পথে প্রান্তরে জাবির একঝাঁক তরুণ গবেষক

সকাল ৭টা। তীব্র কুয়াশার মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলা ভবনের সামনে জমায়েত বাড়তে থাকে তরুণ গবেষকদের। উদ্দেশ্য কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা। কনকনে শীতের বাধাকে অতিক্রম করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে জড়ো হলো ৬৮ জন তরুণ গবেষক। ভিন্ন এক কারণে ট্যুর নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি উত্তেজনার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছিল। কারণ, গবেষণা কার্যক্রম-ই নয়, গবেষণার পাশাপাশি কুমিল্লার ঐতিহাসিক স্থানগুলো ভ্রমণের সুযোগও যে মিলছে শিক্ষার্থীদের! বলছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেল্থ অ্যান্ড ইনফরমেটিভ বিভাগের কথা। বাংলাদেশের একমাত্র বিভাগ হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে চালু হওয়া বিভাগটি ২০১১ সালের ২১ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে জনস্বাস্থ্য গবেষণায় ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। কুমিল্লার উদ্দেশে শিক্ষার্থীদের যাত্রা শুরু হয় সকাল ৮টায়। বিভাগের দুই ব্যাচ অর্থাৎ ৪৪তম ব্যাচ এবং ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা এবারের ফিল্ড ট্যুরে অংশ নেন। এই ট্যুরের সার্বিক দায়িত্বে থাকেন বিভাগটির দুই শিক্ষক জনাব জেবুন্নেসা জেবা এবং ডা. মোসা. সাবরীনা মোনাজিলিন। নলেজ-অ্যাটিচিউড অ্যান্ড প্র্যাকটিস রিগার্ডিং নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ, সেল্ফ মেডিকেশন ইন ফার্মাসিউটিক্যাল ভিজিটরস এবং হেলথ অ্যাসপেক্ট অব সেইফ মাদারহুড ইন এ গিভেন এরিয়া; গবেষণার এই তিনটি বিষয় নিয়ে শুরু হয় এবারের যাত্রা।
বাস যখন ঢাকা আরিচা মহাসড়কে তখন হঠাৎ ‘নাও ছাড়িয়া দে পাল উড়াইয়া দে’ গানের সুর ভেসে ওঠে বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী দিদারুল আলম দ্বীপ এবং রাইসুল ইসলাম রিমন এর কণ্ঠে। সঙ্গে সঙ্গে বাসের সব শিক্ষার্থীর একসঙ্গে গাওয়া গান বাসে এক অন্যরকম উত্তেজনার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে একটির পর একটি গান আসতে থাকে আর বাস এগিয়ে চলে কুমিল্লার দিকে। যেন সেদিন চারদিক গানের আভাসে মুখরিত আকার ধারণ করেছিল। ‘রাস্তার চারপাশের লোকজন, অন্য বাসের যাত্রী, আর পথচারীদের আমাদের দিকে কী যে কৌতূহল চোখে তাকিয়ে ছিল, ভাবতে এখনো ভালো লাগে’ বলছিলেন ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আয়েশা আহমেদ। কিছুক্ষণ পর, সবাইকে চকোলেট বিতরণের দায়িত্ব পড়ল ৪৪তম ব্যাচের (বন্ধুদের কাছে) রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামক খ্যাত বন্ধু শরীফ। এবারের পুরো ট্যুর নিয়ে তাকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি মজা হয়। তারপর ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফিরোজ যখন "টিকাতলীর মোড়ে একটা হল রয়েছে" নামক গানের সুরে বন্ধু ও সিনিয়রদের গোপন ও মজার তথ্য ফাঁস করছিল তখন শিক্ষার্থীদের মুখে সে কি হাসি। বন্ধুদের কাছে ‘বিজ্ঞানী হংকং’ নামে খ্যাত মনিরের একসাথে একাধিক প্রেমের রহস্য জানতে এই দিনের মতো উপযুক্ত সময় আর কোথায়, তাই তো বন্ধুরা সবাই হামলে পড়ল মনিরের কাছে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধু তালিকায় থাকা মেয়েদের মেসেঞ্জারে একের পর এক নক দিয়েও কোনো সাড়া না পাওয়ার দুঃখ নিয়ে রাইসুলের গাওয়া গানও ব্যাপক সাড়া পায়। ‘এত বিপুল আনন্দের মাঝে কখন যে বাস