মসজিদুল আকসার গ্র্যান্ড ইমাম বললেন by তানজিল আমির

মুসলমানদের প্রথম কিবলা পবিত্র মসজিদুল আকসার গ্র্যান্ড ইমাম ও খতিব ড. আলী ওমর ইয়াকুব আল আব্বাসী সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের কয়েকটি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। গরিব অ্যান্ড ইয়াতিম ট্রাস্ট ফান্ডের উদ্যোগে টেকনাফের মুচনী এলাকায় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন।
সফরের ব্যস্ততার মাঝেও একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন যুগান্তরকে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- তানজিল আমির শাইখ আলী ওমর ইয়াকুব আব্বাসী আল আকসা মসজিদের গ্র্যান্ড ইমাম ও ফিলিস্তিনের একজন শীর্ষস্থানীয় আলেম। তিনি বিখ্যাত সাহাবা হজরত আব্বাস (রা.)-এর বংশধর। ঐতিহাসিককাল থেকে আব্বাসী পরিবার আল আকসার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তিনিও দীর্ঘদিন ধরে মসজিদুল আকসার খেদমতে রয়েছেন। শাইখ ইয়াকুব আব্বাসী ১৯৬০ সালে ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করেন। তার লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা সবকিছুই ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে হয়েছে। তিনি ১৯৮৩ সালে আল কুদস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত শাইখ ইয়াকুব আব্বাসী ফিলিস্তিনের বিভিন্ন মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি বাইতুল মাকদিসের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে শরঈয়্যার পরিচালক হন। ১৯৯৩ সালে তিনি আল আকসা মসজিদের জাহরি নামাজ (মাগরিব, ইশা ও ফজর) ও তারাবির ইমাম পদে নিয়োগ পান। এরপর আজ পর্যন্ত তিনি আল আকসার খেদমতে রয়েছেন। তার তিলাওয়াত মধুর ও মনমুগ্ধকর। তিনি হাফস রিওয়ায়েত অনুযায়ী কোরআন তিলাওয়াত করেন।
প্রশ্ন : আল আকসা ও ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি জানতে চাই?
উত্তর : ফিলিস্তিনের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্বের সবাই অবগত রয়েছে যে, অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল ফিলিস্তিনের কিছু অংশ দখল ও নিয়ন্ত্রণ করছে। দীর্ঘসময় ধরে এ সমস্যাটি চলছে। ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির জন্য ফিলিস্তিনি জনগণ দীর্ঘদিন সংগ্রাম করছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী জনতার পক্ষে রয়েছেন। বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে ইসরাইল তাদের দখলদারিত্ব সম্প্রসারিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করে এ দখলদারিত্ব স্থায়ী চেষ্টা করেছিলেন। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বিরোধিতায় তার এ কাজটি হালে পানি পায়নি। আলহামদুলিল্লাহ, ফিলিস্তিনের জনগণ যেভাবে স্বাধীনতার পক্ষে লড়ে যাচ্ছে, বিশ্ববাসীর সহায়তা অব্যাহত থাকলে তা অচিরেই সম্ভব হবে। এমনিতে ইহুদিদের নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গা ছাড়া সবটুকুই মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদ ইহুদিরা কখনই দখল করতে পারেনি। মাঝেমধ্যে সংঘর্ষ বেধে গেলে তারা শুধু মসজিদের প্রবেশাধিকারে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করে। বাকি স্বাভাবিকভাবে মসজিদটি পূর্ণভাবে মুসলমানদের দখল ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সামনেও ইনশাআল্লাহ থাকবে। কারণ কোরআনে আল্লাহ মসজিদে আকসার চারপাশ বরকতময় ও নিরাপত্তার ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রশ্ন : বাইতুল মুকাদ্দাস কি তা হলে পূর্ণভাবে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে?
