বাংলা গদ্যকে বাঁচাও by এবনে গোলাম সামাদ

মানুষ কথা বলা প্রাণী। সে যে ভাষায় কথা বলে, তা হলো গদ্য। যখন বলছি, বাংলা গদ্যকে বাঁচাও তখন প্রধানত বলছি, লিখিত গদ্যকে বাঁচাবার কথা; কেবলই মুখের ভাষাকে নয়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার (মৃত্যু ১৯৮০ খ্রি. ১১ ফেব্রুয়ারি) বাংলা গদ্য সম্বন্ধে তার লেখা ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে বলেছেন, খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতকের শেষ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমে এবং সম্ভবত এর আগেই বাংলা গদ্যভাষার একটা সবল প্রাঞ্জল রূপ ছিল। এ ভাষা ছিল সর্বাংশে সাহিত্যের উপযোগী। কিন্তু যে কারণেই হোক, দেশীয় সাহিত্যিকরা এ ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেননি। তারা কবিতাই লেখা পছন্দ করেছেন। তিনি তাঁর এই অভিমত প্রদান করেছেন প্রধানত পর্তুগিজ মিশনারি মানুয়েল-দ্য- আস্্সুম্পসাঁও লিখিত ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ (Cripar Xaxtrer Orthobhed) নামক বইয়ের গদ্যের ওপর নির্ভর করে। মানুলে-দ্য-আস্্সুম্পসাঁও এই বাংলা গদ্য লিখতে শিখেছিলেন ঢাকার কাছে অবস্থিত ভাওয়াল নামক স্থানে। এ বাংলা গদ্য হলো, সাধু বাংলা গদ্য। তিনি বইটা লিখেছিলেন ১৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে। কিন্তু বইটা ছাপা হয়েছিল ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন শহর থেকে। এ বই ছাপা হয় রোমান অক্ষরে, পর্তুগিজ উচ্চারণ অনুসারে। বাংলা ছাপার অক্ষর তখনো তৈরি হয়নি। বাংলা ছাপার অক্ষর প্রথম তৈরি করান নাথানিয়েল ব্রাসি হলহেড ১৭৭৮ সালে হুগলিতে। এই অক্ষরে ছাপা হয় তার ইংরেজি ভাষায় লেখা বাংলা ব্যাকরণের বাংলা বাক্যগুলো।
 বাংলাভাষায় বাংলা অক্ষরে বই ছাপানো আরম্ভ করেন শ্রীরামপুর থেকে ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা। এসব বইয়ের ভাষা ছিল বাংলা সাধু গদ্য, কোনো অঞ্চলের বিশেষ বাংলাভাষা নয়। মিশনারিরা যে কেবল খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য বই ছাপিয়েছিলেন, তা নয়। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচারের জন্য বই ছাপিয়েছিলেন। যেমন শব ব্যবচ্ছেদ, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা এবং প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে তারা বই ছাপান। তাদের লক্ষ্য ছিল কেবলই খ্রিষ্টধর্ম প্রচার নয়। এ দেশের মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করাও ছিল তাদের বই ছাপানোর অন্যতম লক্ষ্য। বাংলাভাষায় উন্নতমানের সাধু বাংলা গদ্যে বই লিখেছেন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১২)। রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয় মনে করতেন, চলতি (কথিত) বাংলা গদ্যে ইতিহাস, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে বই লেখা সঙ্গত নয়। তিনি ছিলেন প্রমথ চৌধুরীর কথ্য বাংলা গদ্যের বিশেষভাবে বিরোধী। কারণ তিনি মনে করতেন, এটা বাংলা গ্রন্থের বিষয়বস্তুকে হালকা করে ফেলবে। থাকবে না ভাবের গভীরতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চলিত বা কথ্য বাংলাকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে অনুমতি প্রদানে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মোহিতলাল মজুমদার ছিলেন চলতি বাংলা ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলে যে, চলতি বাংলা পূর্ব বাংলার কোথাও ব্যবহৃত হয় না। পূর্ববাংলার মানুষের কাছে ভাষাটাকে মনে হতে পারে, বিশেষভাবে বিদেশী যা জন্ম দিতে পারে বাংলা প্রদেশে ভাষা নিয়ে বিরোধ। কিন্তু সাধু বাংলাভাষা বাংলা প্রদেশে কোনো বিশেষ অঞ্চলের ভাষা নয়, তা হলো সাধারণ লিখিত গদ্যভাষা। এটা সবার সাধারণ বাংলাভাষা। ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেনের (১৯০১-১৯৯২) মতে, বাংলাভাষাকে মোটামুটি পাঁচটি উপভাষায় বিভক্ত করা চলে।
