নির্ধারিত সময়ে পদ্মা সেতুতে গাড়ি চড়বে তো? by ড. শেখ আবদুস সালাম

আজকাল পত্র-পত্রিকা খুললে কিংবা রেডিও-টিভি’র দিকে চোখ-কান রাখলে প্রধান খবর হিসেবে নেতিবাচক ঘটনাগুলো যেন বেশি বেশি সামনে চলে আসে। কিন্তু এর মাঝ দিয়েও কিছু কিছু ভালো খবর আমাদের তৃপ্ত করে, আমাদের মধ্যে আশাবাদের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য তো বটেই, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল বাগেরহাটের একজন বাসিন্দা হিসেবে গত দুই/তিন সপ্তাহ ধরে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত পদ্মা সেতু সংক্রান্ত খবরগুলো আমাদের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহবোধের জন্ম দিচ্ছে। বেশ কয়েকদিন আগে আমাদের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, এ বছরের শেষ নাগাদই পদ্মা সেতু সমাপ্ত করার চেষ্টা অব্যাহত আছে। পদ্মা সেতু বর্তমান সরকারের একটি মেগা প্রকল্প এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে নাম্বার ওয়ান। ২১ জানুয়ারির পত্র-পত্রিকায়ও এই প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী যথাসময়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ এবং ৩৮ নাম্বার পিলার স্প্যানের উপর এই সেতুর প্রথম গার্ডার ইরেকশন সম্পন্ন হয়েছিল। তখন টিভি পর্দায় ‘দৃশ্যমান’ পদ্মা সেতু দেখে আমরা আনন্দবোধ করেছিলাম। এ বছর জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ৩৮ এবং ৩৯ নাম্বার পিলারের উপর আরেকটি গার্ডার ইরেকশন সম্পন্ন হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীও কয়েক মাস আগে আশা পোষণ করে বলেছিলেন, ২০১৮ সালের শেষদিকেই এই সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি পার হবে। এসব খবর সত্যিই আমাদের মধ্যে এক অন্য ধরনের আশাবাদের জন্ম দেয়। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার টেস্টমনি হিসেবে দৃশ্যমান পদ্মা সেতু যেমন উন্নয়নের বাস্তব উদাহরণ জোগায়, তেমনি সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিও এর ফলে আমাদের আস্থা অনেক বেড়ে যায়। তবে কিছুদিন ধরে যথাসময়ে পদ্মা সেতু শেষ হওয়ার ব্যাপারে কিছু আশঙ্কার কথাও শোনা যাচ্ছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসের দিকে খোদ জামিলুর রেজা চৌধুরীর মুখ থেকেও সেই আশঙ্কার কথা উচ্চারিত হয়েছিল। তিনি তখন বলেছিলেন, পদ্মা সেতু শেষ হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৬ মাস বেশি সময় লেগে যেতে পারে। অতি সম্প্রতি বিদেশে কর্মরত Kocks Consult GmbH-এর একজন বাংলাদেশি সিনিয়র সেতু-প্রকৌশলী আমার কাছে পদ্মা সেতু যথাসময়ে শেষ হওয়ার ব্যাপারে আশঙ্কার কথা জানিয়ে তার কিছু মতামত বা ধারণা পাঠিয়েছেন। তার সেই ধারণার উপর ভিত্তি করেই আমার এই লেখা। স্মর্তব্য, ২০১৫ সালে যখন পদ্মা সেতুর প্রাথমিক পাইলিং কাজ শুরু হয়, তখন এই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমাকে ২০১৮ সালে ব্রিজ শেষ হওয়ার ব্যাপারে তার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। পদ্মা সেতুর কাজ যখন বিরামহীনভাবে এগিয়ে চলেছে, তখন অপ্রত্যাশিতভাবে পদ্মা নদীর তলদেশের মাটির গতি-প্রকৃতির যে বিষয়টি আমরা জানতে পারছি তা যথাসময়ে সেতু বাস্তবায়নকে খানিকটা হলেও যেন অনিশ্চিত করে তুলেছে। সেই কারণে অনেকে ধারণা করছেন, ২০১৯ সাল বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত সেতুর কাজ গড়িয়ে যেতে পারে। জানা যায়, পদ্মা ব্রিজের কাজটি প্রাথমিকভাবে শুরু করা হয়েছিল যুমনা বহুমুখী ব্রিজ প্রজেক্টের একটি সম্প্রসারিত কাজ হিসেবে (১৯৯৮ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়)। যুক্তরাজ্যের RPT এবং নেদারল্যান্ডসের NEDECOকে দিয়ে এই সেতুর কনসেপচুয়াল ডিজাইন ও