জিয়ার ভূমিকা : ইতিহাস কী বলে by এ কে এম এনামুল হক

চিফ জাস্টিস আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কর্তৃক ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এ ক্যু এর পর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্টেটর নিযুক্ত হন। জিয়াউর রহমানকে তিনি এভাবে মূল্যায়ন করেছেন, ‘সেনাবাহিনীর মধ্যে তিনি একজন স্বভাবজাত নেতা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার অবদান অবশ্যই অমূল্য। সেনাবাহিনীতে জওয়ানেরা মনে করে, তার মাথার চার পাশে একটা জ্যোতির্বলয় আছে।’(বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি পৃ: ৩৬)। ইদানীং আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রথম সারির নেতা প্রচার করছেন- জিয়া বন্দুকের নলের মাধ্যমে বিচারপতি সায়েম থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মার্শাল ল প্রবর্তন করেছিলেন। এটা গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচার ও ইতিহাস বিকৃতি, তথা দেশের ইতিহাসকে কলঙ্কময় করার প্রয়াসমাত্র। প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সায়েম তার ক্ষমতা ত্যাগের রহস্য এভাবে ব্যক্ত করেছেন- ‘পরিস্থিতি ছিল এরকম এবং আমি সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ দ্রুত হারাচ্ছিলাম। তখন আমি প্রেসিডেন্ট পদে থেকে ইস্তফা দেয়ার কথা চিন্তা করি। অন্য দিকে, প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার সপ্তাহ খানেক আগে আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা: ইউসূফ আলী ও আমার সার্জেন ডা: মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান আমাকে পরীক্ষা করে বললেন- আমার প্রোস্টেট অপারেশন করতে হবে। তারা বললেন, ওষুধে কিছু দিন চলবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপারেশন করতেই হবে (পৃ : ৩৪)। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিশেষ সহযোগীর নেতৃত্বে উপদেষ্টা কাউন্সিলের কিছু সিনিয়র বেসামরিক সদস্য আমাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার অনুরোধ করেন। তারা বলেন, তারা তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে কাজ করতে চান। সায়েম আরো লিখেছেন- ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর সকালে আমি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করি। সেই সকালে খোন্দকার মোশতাক আহমদ আমার দায়িত্ব গ্রহণের আগে সামরিক আইন আদেশে সংশোধনী এনেছিলেন এ ধারাটি যুক্ত করার মাধ্যমে : (ক-ক) কোনো কারণে যদি আমি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণে অপারগ হই অথবা যদি আমি প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দিতে চাই, তাহলে আদেশ বলে আমি যেকোনো ব্যক্তিকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করতে পারি এবং তার কাছে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারি। সে ব্যক্তি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বা আমার মাধ্যমে নিয়োজিত সুপ্রিম কোর্টের যেকোনো বিচারকের সামনে প্রয়োজনীয় শপথ পাঠের পর প্রেসিডেন্ট পদে প্রবেশ করবেন; অর্থাৎ বিধিবদ্ধভাবে বিচারপতি সায়ে লে: জেনারেল জিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এখানে জিয়ার জবরদস্তির কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না।
১৫ আগস্টের ক্যু এবং নভেম্বর বিপ্লব
‘আমার বাইরের ঘরের দরজায় ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙতেই আমি ভাবলাম, কি হচ্ছে! এত সকালে দরজার ওপর এরকম ধাক্কাধাক্কি! দ্রুত গিয়ে দরোজা খুলে দিতেই যা দেখলাম, তার জন্য তৈরি ছিল না সদ্যঘুমভাঙা চোখ। আমার একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেজর রশিদ (পরে লে: কর্নেল (অব:) সশস্ত্র। তার পাশে আরো দুইজন অফিসার। প্রথমজন মেজর হাফিজ, আমার ব্রিগেড মেজর, অন্যজন লে. কর্নেল আমীন আহমদ চৌধুরী আর্মি হেড কোয়ার্টাসে কর্মরত। তাদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই। মনে হলো, এ দুইজনকে জবরদস্তি করে ধরে আনা হয়েছে। আমার চমক ভাঙার আগেই রশিদ উচ্চারণ করল ভয়ঙ্কর একটি বাক্য- উই হ্যাভ কিলড শেখ মুজিব। অস্বাভাবিক একটা কিছু যে ঘটেছে সেটা আগন্তুকদের দেখেই বুঝেছি। তাই বলে একি শুনি! আমাকে আরো হতভম্ব করে দিয়ে রশিদ বলে যেতে লাগল, উই হ্যাভ টেকেন ওভার দ্য কন্ট্রোল অব দ্য গভর্নমেন্ট আন্ডার দ্য লিডারশিপ অব খন্দকার মোশতাক।’ মেজর রশিদ ছিল আমার অধীনস্থ আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক। মাস খানেক আগে সে ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফেরে। তার পোস্টিং হয় যশোর। কয়েক দিন পরই সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ মেজর রশিদের পোস্টিং পাল্টে তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, এ ধরনের পোস্টিং সেনাপ্রধানের একান্তই নিজস্ব দায়িত্ব। রশিদের কথা শেষ হতে না হতেই পেছনে বেজে উঠল টেলিফোন। দরজা থেকে সরে গিয়ে রিসিভার তুললাম। ভেসে এল সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কণ্ঠস্বর ‘শাফায়াত, তুমি কি জান বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা ফায়ার করেছে?