উত্তর : জি, আলহামদুলিল্লাহ। বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদটি পূর্ণভাবেই মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আছে এবং ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিজয়ের পর থেকে কখনও মুসলমানদের হাতছাড়া হয়নি। একটি বিষয় বুঝতে হবে। আল আকসার সীমানাটা অনেক বড়। মূল মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের বাইরে একটি জায়গা আছে, যেটাকে ইহুদিরা হজরত সুলাইমান (আ.)-এর উপাসনালয় মনে করে। সামান্য এ অংশটুকুই তারা নিয়ন্ত্রণ করে। যেখানে তারা উপাসনা করে। এটি মসজিদের মূল সীমানার বাইরে।
প্রশ্ন : মসজিদে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা বাধার কথা শুনতে পাই, তা হলে সেটি কখন ও কেন হয়?
উত্তর : এই যে বললাম আকসার কম্পাউন্ড অনেক বড়। পুরো কম্পাউন্ড ঘুরতে কয়েক ঘণ্টা লাগবে। এ কম্পাউন্ডের ভেতরে চল্লিশ হাজারের বেশি মুসলমান বসবাস করে। এর মধ্যে মাদ্রাসা, মসজিদ, স্কুলসহ সবকিছুই রয়েছে। যখন সংঘর্ষ বাধে তখন ইসরাইলি বাহিনী এ কম্পাউন্ডের বাইরের লোকদের প্রবেশে বাধা দেয়। কিন্তু এর ভেতর যে বিশালসংখ্যক মুসলমান বসবাস করে তারা তখনও বাইতুল মুকাদ্দাসের নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। সংঘর্ষের সময়ও বাইতুল মুকাদ্দাসের নামাজসহ সবকিছু চালু থাকে। মারাত্মক পরিস্থিতিতেও এক ওয়াক্তের জন্য নামাজ বন্ধ হয় না। আকসা এলাকায় ইহুদিদের যে নিয়ন্ত্রণ তা ইনশাআল্লাহ বেশিদিন থাকবে না।
প্রশ্ন : বর্তমানে মসজিদটি কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে?
উত্তর : ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো হয়। তখন থেকে জর্ডান সরকার এর দায়িত্ব গ্রহণ করছে। মসজিদের আর্থিক বিষয়টি জর্ডান সরকারই নির্বাহ করে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো ফিলিস্তিনের ধর্মীয় পরিষদ ও আলেমরা পরিচালনা করেন। আমিসহ বাইতুল মুকাদ্দাসের মোট ৫ জন ইমাম রয়েছেন। যারা ফিলিস্তিনের শীর্ষস্থানীয় আলেম। ইদানীং ফিলিস্তিন সরকার জর্ডানের সঙ্গে আর্থিক বিষয়টিসহ সব বিষয়ে সমন্বয়ের চেষ্টা করছেন।
প্রশ্ন : বাইতুল মুকাদ্দাস প্রথম কবে মুসলমানদের হাতছাড়া হল?
উত্তর : আল আকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা। সব নবী-রাসূলগণের স্মৃতিধন্য পবিত্র এ মসজিদটি ইসলাম ও মুসলমানদের ঐতিহ্যের স্মারক। শুধু বাইতুল মুকাদ্দাস নয়, পুরো ফিলিস্তিনই পুণ্যভূমি। ফিলিস্তিনে অসংখ্য নবী-রাসূল স্থায়ীভাবেই ছিলেন। হজরত মারইয়াম (আ.) ও হজরত ঈসাসহ (আ.) অনেকের জন্ম এ ভূমিতেই। ৬৩৮ সালে হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ফিলিস্তিনে মুসলিম শাসন শুরু হয়। শুরু থেকেই মুসলমান, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের সবাই মিলেমিশে ফিলিস্তিনে বসবাস করছে। হজরত ঈসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংশ্লিষ্ট বিশেষ কয়েকটি পবিত্র জায়গা খ্রিস্টান সম্প্রদায় তাদের উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার করে। এ ছাড়া অন্য মসজিদগুলো মুসলমানদেরই। বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদটি শুরু থেকেই মুসলমানদের ছিল। এর মধ্যে শুধু ১০৯৬ সালে খ্রিস্টান সম্প্রদায় এর দখল নিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘসময় সংগ্রাম ও জিহাদের মাধ্যমে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ১১৮৭ সালে ফিলিস্তিন আবার মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
প্রশ্ন : ফিলিস্তিনের নাগরিকদের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে চাই?