প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ করানো হয়েছিল। তারা ২০০০ সালে তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছিল। জাপানের Nippon Koi Co. Ltd এবং CPC এই ব্রিজ নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং প্রিলিমানারি ডিজাইনের কাজটি করেছিল। তারা রিপোর্ট দিয়েছিল ২০০৫ সালে। Maunsell AECOM (যুক্তরাষ্ট্র, হংকং বেজ্ড কোম্পানি) এই সেতুর ডিটেইল্ড স্টাডি ও ফাইনাল ডিজাইন সম্পন্ন করে চূড়ান্তভাবে সুপারস্ট্রাকচার সল্যুশনের কথা বলে ২০১০ বা ২০১১ সালে তাদের রিপোর্ট প্রদান করেছিল। বিশেষ করে AECOM তখন সাব-সয়েল ইনভেস্টিগেশনের কাজটিও করেছিল। তখন তারা প্রতিটি পর্যায়ে নদীর নিচের মাটির স্তর কেমন সে সম্পর্কেও নিশ্চয়ই তাদের মতামত দিয়েছিল। এ সবের ওপর ভিত্তি করেই টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়েছে এবং সেভাবে কনট্র্যাক্ট অ্যাওয়ার্ড বা কর্ম চুক্তি সই করা হয়েছে। এখন টেন্ডার প্রাপক অর্থাৎ কন্ট্রাক্টিং প্রতিষ্ঠান পাইলিংয়ের কাজ করতে গিয়ে দেখছে, মাটি স্তরের চেঞ্জিং রেঞ্জ এত বিস্তার যে, ফাউন্ডেশন নির্মাণের ব্যাপারটিতে এখন বড় আকারে পরিবর্তন করতে হতে পারে। যদি তাই সত্যি হয় সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায়- আগের যে তথ্য বা ফিজিবিলিটি রিপোর্ট কিংবা ডিজাইন, সেখানে গোড়াতেই কি কোনো ত্রুটি ছিল? এখন এসে সেসবের ওপর কি ভরসা করা যাচ্ছে না? বলা হচ্ছে, পদ্মার তলদেশের সয়েলের বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু কী সেই অপ্রত্যাশিত এবং অজানা পরিবর্তন বা কারণ যার জন্য হঠাৎ করে পদ্মা ব্রিজের পাইলিংয়ের কাজ থমকে যেতে বসেছে? কেন এখন বিশেষ করে মাওয়া পয়েন্টের ফাউন্ডেশন তথা পাইলিং নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে? কন্ট্রাক্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়ে একটি চায়না কনস্ট্রাকশন ফার্ম পদ্মা ব্রিজের কাজটি করে যাচ্ছে। কিন্তু এ সময়ে এসে তারা যদি হঠাৎ করে দেখতে পায়, তাদের টেন্ডার ডকুমেন্ট এবং মাঠের (পদ্মার তলদেশের) বাস্তবতা এক নয়, তাহলে তারা কিন্তু প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়া অথবা ভেরিয়েশন অর্ডার (VO) দাবি করে সময় বৃদ্ধি চাইতে পারে। সে ক্ষেত্রে একদিকে যথাসময়ে ব্রিজের কাজ শেষ না হওয়া, অন্যদিকে প্রকল্পে আরও একধাপ অর্থ বৃদ্ধির সুযোগ ঘটা এসব আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্মাণ কোম্পানির দাবি চুক্তিগতভাবে কিন্তু সঠিক। উপর্যুক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তাদের কিন্তু তেমন দোষ দেয়া যাবে না। আমরা ধারণা করতে পারি পদ্মা ব্রিজের শুরুতে যারা ডিজাইন করেছে, পাইল ফাউন্ডেশনের প্রতিটি লোকেশনে যারা সয়েল টেস্ট করেছে কিংবা ফাইনাল কনস্ট্রাকশনের আগে যারা কনফরমেটরি রিপোর্ট দিয়েছে- এগুলো নিশ্চয়ই টেন্ডার ডকুমেন্টে সংযুক্ত ছিল। কন্ট্রাকটিং বা কনট্রাকশন কোম্পানি অন্যের প্রণীত এসব রিপোর্টে সন্তুষ্ট হয়ে অথবা নিজেরা কনফরমেটরি রিপোর্ট তৈরি করে ২০১৮ সালে ব্রিজ নির্মাণ কাজ শেষ করে দেবে বলে কন্ট্রাক্ট সই করেছে। সে ক্ষেত্রে কাজ শেষ করতে তারা সময় বৃদ্ধির বা সে কারণে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির কথা বললে অথবা এ ধরনের কোনো ইস্যু সামনে আনলে সেটা ঠিক হবে না। