শিউরে ওঠা রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ

যে কোনো মূল্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের সাফ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে গণহত্যায় মেতে উঠেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের উসকে দেয়ার পাশাপাশি বেসামরিক পোশাকে সেনা সদস্যরাও রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে অংশ নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সহায়-সম্পত্তি লুট করার পাশাপাশি তাদের বাড়িঘরসহ আস্ত গ্রাম পুড়িয়ে দিতেও পিছপা হয়নি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের রোমহর্ষক এ চিত্র উঠে এসেছে। ওই ঘটনায় ১০ ব্যক্তিকে কেবল রোহিঙ্গা হওয়ার ‘অপরাধে’ পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে গুলি করে হত্যা করে পাশের একটি গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে। উদ্বেগের বিষয়, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি করার সময় রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার সেনাপ্রধান রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করলেও তিনি তাদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং গ্রামবাসী হত্যা করেছে বলে দাবি করেন। কিন্তু রয়টার্সের প্রতিবেদন বলছে, ১০ জনের মধ্যে ৮ জনকেই হত্যা করেছে সামরিক বাহিনী। মিয়ানমারের আধাসামরিক বাহিনীর দু’জন সদস্য বলেছেন, উপরের নির্দেশ ছিল রোহিঙ্গাদের একেবারে সাফ করে দেয়ার। এই প্রথম আধাসামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি এসেছে। তারা জানিয়েছেন, সেনারা বেসামরিক পোশাকে রোহিঙ্গাবিরোধী গণহত্যায় অংশ নিত। তাদের বক্তব্য- ‘সংবাদমাধ্যমে যদি আমাদের ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় দেখা যেত, তাহলে অনেক বড় সমস্যা হয়ে যেত।’
এ থেকেই স্পষ্ট, মিয়ানমারের সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যায় কেবল জড়িতই নয়, তারা সাধারণ মানুষকে দিয়েও যে কোনোভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম গোষ্ঠীটিকে নিশ্চিহ্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে চীন, ভারত ও রাশিয়া নিরাপত্তার ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনকে সমর্থন দিয়ে যেতে পারে না বলে আমরা মনে করি। জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গা নিধনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার তথ্য তুলে ধরার পরও তাদের বিষয়ে মুখ বুজে থাকার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। দেশগুলোর উচিত গণহত্যার সচিত্র প্রতিবেদনটি দেখার পর সরব হওয়া এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ দেশটির সামরিক বাহিনীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করার উদ্যোগ নেয়া। একটি বাহিনী কতটা নৃশংস হলে রোহিঙ্গাদের গুলি না করলে নিজেদের সদস্যদেরও মেরে ফেলার নির্দেশ দিতে পারে, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠার কথা যে কোনো বিবেকবান মানুষের। এটা এখন পরিষ্কার, মূলত রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলাই মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্য। এজন্য ঠুনকো দু’-একটি হামলাকে কেবল অজুহাত হিসেবে নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দেশটির সামরিক বাহিনীর পদ্ধতিগত গণহত্যা বন্ধ এবং তাদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের বিকল্প নেই। হামলার শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কফি আনান কমিশনের সুপারিশের আলোকে নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে দ্রুত ফিরিয়ে নিতে হবে এবং মিয়ানমারে থাকা অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.