উত্তর : ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রার মান খুবই ভালো। শিক্ষাদীক্ষাসহ সব বিষয়ে তারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে যেহেতু রাষ্ট্রীয় কিছু সমস্যা রয়েছে, তাই যে কোনো পরিস্থিতির জন্য মানসিকভাবে তাদের প্রস্তুত থাকতে হয়। ফিলিস্তিনে মুসলমান, খ্রিস্টান সবাই মিলেমিশে বসবাস করে। স্বাধীনতার ব্যাপারে খ্রিস্টানরা মুসলমানদের সঙ্গেই রয়েছে। রাষ্ট্রীয় নানা সমস্যা থাকলেও শিক্ষার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি জনগণ অনেক এগিয়ে রয়েছে। আট-নয় বছরের বাচ্চারাও শুদ্ধ আরবি ও ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে বড়বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষাবীদসহ বিভিন্ন কাজে ফিলিস্তিনিরা বেশ এগিয়ে রয়েছে। ইনশাআল্লাহ ফিলিস্তিন যদি স্বাধীন হয়, তা হলে বিশ্বের সব নাগরিকই উপকৃত হবে। কারণ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, এর আশপাশ সবই বরকতপূর্ণ। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন উৎপাদন খুবই বরকতময়। তা ছাড়া এ দেশটি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো।
প্রশ্ন : স্বাধীন ফিলিস্তিনের জন্য মুসলিম বিশ্বের কী ভূমিকা আপনারা দেখতে চান?
উত্তর : মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধতাই ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা আনতে পারে। আরব দেশগুলোসহ বিশ্বের সব মুসলিম দেশ যদি একতাবদ্ধ হয়ে জাতিসংঘসহ সর্বক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ করে, তা হলে অবশ্যই ফিলিস্তিন পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। আমাদের অনৈক্যের কারণেই বিশ্বজনমত অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তিন স্বাধীন হচ্ছে না। আজ আরবের চেয়ে নন-আরব মুসলিম এবং ওলামা অনেক বেশি। সামনে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। অচিরেই মুসলমানরা ফিলিস্তিন স্বাধীন করবে। এমনকি বাংলাদেশের কারও হাতেও মুক্ত ফিলিস্তিন হতে পারে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ তো সবসময় ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিল, বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
উত্তর : আলহামদুলিল্লাহ, এটি আমাদের জন্য বড় আনন্দদায়ক বিষয় যে, আমরা বাংলাদেশকে সবসময় আমাদের পাশে পেয়েছি। বাংলাদেশ-ফিলিস্তিনের বন্ধুত্ব অকৃত্রিম। মসজিদুল আকসার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের যে আবেগ ও সম্মান দেখেছি, তাতে আমি অবিভূত। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে বাংলাদেশ সরকার সবসময় জোরদার ভূমিকা রেখেছে। অনেক আরব দেশ থেকেও বাংলাদেশের পদক্ষেপ জোরালো ও শক্তিশালী ছিল। কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আল আকসা অবশ্যই পূর্ণভাবে মুসলমানদের হবে। আমি বাংলাদেশের মুসলিম ভাইদের সেদিনের দাওয়াত দিয়ে গেলাম।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ সফরের অনুভূতি জানাবেন?
উত্তর : বাংলাদেশে আগেও আমি এসেছিলাম। মাশাআল্লাহ, সত্যিই সুন্দর একটি দেশ। দ্বীনের প্রতি এ দেশের মানুষ খুব আন্তরিক। বাংলাদেশে মাদ্রাসা ও তাবলিগের মেহনত জোরেশোরে চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত জামাত যাচ্ছে। এ সফরে আমি মূলত এসেছি মাজলুম রোহিঙ্গাদের দেখতে। নির্যাতিত এ বিশাল জনসংখ্যাকে আশ্রয় ও সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশ মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
tanjil.amir@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.