সোনার দাম চড়া

বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশেই সোনার দাম সবচেয়ে বেশি। এর পরও গত কয়েক মাসে দেশে সোনার দাম বাড়ানো হয়েছে দফায় দফায়। আর এখন বিয়ের মৌসুমে আরও চড়া সোনার দাম। বর্তমানে দেশে ২২ ক্যারেটের ভালোমানের সোনার ভরি প্রতি দাম প্রায় সাড়ে ৫২ হাজার টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে ৫ শতাংশ ভ্যাট ও মজুরি। ফলে এক ভরি ওজনের সোনার গহনা কেউ কিনতে চাইলে তাকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা গুনতে হবে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববাজারের সঙ্গে বাংলাদেশে সোনার দামের পার্থক্য ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ভারতে ভরি প্রতি সোনার দাম ৪২ হাজার ১৮০ টাকা। দুবাইতে যা বিক্রি হয় ৩৮ হাজার ৩৫৩ টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই কারণে পণ্যটির দাম বেড়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববাজারে দামের ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা ও দেশীয় বাজারে বাড়তি চাহিদা। তাদের মতে, অজ্ঞাত কারণে সোনা আমদানি ও বাজারজাতের নীতিমালা আটকে আছে। এ জন্য চোরাই পথে আমদানি বাড়ছে। এ নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্ত থাকলেও টালবাহানা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে স্বর্ণের নীতিমালা হলেই এখাতে শৃংখলা আসবে। সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে। বাংলাদেশ জুয়েলারি সভাপতি এবং ভেনাস জুয়েলার্সের মালিক গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, বিয়ের মৌসুমে সোনার দাম বেড়েছে। কারণ দেশে বাড়তি চাহিদা রয়েছে। তিনি বিশ্বের অন্যান্য দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের সোনা সরবরাহ করে। আর তারাই ঠিক করে দেয় দাম কত হবে। তিনি বলেন, আমরা কখনই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে দাম নির্ধারণ করতে পারি না। কারণ, আমরা ওই দামে সোনা পাই না। শুধু পার্শ^বর্তী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে কিছুটা সমন্বয় করতে হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমাদের মেলানো যাবে না। তার মতে, বৈধভাবে দেশে কোনো সোনা আমদানি হয় না। যারা বিদেশে যায়, তারা ট্যাক্স ছাড়া ১০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনা কিনে আনতে পারে। এর বাইরে সোনা আনতে হলে ভরিতে ৩ হাজার টাকা কর দিতে হয়। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) তথ্য অনুসারে দেশের স্বর্ণের দোকানগুলোর প্রতি দিনের বিক্রি ২৫ কোটি টাকা। এ হিসাবে সোনার বার্ষিক চাহিদা ২১ টন। এই চাহিদার বেশিরভাগই বিক্রি হয় শীত মৌসুমে। বিয়েসহ অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো এই মৌসুমেই হয়। ফলে এই সাম্প্রতিক সময়ে বিক্রি বেড়েছে। তবে সন্তুষ্ট নয় ক্রেতারা। মেয়ের বিয়ের জন্য মঙ্গলবার ৪ ভরি স্বর্ণ কিনেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ইব্রাহিম আলী। তিনি বলেন, ৬ মাসে এই পরিমাণ স্বর্ণ কিনলে অনেক টাকা বেচে যেত। অন্যদিকে দেশের সোনার বাজারের সিংহভাগই চোরাচালান নির্ভর। বিদেশ থেকে একজন যাত্রী বিনাশুল্কে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ আনতে পারে। যা প্রায় ৯ ভরি। এরপর প্রতি ভরির জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে ৩ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হয়। আর ব্যবসার জন্য সোনা আনতে চাইলে তাকে আমদানি লাইসেন্স থাকতে হয়।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, কাস্টম কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী গত ৫ বছরে দেশে এক তোলা সোনাও আমদানি হয়নি। বৈধ আমদানি না থাকায় এ খাত থেকে শুল্ক আদায়ও শূন্য। তাহলে প্রশ্ন উঠে, টন টন সোনার উৎস কী? ব্যবসায়ীরাও এ ঘোলাটে বিষয়টি অস্বীকার করেন না। কিন্তু উৎস সম্পর্কে সবাই নীরব। অর্থাৎ চোরাচালানেই চলছে দেশের সোনার বাজার। এতে একদিকে দেশের টাকা পাচার হচ্ছে হুণ্ডির মাধ্যমে। অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব। এদিকে বাজুস সূত্র জানায়, এ যাবতকালে সোনার সর্বোচ্চ দাম ছিল ২০১২ সালে। এ সময়ে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরির দাম ছিল ৬০ হাজার ৬৫ টাকা। তবে এরপর দামের ব্যাপক উত্থান-পতন হয়েছে। প্রতিভরি সোনা ৪২ হাজার টাকায়ও নেমেছিল। আর সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দফায় বেড়েছে। এদিকে সোনার দামের পর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। এ ছাড়াও সোনার সঙ্গে ভরিতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা মজুরি ধরা হয়। এদিকে স্বর্ণের নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। জানতে চাইলে গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বর্ণের নীতিমালার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে নীতিমালার জন্য কাজ চলছে। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সোনা কিনতে চাই। ভারতেও ব্যবসায়ীরা ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সোনা কেনে। এরপর কারিগরের মাধ্যমে অলংকার তৈরি করে তা বাজারজাত করে। তিনি বলেন, বাজুসের পক্ষ থেকে গত ২৫ বছর পর্যন্ত বলা হলেও নীতিমালার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমদানিতে কাস্টমস শুল্ক অত্যন্ত বেশি। এ কারণে মানুষ ভিন্ন চিন্তা করছে। এদিকে স্বর্ণের বাজারের বিশৃংখলার জন্য ব্যবসায়ীদের দায়ী করছে দুর্নীতি আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআইবি। এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশের ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন এ বাজার। দামও তারা ঠিক করেন। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশেও বাড়ানো হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে ওই হারে দাম কমানো হয় না। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশের নিজেদের বাজারে নয়, আন্তর্জাতিক চোরাচালানে ট্রানজিট হিসাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করা হয়। কাস্টমসে মাঝে মধ্যে কিছু স্বর্ণ আটক করা হয়। কিন্তু যে হারে চোরাচালান হয়, তার ১০ শতাংশও আটক করা হয় না। আবারও যে সব চোরা কারবারীদের আটক করা হয়, তার উপযুক্ত বিচার হয় না। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। অর্থাৎ দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। তিনি বলেন, চোরাচালান নির্ভর ব্যবসা এভাবে চিরদিন চলতে পারে না। তাই সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.