চিত হতে পারে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের অধিকার সমান—এই নীতির বাস্তবায়ন অসমতা বা বৈষম্য লাঘবে নিঃসন্দেহে সহায়ক। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার বৈষম্য লাগামহীনভাবে বাড়তে পারে না, যদি নীতি ও আইনের দ্বারা সব ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। সুশাসনের দ্বারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হলে সুবিধাভোগী ও প্রভাবশালী শ্রেণির পক্ষে সীমাহীন লুটপাটের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়া সম্ভব নয়। পিছিয়ে পড়া বিপুল জনগোষ্ঠীর চিরবঞ্চনা ও ক্ষমতাহীনতা দূর করা না হলে অসমতা কমানো সম্ভব নয়। সে জন্য তাদের শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। গণতান্ত্রিক চেতনার কেন্দ্রীয় বিষয় অধিকারের সমতা। তাই গণতন্ত্র ও সুশাসনই অসমতা কমানোর সর্বোত্তম পন্থা।

No comments

Powered by Blogger.