চাই মাতৃভাষায় প্রেমের চেতনা by মাহমুদা আখতার নীনা

এই কিতাব (কোরআন) এমনই এক কিতাব যা আমি তোমার ওপর নাজিল করেছি, যাতে করে তুমি এর থেকে লোকদের (জাহেলিয়াতসহ) যাবতীয় অন্ধকার থেকে আলোয় আনতে পার। (সূরা ইবরাহিম ১নং আয়াত ও সূরা হাদিদ-৯ নং আয়াত)। এ ছাড়াও কোরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘এই কিতাব তোমার প্রতি নাজিলকৃত বরকতপূর্ণ কিতাব যেন জ্ঞানীবৃন্দ এর আয়াত নিয়ে চিন্তা করে ও উপদেশ নেয়’। (সূরা সোয়াদ-২৯ আয়াত)। এ ছাড়াও কোরআনে আল্লাহ্ বলেন, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাজিল করেছি যা প্রত্যেক বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং যা সুমলমানদের জন্য পথের দিশা বা হেদায়েত, রহমত ও সুসংবাদ (সূরা আন নাহল-৮৯ আয়াত)। এখানে কোরআনের ভাষ্য মতে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কোরআন হচ্ছে শিক্ষা, জ্ঞান, উপদেশ, সতর্কবার্তা, সুসংবাদবার্তা ও মীমাংসাকারী বাণী। জ্ঞানিবৃন্দ ও চিন্তাশীলদের জন্য অনন্ত চিন্তার খোরাক। কোরআন মহাজ্ঞানভাণ্ডার বলে এর এক নামে নুর বা উজ্জ্বল আলো। এ ছাড়া কোরআন সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী (হক-বাতিলের) পার্থক্যকারী বলে এর আরেক নাম ফোরকান বা কোরআনে আল্লাহ বারবার এর আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণার আহ্বান জানিয়েছেন। বারবার তা বোঝার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং অবশ্যই বোধগম্য ভাষায় কোরআন পাঠ করতে হবে। মুসলমানদের কোরআন চর্চা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে হবে। মুসলমানদের হতে হবে মুক্তবুদ্ধির, মুক্তচিন্তার, মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা ধার্মিক। আর কোরআনের দৃষ্টিতে তারাই আলোকিত মানুষ। মাতৃভাষা একমাত্র প্রাকৃতিক ভাষা, বিজ্ঞানময় ভাষা যা প্রতিটি জাতির প্রতিটি মানুষ সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারে, তাই তো সূরা ইবরাহিমের ৪নং আয়াতে সব জাতিকে মাতৃভাষা প্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। আল্লাহর নবী-রাসূলদের কেউ কখনও সত্যের বরখেলাপ করেননি। তারা যখন যেই জনপদে ধর্ম প্রচার করেছেন সেই জনপদবাসীর মুখের ভাষা বা মাতৃভাষাতেই করেছেন। কেননা কথা কিংবা ভাষা বোঝা না হলে সে কথা এবং সে ভাষা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আর কোরআন আমাদের যে পথ দেখায় তাই সত্য ও আলোকিত পথ। আল্লাহ তাই তো কোরআনে বলেন, নিশ্চয়ই কোরআন মীমাংসাকারী বাণী। (সূরা তারিক-১৩ আয়াত)। বোধের ভাষায় হলে তা পরানের গহিনে বিশ্বাস, ভরসা ও আস্থার জায়গাটিতে স্থান করে নেবে। কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করতে হলে তা বোধগম্য ভাষায় করতে হবে। কেননা বোধগম্য ভাষা ছাড়া কোনো ভাষাই চিন্তায় ধরা দেয় না, চেতনায় সাড়া জাগায় না। অবোধ ভাষা চিন্তানাশক ও চেতনা বিনাশী। আবোধ ভাষা আওড়িয়ে কোনো শিক্ষা, হয় না। অবোধ ভাষা চেতনাহীন বলে তা নিষ্প্রাণ ও নির্জীব চেতনাহীন মনুষের মতোই। অবোধ ভাষা না বুঝে কণ্ঠস্থ বিদ্যা কেবলই মানুষের বুদ্ধি ও মেধাকে ধ্বংস করে।
তাই তো যারা চিন্তাভাবনা করে না আল্লাহ্ তাদের প্রতি আক্ষেপ করে বলেন, আমি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চোখ আছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না। (সূরা আরাফ-১৭৯ আয়াত)। অবোধ ভাষা আওড়িয়ে শুধু ধর্মান্ধ, ধর্মকানা ও ধর্ম ব্যবসায়ী হওয়া যায়। যা ধর্মের ভাবমূর্তির সংকট ডেকে আনে। তাই তো আল্লাহ কোরআনে বলেন, জিজ্ঞেস করো, অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমান? অথবা অন্ধকার ও আলো কি সমান? (সূরা রাদ-১৬ আয়ত)। সহজবোধ্য ভাষায় ধর্মের বাস্তব শিক্ষা চাই। ধর্মের ভাবমূর্তি সংকট দূর করতে হলে মুক্তচিন্তা ও মুক্ত বিবেকের সাধনা চাই। জাগ্রতচিত্তের অধিকারী মুমিন হওয়া চাই। তাই দ্বীন ইসলামে