এগুলো হলো : মধ্য-পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা বা রাঢ়ি; দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের উপভাষা বা ঝাড়খণ্ডি; উত্তরবঙ্গের উপভাষা বা বরেন্দ্রি; পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের উপভাষা বা বঙ্গালি এবং উত্তর-পূর্ববঙ্গের উপভাষা বা কামরূপী। ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) তার লিখিত ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে (১৯৬৫) বলেছেন, ভাষার প্রকৃত আর স্বাভাবিক জীবন হলো তার উপভাষাগুলো। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সংকলন করেন ১৯৬৪ সালে। এটা তার জীবনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি। কিন্তু বর্তমানে আনিসুজ্জামান (পদ্মভূষণ) চাচ্ছেন বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত পছন্দের প্রমিত বাংলার প্রবর্তন। ‘প্রমিত’ বাংলা বলতে তিনি বোঝাচ্ছেন, কেবলই রাঢ়ি বাংলা উপভাষার একটা বিশেষ রূপকে। প্রশ্ন উঠছে, এরকম প্রমিত বাংলার প্রচলন বাস্তবে সম্ভব কি না এবং সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে, তা উচিত কি না। কোনো ভাষাকে এভাবে বেঁধে দিতে গেলে অনেক সময়ই তা পরিণত হতে পারে মৃত ভাষায়। এবারের বইমেলায় উদ্বোধনী ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে মর্যাদা দিন। কিন্তু তিনি বললেন না, ‘নিজেদের’ ভাষা ও সংস্কৃতি বলতে আসলে ঠিক কী বুঝতে হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা। তিনি তার বক্তৃতায় আরো বললেন, বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক, এ দেশ হবে শান্তিপূর্ণ, এ দেশে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ধর্মকর্ম পালন করবে, এমনকি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও তাদের ভাষা চর্চা করতে পারবে। তা ছাড়া, আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলছি। সেখানে হারিয়ে যাওয়া মাতৃভাষা নিয়ে গবেষণা হবে (নয়া দিগন্ত, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। কিন্তু আমাদের কাছে যা বোধগম্য হচ্ছে না, তা হলো-হারিয়ে যাওয়া ভাষা নিয়ে গবেষণা করে আমরা বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে লাভবান হবো? পৃথিবীতে কত ভাষা ছিল আর কত ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে, তার হিসাব কারও জানা আছে বলে মনে হয় না। বিলাতে এক সময় কর্নিশ (Cornish) বলে একটা ভাষা ছিল। কিন্তু ভাষাটা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ভাষায় যারা কথা বলত, তারা এখন কথা বলছে ইংরেজি ভাষায়। সব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। ভাষার বিলুপ্তি ঘটে। এটাই ইতিহাস। আমরা জানি, জাতিসঙ্ঘের ভাষা হিসেবে পাঁচটি ভাষা স্বীকৃত। সেগুলো হলো- ইংরেজি, ফরাসি, রাশিয়ান, চীনা ও স্প্যানিশ (হিসপানি)। এ পাঁচটি ভাষার মধ্যে আমরা একমাত্র ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষা ক’টি শিখবার কতটা সুযোগ পাই? আমাদের ভাষা ইনস্টিটিউটে কতগুলো ভাষার চর্চা করা হবে?