উনি তো আমাকে বিশ্বাস করলেন না।’ ...আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। তবে এই মাত্র মেজর রশিদ এসে জানাল, তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে এবং তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। আমাকে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার বিরুদ্ধে হুমকিও দিয়েছে। সেনাপ্রধানকে তাও জানালাম। তবে সেনা প্রধানের সঙ্গে কথা শেষে তার অবস্থান কী, সে সম্পর্কে কিছু বুঝতে পারলাম না, প্রতিরোধ উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ বা নির্দেশ কিছুই পেলাম না। কর্নেল শাফায়াত জামিল আলো লিখেছেন, ফোন করে এসে ড্রইংরুমে দেখি, মেজর হাফিজ একা। রশিদ আর তার সঙ্গী আর একজন অফিসার চলে গেছে। ঝটপট ইউনিফর্ম পরে তৈরি হয়ে মেজর হাফিজকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, আগে যাবো ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায়। জিয়ার বাসার দিকে পা বাড়ালাম দ্রুত। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কির পর দরজা ডেপুটি চিফ নিজে খুলে দেন। কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে ওঠা চেহারা। স্লিপিং ড্রেসে পাজামা আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়। এক দিকের গালে সেভিং ক্রিম লাগানো, আরেক দিকে পরিষ্কার। এত সকালে আমাকে দেখে বিস্ময় আর প্রশ্ন মেশানো দৃষ্টি তার চোখে। খবরটা দিলাম তাকে। রশীদের আগমন আর চিফের সাথে আমার কথোপকথনের কথাও জানালাম। মনে হলো- জিয়া হকচকিত হয়ে গেলেন। তবে বিচলিত হলেন না। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন So what? President is dead! Vice President is there. Get your works ready, uphold the constitution. সে মুহূর্তে যেন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ধ্বনিত হলো তার কণ্ঠে। (কর্নেল শাফায়াত পৃ:-১১৩) জেনারেল জিয়া সংবিধান রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে কর্নেল শাফায়াত জামিলকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দিলেন অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। বোঝা যাচ্ছে, কর্নেল জামিলের জেনারেল জিয়ার বাসায় পৌঁছার আগে তিনি (জিয়া) এই ক্যু ও হত্যাযজ্ঞ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনবহিত ছিলেন। তার যদি অভ্যুত্থানকারীদের সাথে যোগসাজশ থাকত তাহলে কর্নেল জামিলের ক্যু এর সংবাদ দেয়ার পর হকচকিত হতেন না; অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতেন না। কর্নেল জামিল জিয়ার বন্ধু ছিলেন না। বরং ৩ নভেম্বরের ক্যু এর নেতা ছিলেন। ফারুক রশিদরা ক্যু কার্যকর করার সময় জিয়াকে কোনোভাবে অবহিত করেননি। ক্যু’য়ে অংশগ্রহণ থাকলে তারই সর্বাগ্রে এ সম্বন্ধে জানার কথা। আর ফারুক-রশিদদের জিয়াকে এ ব্যাপারে অবহিত করার অভিযোগ, জিয়ার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ক্ষোভের অভিব্যক্তি ও অসততা। কারণ জিয়া তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার এবং তাদের ইউনিটগুলোকে নিরস্ত্র করেছিলেন।
নভেম্বর বিপ্লব
১৫ আগস্ট ’৭৫ সালে কতিপয় সেনা অফিসার কর্তৃক বিদ্রোহের মাধ্যমে নিষ্ঠুরভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে হত্যার পর আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বৃহৎ অংশের আনুগত্য লাভে তাকে বেগ পেতে হয়নি। তিনি বঙ্গভবনে কেবিনেটের নেতৃত্বে থাকলেও বিদ্রোহী মেজররা বঙ্গভবনেই অবস্থান করছিলেন। এ দিকে, সেনাবাহিনীতে ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ এবং ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল ২-৩ নভেম্বর ’৭৫ সালে পাল্টা ক্যু করেন সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার নামে। যখন খালেদ-শাফায়াত সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে রেডিও-টেলিভিশন স্টেশনের দখল নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ফারুক-রশিদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করান। ৩ নভেম্বর সারা দিন প্রেসিডেন্ট মোশতাক