ভাষাবৈরিতা নেই বরং ধর্ম মাতৃভাষা প্রেমের চেতনার প্রেরণা দিয়ে থাকে। কেননা যত বড় মেধাবী ও চৌকস লোকই হোক না কেন অবোধ ভাষার সামনে মুখ থুবড়ে পড়েন। তাই বলছি, মাতৃভাষায় কোরআন পড়–ন, চাক্ষুস অভিজ্ঞতা অর্জন করুন, অমূলক ধারণা বর্জন করুন। বোধবৃদ্ধি ও বিবেককে শানিত করুন। পর ভাষার পরকীয়া প্রেম বর্জন করুন। অতি দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, আলেম সমাজের ভুল ব্যাখ্যার জন্য সাধারণ মানুষ আরবি ভাষার প্রতি অন্ধ আবেগী। কোনো কোনো আলেম এমনও বলে থাকেন সব কিতাবের মূল ছিল আরবি ভাষায়, পরে জিবরাইল (আ.) তা অনারব রাসূলদের প্রতি অনুবাদ করে আরবিতে নাজিল করেছেন (অনারব রাসূলদের প্রতি) তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন, কেন আল্লাহ কি আরবি ভাষা জানেন না? আল্লহ তো কোরআনে বলেই দিয়েছেন যে, তিনি মনের ভাষাই বোঝেন ও জানেন। তবে কেন তিনি জিবরাইলকে দিয়ে অনুবাদ করাবেন? এ প্যাঁচের ব্যাখ্যা একদিন মিথ্যে বলেই সাব্যস্ত হবে। এ ছাড়াও দেখা যায় তারা বলেন, অনেক জাতি আরবিকে জাতীয় ভাষায় পরিণত করেছে। কিন্তু তারা এটা ভাবে না যে এত মানুষ জোর করে মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ইজমা-কিয়াস-ফতোয়ার নামে। কিন্তু এটা তো কোরআনের নীতি নয়। আল্লাহ তো তার কোনো অনারব রাসূলদের ওপরই আরবি ভাষায় কিতাব নাজিল করেননি আরবিকে তাদের ধর্মীয় ভাষা কিংবা জাতীয় ভাষা কোনোটিই করেননি। কিংবা তাঁর নবী-রাসূলদের মাঝেও ভাষাগত ঐক্য সৃষ্টি করেননি। যদি জিবরাইল তা অনারবদের মাতৃভাষায় অনুবাদ করে দিয়েই থাকতেন তবে তা আল্লহ্র ইচ্ছা ও অনুমতি ছাড়া নয়। এতেও কি মাতৃভাষার শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণ হয়ে যায় না। কেননা আরবিকে বাদ দিয়েই তো অনারব রাসূলদের প্রতি তাদের জাতিসত্তার ভাষা বা মাতৃভাষায় নাজিল করা হয়েছে। তাতে মাতৃভাষার প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও তাৎপর্য কি আরও বেড়ে যায়নি? তবে কেন আমরা মাতৃভাষায় নামাজ কোরআন পড়তে পারব না এ প্রশ্ন এসে যায়। যে যাই বলুন না কেন আল্লাহ তাঁর নবী-রাসূলদেরই মাতৃভাষার বিকল্প পথ দেখাননি। অনুবাদের মতো সহজ পথ রেখে সারা বিশ্বের সব জাতিকে আরবি শিখতে হবে এমন, ধারণার কোনো যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না। তাই যদি হতো তবে তো আল্লাহই অনারব নবী-রাসূলদের ওপর ধর্মীয় ভাষা বা ঐক্যের ভাষা কিংবা জাতীয় ভাষা হিসেবে আরবি ভাষাকে বাড়তিভাবে চাপিয়ে দিতেন। বরং মাতৃভাষা আল্লাহর দেয়া অধিকার। কেন না অন্য একটি ভাষাকে বুঝা হল না বলে নামাজ- কোরআন কিতাব বুঝা হল না এমনটি আল্লাহর ইচ্ছা নয়। আরবি ভাষার প্রতি এ আবেগ কাম্য নয়। কোনো জাতি মাতৃভাষার ওপরে অন্য ভাষার স্থান দিতে পারে না। তা হবে আত্মবিনাসী নীতি। বিদেশি ভাষা সর্বজনীন কিংবা বাধ্যতামূলকভাবে কারও ওপরই বোঝা হতে পারবে না। তা হলে ধর্মের নামে চলবে অপকর্ম। শিক্ষার নামে অশিক্ষার চর্চাও অন্ধকারের বিস্তার ঘটাবে। ধর্মে মাতৃভাষাকে বা জাতিসত্তার ভাষাকে কোনো ক্রমেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। কেননা বান্দাদের মাতৃভাষা বা জাতিসত্তার ভাষাকে স্বয়ং আল্লাহই সমুন্নত রেখেছেন, সব জাতিসত্তার ভাষায় রাসূল দিয়ে ও কিতাব কিংবা অহি দিয়ে। আল্লাহ বলেন, আমি তো প্রত্যেক জাতির কাছে এ মর্মে রাসূল পাঠিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাগুত বর্জন কর। (সূরা নাহল-৩৬ আয়াত)। আল্লাহ্ তাঁর কথা সহজে বোঝার জন্য মাতৃভাষার পথ সবার জন্যই উন্মুক্ত রেখেছেন। এই লেখা কোন রায় বা সিদ্ধান্ত নয়। এ আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ। দেশের প্রজ্ঞাবান আলেম সমাজ বিষয়টি যে কোন ধরনের আবেগ বিবর্জিত হয়ে পবিত্র কুরআনের আলোকে পর্যালোচনা করে সুচিন্তিত মতামত জানাবেন, এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক : কোরআন গবেষক

No comments

Powered by Blogger.