আমাদের এ আন্তর্জাতিকতার শেষ কোথায়? গরিব দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় এ ধরনের আন্তর্জাতিকতাকে বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে বলে মনে হয় না। আমার মনে পড়ে, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তখন সবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রাজশাহীতে দলে দলে মুসলিম শরণার্থী আসছে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ থেকে। প্রথম দিকে তাদের অবস্থা ছিল খুবই অসহায়। কিন্তু পরে তাদের অবস্থা হয়ে উঠল স্থানীয় আদিবাসীর চাইতে অনেক সচ্ছল। কেননা, তারা অনেকেই করতে পারল রাজশাহী থেকে যাওয়া হিন্দুদের সাথে তাদের সম্পত্তি বিনিময়। ভারতে এক বিঘা সম্পত্তি দিয়ে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় পাওয়া সম্ভব হলো পাঁচ বিঘা সম্পত্তি। অন্য দিকে, ভারত থেকে অনেকে এলেন চাকরি পছন্দ করে। তারা এখানে পেতে থাকলেন যথেষ্ট বেতন। লাভ করলেন স্থানীয় মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা। করতে পারলেন তাদের সরকারি ক্ষমতার ব্যবহার আত্মউন্নতিতে। কিন্তু ভারত থেকে আসা মুসলমানদের একটি অংশ থেকে গেল সঙ্কটের মধ্যে। কয়েক বছর পর আমার এক বন্ধু আমাকে বলল, তাদের অবস্থাও যথেষ্ট ভালো হয়ে উঠবে। কেননা ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এদের আর্থিক সহায়তা দেবে বলে। ভারত সরকারের লক্ষ্য হলো, এ দেশে তার কিছু মুৎসুদ্দি সৃষ্টি করা। পরে বিভিন্ন ঘটনা থেকে আমার মনে হয়েছে, সে বন্ধুর দেয়া তথ্য একেবারেই মিথ্যা ছিল না। আমাদের দেশে এখন যারা বেশি প্রগতির কথা বলছেন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রচার করছেন, তাদের একটা বড় অংশই ভারত থেকে আসা অথবা তাদের বংশধর। প্রমিত বাংলার সমর্থকদের মধ্যেও তাদের প্রাধান্য লক্ষ্য করার মতো। পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার মধ্যে এখন ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। অথচ ইংরেজি ভাষার উন্নয়নের জন্য ইংরেজরা কোনো একাডেমি স্থাপনের প্রয়োজন দেখেননি। ইংরেজি ভাষার কোনো একাডেমি গড়ার প্রয়োজন দেখেননি ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলের মানুষরা। ইংরেজি ভাষার প্রথম অভিধান রচক ডক্টর স্যামুয়েল জনসন সম্পূর্ণরূপে নিজের উদ্যোগে ইংরেজি অভিধান প্রণয়ন করেন ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নোয়া ওয়েবস্টার তার বিখ্যাত অভিধান রচনা করেন ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে। আমাদের দেশে ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাভাষার কোনো একাডেমি ছিল না। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলেই বাংলাভাষা সাহিত্যের ঘটেছে বিপুল বিকাশ। এটা ঘটেছে কোনো সরকারি উদ্যোগে নয়, ব্যক্তি উদ্যোগে। এ সময় অনেকে ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলা অভিধান সঙ্কলন করেছেন।
তাদের মধ্যে রাজশেখর বসুর (১৮৮০-১৯৬০) নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য হয়ে আছে। বাংলাভাষার অগ্রগতিও হয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগেরই ফলে। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখছি, এই উদ্যোগ যেন শ্লথ হতে চলেছে। আমরা ক’দিন আগে দেখলাম, বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ করে আনা হলো প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষক নন। তিনি জীবনে সাহিত্য চর্চা কতটা করেছেন, আমরা তা জানি না। এমন একজন ব্যক্তিকে কেন বাংলা একাডেমিতে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ওপর বক্তৃতা দেয়ার জন্য আনা হলো, সেটা হয়ে উঠেছে খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ। তিনি বাংলা একাডেমিতে যা বললেন, সেটা মোটেও গুরুত্ববহ নয়। বাংলা একাডেমির বর্তমান প্রেসিডেন্টকে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখোপাধ্যায় ২০১৪ সালে প্রদান করেছিলেন ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব। এটা তার সাথে জড়িত কি না তা আমরা বলতে পারি না। বাংলা একাডেমি যেন হয়ে উঠতে চাচ্ছে একটা বিশেষ ধরনের রাজনীতির আখড়া, যেটা আমাদের কাম্য হতে পারে না। শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালে। এতে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে আছে দুইটা দিক। একটা হলো- আমরা মুসলমান, আর একটা হলো- আমরা বাঙালি।’ যদি এ কথা আমরা মানতে চাই, তবে অবশ্যই বলতে হবে যে, বাংলাভাষী মুসলমান ও বাংলাভাষী হিন্দুর সংস্কৃতি এক নয়। ধর্ম মানুষের ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের ধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের জীবনযাপন প্রণালীতে তাই ধর্ম ফেলে বিপুল প্রভাব। হিন্দুদের কাছে গো-মাতা পূজনীয়। গরুর গোশত ভক্ষণ ভয়ঙ্কর পাপ। মুসলমানের কাছে তা নয়। হিন্দুর মনে আঘাত লাগতে পারে ভেবে বাংলাভাষী মুসলমান বাংলাদেশে গো-গোশত ভক্ষণ পরিত্যাগ করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, সব ধর্মের অধিকারের কথা। কিন্তু হিন্দুরা একসময় মা কালীর মন্দিরে নরবলি দিয়েছে। হিন্দুরা এক সময় বিধবাকে পুড়িয়ে মেরেছে। হিন্দুদের কেউ যদি ধর্মের যুক্তি তুলে এসব প্রাচীন ভয়াবহ প্রথায় ফিরে যেতে চায়, তবে নিশ্চয় সেটা হতে দেয়া যায় না। হিন্দু ধর্মে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের এবং মুসলমানদের ভাবে অস্পৃশ্য এবং অশুচি। আমরা তাদের এ মনোভাবকে নিশ্চয় স্বাগত জানাতে পারি না। ১৯৭১ সালে কোনো ধর্মের যুক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে একটা স্বাধীন দেশে পরিণত করতে চাওয়া হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক পর্যায়ে গঠন করা হলো হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। এটা কি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরিচায়ক নয়?
কারা টেনে আনছে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, সেটা আমাদের উপলব্ধিতে থাকা দরকার। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে না। সেটা ভালো কথা। এটাও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট কেবল দেশের রক্ষক নন, তিনি একটা বিশেষ ধর্মবিশ্বাসেরও রক্ষক। মনে হচ্ছে, মহলবিশেষের পক্ষ থেকে আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়কে করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে অস্পষ্ট। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-১৮৯৪) ‘বাঙালির উৎপত্তি’ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। এ প্রবন্ধে তিনি বাংলাভাষীদের একজাতি বলে মানতে চাননি। তিনি বলেছেন, বাংলাভাষী জনসমষ্টির মধ্যে থাকতে দেখা যায় কোল বংশীয় অনার্যদের, থাকতে দেখা যায় দ্রাবিড় বংশীয় অনার্যদের, থাকতে দেখা যায় আর্য বংশীয়দের এবং আরো দেখা যায় বাংলাভাষী মুসলমানকে। তিনি ইংরেজদের একজাতি বলেছেন। কিন্তু বাংলাভাষী মানুষদের একজাতি বলতে চাননি। তার মতে ইংরেজ জাতি গঠিত হয়েছে স্যাক্সন, ডেন ও নরমানদের সংমিশ্রণে। এ তিনটি জাতি হলো আর্য বংশীয়। কিন্তু সব বাংলাভাষী মানুষ আর্য বংশীয় নয়। আজকের বাংলাদেশ একটা পৃথক রাষ্ট্র হতে পেরেছে বাংলাভাষী মুসলমান থাকার কারণেই। বাংলাদেশের বাংলাভাষী মুসলমান কেবল একটি ধর্ম সম্প্রদায় নয়, তারাই হলো এই রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড। তাদের ওপর নির্ভর করছে বর্তমান বাংলাদেশের অস্তিত্ব। অনেক কিছুই এখন ওলটপালট করার চেষ্টা চলছে। যেমন শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটিতে গিয়ে বলেছিলেন, এ দেশের সব লোক বাঙালি বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু এখন তার মেয়ে বলছেন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রক্ষারও কথা। কিন্তু এসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এতই ক্ষুদ্র যে, এদের পৃথক অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে বলে মনে হয় না। আমাদের বাংলা একাডেমি যেন শেখ মুজিবের চিন্তাচেতনা থেকে অনেক দূরে সরে যেতে চাচ্ছে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.