এবং ক্যু-এর নেতাদের মধ্যে আলোচনায় বিদ্রোহী মেজরদের বাংলাদেশ বিমানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার সাপেক্ষে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং তাদের বিদেশে ফরেন অফিসে চাকরি দিয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়। এ দিকে, দুপুরে জিয়ার পদত্যাগ, খালেদ মোশাররফের সেনাপ্রধান নিযুক্তি, প্রধান বিচারপতি সায়েমের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ এবং মোশতাকের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলো। সেনানিবাসে ও দেশব্যাপী দ্রুত নানা গুজবের ডালপালার বিস্তার প্রসারিত হতে থাকে। সেনানিবাসে কে বা কারা উসকানিমূলক লিফলেট ছড়াল। সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দী করা ও অন্তরীণ করাকে সাধারণ সৈনিকেরা সঠিকভাবে গ্রহণ করেননি। তাই সেনানিবাসে বেশ উত্তেজনা দেখা দিলো। জাসদের গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালায়। তারা ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই অফিসাদের কল্লা চাই’- স্লোগান দিয়ে বারো দফা দাবি উত্থাপন করে, যা ছিল সৈনিকদের সংশ্লিষ্ট। এ উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বেশ কিছু অফিসার ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ কর্তৃক নিহত হন। এ দিকে, জিয়া সমর্থক সৈনিকেরা তাকে তাদের ইউনিট লাইনে নিয়ে যায়। কর্ণেল তাহের তার পরিকল্পনামতো জেনারেল জিয়াকে রেডিও-টেলিভিশনে বক্তব্য রাখতে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হলেন। তাই বলা যায়, জাসদ ও কর্নেল (অব.) তাহের তাদের মিশন বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তারা মূলত জিয়ার ভাবমর্যাদা ব্যবহার করে দেশে এক অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া ও তার অনুগতদের বিচক্ষণতায় ও ত্বরিত পদক্ষেপে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। তাহেরের পরিকল্পনা নিখুঁত ছিল। কিন্তু জিয়ার বুদ্ধি ও কৌশলের কাছে তাকে হার মানতে হয়। পরে এর জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। জাসদ ও তাহেরের হঠকারিতায় ১৭ জন অফিসার প্রাণ হারান, যারা ছিলেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সেনানীদের কয়েকজন। ‘৭ নভেম্বর এবং এর অব্যহিত কয়েক দিনের মধ্যে জিয়া তার একক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এ দিকে, তাহের ও তার রাজনৈতিক সহযোগীরা আত্মগোপন করার মাধ্যমে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এক পক্ষ কালের মধ্যে জাসদের উল্লেখযোগ্য নেতারা অন্তরীণ হন। আর তাদের সেনা বিদ্রোহ, অফিসার হত্যার উসকানির জন্য আইনানুগভাবে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হতে হয়।’ কর্নেল শাফায়াত জামিল পৃ: ১৫০।তাহেরের চরম হঠকারী কর্মকাণ্ডকে এখনো কিছু জাসদ নেতা অপব্যাখ্যা দিয়ে ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিচ্ছেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা
‘৩ মার্চ ১৯৭১ সালে। সকাল সাড়ে ৯টা। এই প্রথম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ব্যাপারে প্রথম প্রকাশ্য আলোচনা। এ দিকে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছিল। সামরিক বাহিনীর অন্যান্য বাঙালি অফিসাররা অস্থির হয়ে উঠছিলেন। তাদের সবার মনে একটি চিন্তা পাক খেয়ে ফিরছিল- কী করা যায়? কী করব? বিভিন্ন খবরা-খবর নিয়ে তারা বারবার ছুটে আসছিলেন মেজর জিয়ার কাছে। মেজর জিয়া ছিলেন তখনকার অষ্টম বেঙ্গল ব্যাটালিয়ানের বাঙালি অফিসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত।’ (দক্ষিণ রণাঙ্গন- মেজর রফিক)। ‘২৫ মার্চ রাত ১১টায় অষ্টম ব্যাটালিয়নের অফিসার কমান্ডিং জানজুয়া আকস্মিকভাবে মেজর জিয়ার কাছে নির্দেশ পাঠালেন- এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওযার জন্য। এ আকস্মিক ও রহস্যজনক নির্দেশের অর্থ মেজর জিয়ার কাছে বোধগম্য হলো না। রাত সাড়ে ১১টায় জানজুয়া নিজে এসে মেজর জিয়াকে নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে তুলে ষোল শহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওয়ানা করে দেয়। কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে যেতে তার দেরি হচ্ছিল। আগ্রাবাদে যখন একটা বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তার ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে, তখন পেছন থেকে ছুটে আসে এক ডজ গাড়ি। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে আসেন মেজর জিয়ার কাছে। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যান রাস্তার একধারে।’ ‘পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে’ শহরে বহু লোক হতাহত হয়েছে। খালেকুজ্জামানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর থেকে কথাকটি ঝরে পড়ে। কী করবেন জিয়া ভাই এখন? মাত্র আধমিনিট গভীর চিন্তায় তলিয়ে যান মেজর জিয়া। তারপর বজ্রনির্ঘোষে বলে ওঠেন-উই রিভোল্ট।’ সাথে সাথে তিনি খালেকুজ্জামানকে ফিরে যেতে বললেন। বললেন, ব্যাটালিয়নকে তৈরি করার জন্য ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে নির্দেশ দিতে। আর সে সাথে নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সব পশ্চিমা অফিসারদের গ্রেফতারে।’
(দক্ষিণ রণাঙ্গন ১৯৭১-মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি)। এটাই ছিল বাংলার মাটিতে সর্ব প্রথম রিভোল্ট, তথা স্বাধীনতার ঘোষণা এবং শত্রুকে পাল্টা আক্রমণ। শুরু হয়ে গেল বাঙালির স্বাধীনতার জন্য প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ যা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় এবং বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। পাকিস্তানি সামরিকজান্তার প্লান ছিল, অকস্মাৎ বাঙালিদের ওপর হামলা চালিয়ে কয়েক হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে অপ্রস্তুত জাতিকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। (মেজর জেনারেল ফজলে মুকিম) অবস্থার পরিণতি সেটাই হতে যাচ্ছিল। আক্রান্ত অপ্রস্তুত মানুষেরা কিছু প্রতিরোধ গড়ে তুললেও হতবিহ্বল নেতৃত্বহীন জনগণ বিশৃঙ্খল অবস্থায় দিগ্বিদিক পালাচ্ছিল। শিগগিরই হয়তো তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হতো। কিন্তু মেজর জিয়ার স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং পরবর্তীকালে কালুরঘাটস্থ বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার স্বাধীনতার ঘোষণা হতবিহ্বল জাতিকে জিয়ন কাঠির মতো উদ্বুদ্ধ করেছিল। উদ্দীপিত জাতি প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিয়ে অবশেষে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। একমাত্র জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা বিশ্বে গ্রহণীয় হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের রেডিও ও টেলিভিশনে তা প্রচারিত হয়। মেজর জিয়া ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে যুদ্ধ চালিয়ে যান। তিনি কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ওইসব যুদ্ধে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল পাকিস্তানি ২০তম বেলুচ রেজিমেন্ট এবং কুমিল্লা থেকে আগত ৫৩ ব্রিগেড। আর নিশ্চিহ্ন হয়েছিল কমান্ডোরা যারা অবাঙালিদের বাড়ি বাড়ি ঘাঁটি গড়েছিল। (দক্ষিণ রণাঙ্গন পৃ : ১০) ইতিহাসবিদ কে এম রইসুদ্দিন খান তার বাংলাদেশ-ইতিহাস পরিক্রমা পৃ:৬৭৫ এ লিখেছেন- মেজর জিয়াউর রহমান পরপর তিনটি ঘোষণার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানিয়ে দেন। যখন হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত কী মৃত, তা নিয়ে বাংলার মানুষের মনে সংশয় দেখা দিয়েছিল, তখন তার নামে জিয়ার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। ওপরে বর্ণিত কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য তুলে ধরা হলো। আশা করি, ইতিহাস বিকৃতিকারীদের মুখে ছাই দিয়ে আসল সত্য প্রকাশ পাবে এবং মিথ্যার সমাধি রচিত হবে।
লেখক :  অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার., বাংলাদেশ বিমানবাহিনী

No comments

Powered by Blogger.