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, নির্মাণ ঠিকাদার কোম্পানি কাজ শেষ করার মেয়াদ না-কি আরও ২৩ মাস বৃদ্ধি করার জন্য প্রস্তাব প্রদানের চিন্তা-ভাবনা করছে। সে ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর নির্মাণের কাজ ২০২০ সালের পরও গড়িয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় সরকারের একটু খতিয়ে দেখা দরকার আশঙ্কার বিষয়টি কোথায়? এই পর্যায়ে এসে কেন এমন আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে? এর জন্য দায়ী তাহলে কে বা কারা? এই আশঙ্কার সঙ্গে অর্থ বৃদ্ধিরও কিন্তু একটি বড় বিষয় রয়ে গেছে। আগেই উল্লেখ করেছি, পদ্মা সেতু বর্তমান সরকারের জন্য রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের সময়মতো বাস্তবায়নের ওপর ‘সরকারের ওপর মানুষের আস্থা’, বিশেষ করে মানুষের কাছে প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতীক হয়ে ওঠার বিষয়টি ব্যাপকভাবে নির্ভর করছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তা এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যাপারে সেতুমন্ত্রীর অক্লান্তভাবে লেগে থাকা এই দুটি বিষয়ের কারণে পদ্মা সেতু নিয়ে কিন্তু মানুষের মনে একটি আস্থার জায়গা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। এটাতে যেন কোনোভাবেই চিড় না ধরে। সম্প্রতি সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর মূল কাজ ৫৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। তিন বছরে যদি ৫৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়, তাহলে বাকি ১১ মাসে কিভাবে ৪৪ শতাংশ কাজ শেষ হবে সাধারণ মানুষের কাছে সেটি কিন্তু একটি বড় প্রশ্ন। তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়- ব্রিজের জন্য পদ্মা নদী অংশে (অফশোরে) পাইল বসবে বা পাইল ফাউন্ডেশনের কাজ হবে ২৪০টি লোকেশনে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে ৮৮টির এবং আংশিকভাবে শেষ হয়েছে ১০টির। সেক্ষেত্রে এই কাজের অগ্রগতি কিন্তু কম-বেশি ৪০ শতাংশ। ৬০ শতাংশ কাজ এখনও বাকি। নদীর উভয় তীরে পাইল ফাউন্ডেশন হবে ২৮টি। কাজ শেষ হয়েছে ১৬টির। এ কাজেরও ৪২ শতাংশ বাকি। Viaducts-এর (উভয় তীরে) পাইল বসবে মোট ৩৬৫টি। এ ক্ষেত্রে কাজ সম্পন্ন হয়েছে ২৫৭টির অর্থাৎ এখনও প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ বাকি। এ ছাড়াও মূল সেতুতে পিলার (পাইল ক্যাপ, পিয়ের স্টেম, হেড ইত্যাদি) সংখ্যা হবে ৪২টি, যার মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৪টির। একইভাবে নদীর উভয় তীরে Viaducts-এ পাইল ক্যাপ ইত্যাদির প্রয়োজন হবে ৭৭টি; কিন্তু কাজ হয়েছে মাত্র ৪টির। এ ছাড়াও নদীর উপর লোকেশনগুলোতে গ্রিডার (স্টিল ট্রাস এবং কনক্রিট) বসবে ৪১টি। কিন্তু ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত হিসাব মতে দেখা যায়, আজ পর্যন্ত বসানো হয়েছে মাত্র ১টি। নদীর উপর মূল সেতুতে কিংবা নদীর উভয় তীরে Viaducts-র ক্ষেত্রে কম্পোজিট বা কনক্রিট ডেকের কোনো কাজ এখনও পর্যন্ত হাতে নেয়া যায়নি। অর্থাৎ পদ্মা সেতুর মূল কম্পোনেন্টসমূহের কাজের অগ্রগতির যে চিত্র তা কিন্তু এখনও তেমনভাবে স্পষ্ট নয়। যা হোক, আমার ধারণা এসবের একটা প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যা নিশ্চয় সরকার তথা সেতু বিভাগের হাতে রয়েছে। পদ্মা সেতু সময়মতো (ডিসেম্বর ২০১৮) শেষ করার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি সরকার কিংবা সেতু বিভাগেরও এ ব্যাপারে তাদের একটি প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন কিংবা আশাবাদের দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছি, সেটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব আর দৃঢ়তার উপর আস্থা নিয়ে ২০১৮ সালে পদ্মা সেতু শেষ হবে বলে মানুষ যেভাবে আশাবাদী হয়ে বসে আছে, সেখানে যেন বড় ধরনের কোনো ব্যত্যয় না হয়। আমরা যেন এ ব্যাপারে কোনো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে না যাই।
ড. শেখ আবদুস সালাম : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
skasalam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.