এসে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেছে টের ই পেলাম না’ বলছিলেন ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সায়েমা মিম। বলে রাখা ভালো এবারের সফরে গবেষণার পাশাপাশি ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত ছিল। সেই অনুযায়ী দুপুর ১টায় বাস দুটি কুমিল্লার ময়নামতি জাদুঘর এবং শালবন বৌদ্ধবিহারের সামনে ভিড় জমায়। ‘গবেষণার জন্যে এলেও প্রথমে এই দুইটি স্থান ভ্রমণের লোভ সামলাতে পারলাম না। এসব স্থান দেখার জন্য আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে উঠলাম। তাই প্রথমেই আমরা সব শিক্ষার্থীরা ময়নামতি জাদুঘরের প্রাচীন স্থাপনা দেখি’ বলেন তৌসিফ রহমান। ময়নামতি ভ্রমণ শেষে শিক্ষার্থীরা যায় প্রাচীন শহরের অন্যতম সেরা নিদর্শন ময়নামতির শালবন বৌদ্ধবিহারে। সবকিছু প্রদক্ষিণ শেষে দুপুর ২টায় সবাই স্থানীয় বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট কাশফুলে দুপুরের খাবার সম্পন্ন করেন। খাবারের পর উঁচ-নিচু পাহাড়ের আলিঙ্গনে অবস্থিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় যায় শিক্ষার্থী। সেখানে অবস্থানরত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টর ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখান এই তরুণ গবেষকদের। পরে সন্ধ্যার সময় কুমিল্লার মনোরম সৌন্দর্য ও পরিপাটি স্থান বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) যায় তারা। সফরের প্রথম দিন এভাবেই কর্মব্যস্ততার মধ্যে কাটে। ভিতরে প্রবেশ করেই বার্ডের মধ্যে পরিকল্পিত স্থাপনা ও রাস্তার দুই ধারে বিস্তৃত বনায়নে চোখ জুড়িয়ে যায়।
আমরা ৬৫ জন শিক্ষার্থী শিক্ষকসহ মোট ৬৮ জন। প্রতি দুজনের জন্য একটি করে রুম বরাদ্দ। তারপর রাত সাড়ে ৮টায় সবাই একসঙ্গে বার্ডের মনোরম ক্যান্টিনে রাতের খাবার সেরে ক্লান্ত দিনের সমাপ্তি ঘটে। প্রথম যেহতু বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের কারণে গবেষণার কোনো কাজ সম্পন্ন হয়নি তাই পরের দিন সবাই সকালের নাশতা করেই ডাটা কালেকশনের জন্যে বিভিন্ন গন্তব্যে রওনা করেন শিক্ষার্থীরা। তারই ধারাবাহিকতায় সকালের নাশতা করেই বিভাগের ৪৪তম ব্যাচ দুটি ভাগ হয়েই দুটি টপিক নিয়ে চলে যায় বার্ডের আশপাশে এলাকায় এবং ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী কুমিল্লা মেডিকেলে চলে যায়। সেখানে তারা মহিলাদের ওপর নিরাপদ মাতৃত্বের বিষয় নিয়ে ডাটা কালেকশন করবে। ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ ও সেলফ মেডিকেশন নিয়ে ডাটা কালেকশন করে। সেখানকার জনসাধারণের কাছে ওই বিষয় সংশ্লিষ্ট তাদের সমস্যাবলী খুব নিরূপণভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ‘আমরা খুবই নিখুঁতভাবে তাদের সব প্রশ্নগুলো মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করি। তারা সেখানে তাদের স্বাস্থ্যগত সেবার মান ও সব সমস্যাদি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন। আমরা তাদের স্বাস্থ্যগত সব সমস্যাবলি খুবই নিরূপণভাবে টুকে নেয়ার চেষ্টা করি’ বলেন ইশরাত নিঝুম। এভাবেই সারা দিন গবেষণার ডাটা সংগ্রহের কাজ শেষ হয়। ক্যাম্পাসে ফিরে সেগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষণার বাকি ধাপগুলো সম্পন্ন করা হবে। ‘আমরা আশা করি এখান থেকে আমরা ভালো কিছু গবেষণার ফলাফল পাব যা বাংলাদেশের আগামীর হেলথ পলিসি তৈরিতে বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে’ বলেন বিভাগটির শিক্ষক ও এই সফরের সার্বিক দায়িত্বে থাকা ডা. মোসা. সাবরীনা।

No comments

Powered by Blogger.