নীতিহীন শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয়

একটা সময় ছিল যখন শিক্ষা অর্জনের বিষয়টা অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে মানুষের উপলব্ধি হল, শিক্ষা এমন একটি বিষয় যা সবার জন্য প্রয়োজন। শিক্ষা ছাড়া মানুষ অন্ধের শামিল। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একটা সময় ছিল যখন ম্যাট্রিকুলেশন, ইন্টারমেডিয়েট পাসও বিরাট অর্জন বলে বিবেচিত হতো। শিক্ষার অনেক দ্বার উন্মোচিত হওয়ায়, সেই সঙ্গে শিক্ষা অর্জন আগের তুলনায় সহজতর বিধায় আজ ঘরে ঘরে বিএ, এমএ ডিগ্রিধারী দেখা যায়। তবুও এই সনদগুলোর কদর এতটুকু কমেনি। লাখ লাখ শিক্ষার্থী বিএ, এমএ পাস দিয়েই চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায়ও এসেছে পরিবর্তন। সনাতন পরীক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে চালু হয়েছে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি। সবাই যেন শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পায় এজন্য শিক্ষাক্ষেত্রে নানামুখী উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চোখে পড়ছে। ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে বই উৎসব পালিত হচ্ছে। নারী শিক্ষায় অগ্রগতির কারণে সাক্ষরতার হারও বাড়ছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোয় পাসের হার ঈর্ষণীয়। তারপরও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের চেয়ে বাণিজ্য অগ্রাধিকার পাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষা অর্জন যে মৌলিক অধিকার এটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। একটা সময় ছিল যখন সনদ অর্জন করার জন্য পরীক্ষা হলে নকলের মহোৎসব চলত। আমি যখন বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন পাড়া-মহল্লার কিছুসংখ্যক বড়-ভাইবোনকে দেখতাম এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই তাদের আর দেখা যেত না। পরে খবর পেতাম, এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার জন্য সুবিধামতো (যেখানে নকলের সুযোগ আছে) কোনো পরীক্ষা কেন্দ্রে চলে গেছে এবং দেখা যেত সারা বছর পড়ালেখা না করেও পাস করে সনদধারী হয়েছে। এখন শিক্ষায় নতুন একটি বিষফোঁড়া দেখা দিয়েছে, যা হল পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন, পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের একাধিক উদ্দেশ্য থাকে। কিন্তু যারা জ্ঞান অর্জন বাদ দিয়ে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পেতে উদগ্রীব থাকে, তাদের উদ্দেশ্য হল সরু রাস্তায় ছক্কা হাঁকানো। শিক্ষা অর্জনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তাই? সক্রেটিসের শিক্ষাদর্শনের মূল কথা হল- ‘জ্ঞান অর্জন করো, নিজেকে জানো আর নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে সত্যকে উপলব্ধি এবং মিথ্যাকে প্রতিহত করো।’ আসলে শিক্ষা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে নীতি-নৈতিকতার প্রসঙ্গ এসে যায়। নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা অর্জন প্রকৃত শিক্ষা নয়। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের কদর সবসময় ছিল, এখনও আছে। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করে এই নিবন্ধের ইতি টানার চেষ্টা করব। সেটি হল আমাদের দেশে অনেকেই আছেন, যারা নিজেদের নামের আগে বা পরে অর্জিত ডিগ্রির নাম ব্যবহার করেন। অনেকে নিজের ভিজিটিং কার্ডেও তা ব্যবহার করেন। বিষয়টিতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু ব্যাপারটি তখনই নৈতিক স্খলনের পর্যায়ে চলে যায় যখন জানা যায় কোনো ব্যক্তির অর্জিত ডিগ্রিটি ভুয়া। সমাজে ভুয়া ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেটের কথা প্রায়ই শোনা যায়। পত্রিকা মারফত জানা যায়, আমাদের দেশে ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রিরও জমজমাট ব্যবসা করছে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আশার কথা হল, এসব ভুয়া পিএইচডিধারীর খোঁজে মাঠে নেমেছে দুদক। প্রশ্ন হল, যারা এ ধরনের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে নিজেদের নামের আগে বা পরে বিশেষণটি যুক্ত করে সম্মানিত বোধ করছেন, নিজ প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি বা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, তারা কি কখনও নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করেছেন- ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রিটি কখনও তাদের আত্মার খোরাক হতে পেরেছে কিনা? প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন- স্বশিক্ষিত লোক মাত্রই সুশিক্ষিত। তাই সুশিক্ষাটাই প্রত্যাশিত।
ইফতেখার হোসেন সিদ্দিকী : নিবন্ধকার
iftekhar2311@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.