রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ছাপ অর্থনীতিতে by সাজ্জাদ আলম খান

৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চলছে রাজনৈতিক নেতাদের বাহাস। সরকার, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও বিএনপি- এ দিনকে ঘিরে সবাই বেশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থার ছাপ পড়েছে ব্যবসার পরিবেশে। শেখ হাসিনার এ মেয়াদের সরকারে মাঠের বিরোধী দলের তেমন কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি ছিল না বললেই চলে। অনেকটা কর্মনাশা রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে এসে দলটি গোলটেবিল বৈঠক, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের নানা ধরনের প্রতিবাদী উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, হরতালের কর্মসূচি আর দেশে ফিরে আসবে না। এতে স্বস্তি ছিল ব্যবসায়ী মহলে। কিন্তু এখন যেন তা বেশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের শেষদিকে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। নির্বাচনী বছরে বিনিয়োগ স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। উদ্যোক্তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। বিগত চারটি নির্বাচনী বছরের বিনিয়োগ পরিসংখ্যান অন্তত তা-ই বলছে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অর্থবছরের বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। ২০০১ সালের নির্বাচনী বছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির চিত্রও অনেকটা এমনই। বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধিতে ছিল ধীরগতি। ওই অর্থবছরে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও এর আগের অর্থবছরে ছিল এর সামান্য বেশি। রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের পর ২০০৯ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অর্থবছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশ। আর এর আগের অর্থবছরে ছিল সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে। আর সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে। ওই অর্থবছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৭ ভাগ। আর এর আগের অর্থবছরে ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। নির্বাচনকে ঘিরে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়ে থাকে। ক্ষমতার পালাবদল হলে কোন কোন খাত গুরুত্ব পাবে, তা নিয়ে চলে পর্যালোচনা। নীতি কাঠামোর ধারাবাহিকতা থাকা নিয়ে দেখা দেয় এক ধরনের অনিশ্চয়তা।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগের জন্য ধীরগতিতে চলার নীতি অনুসরণ করে থাকেন উদ্যোক্তারা। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর পেছনেও ‘বিনিয়োগ’ করার রেওয়াজ এ দেশে অনেকদিনের। অনেক উদ্যোক্তার হয়তো ব্যয় বাড়ে; কিন্ত তা উৎপাদনশীল খাতে নয়। বর্তমান অর্থনীতির গতিধারা উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে তেমনভাবে অগ্রসর হচ্ছে না। মুদ্রানীতির প্রভাব পড়ছে ঋণ বাজারে। ব্যাংক ঋণে সুদের হার বাড়বে। সরকার ব্যাংকিং খাতকে অবহেলা করেছে। ঋণখেলাপি বেড়েছে এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে। ডলারের দামও বেড়ে যাচ্ছে। তার ওপরে শিল্পের জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা তো আছেই। ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারও সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। যেটা ব্যবসায়ীদের জন্য খুবই উদ্বেগের দিক। ঋণে সুদের হার বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়, বিনিয়োগ কমে যায়, ব্যবসা পরিচালনার খরচও বেড়ে যায়। এজন্য আগামীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তদারকি প্রয়োজন। মুদ্রানীতি খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। প্রবৃদ্ধির সুফল সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ব্যাংকিং খাত সুদৃঢ়করণ ও প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার মতো পরিকল্পনা ঘোষিত মুদ্রানীতিতে দেখা যাচ্ছে না। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি এখানে অনেকটাই উপেক্ষিত হয়েছে। নির্বাচনী বছরে অর্থনীতির ওপর নানাবিধ চাপ থাকে। এরই মধ্যে সে চাপ আসতে শুরু করেছে। এসব কারণে উদ্যোক্তারা নির্বাচন দেখে তারপর ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। চলতি বাজেটে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, তার সঠিক কোনো বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা আস্থা পাচ্ছেন না। ২০১৭ সালে দারিদ্র্য কিছুটা দূর হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলোয় বড় বিনিয়োগ চলছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ঘাটতি সাড়ে ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থবছরের বাকি সময়ে এ ঘাটতি ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু বাণিজ্য ঘাটতিই নয়, এ অর্থবছরে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও বড় ঘাটতির আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ৪৩৪ কোটি ডলার। রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যেটুকু বেশি, তার পার্থক্যই বাণিজ্য ঘাটতি। আর চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রফতানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি ব্যয় বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। আর আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই চলতি হিসাবের ভারসাম্যে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমদানি ব্যয় বাড়লেও প্রকৃত আমদানির চিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বাড়ছে। এখানে বিনিয়োগকারীদের খেয়ালি আচরণ বোঝা বড় দায়। কয়েকদিন আগে অস্থিরতার কারণ হিসেবে বলা হল মুদ্রানীতির প্রভাব পড়তে পারে। এখন বলা হচ্ছে রাজনৈতিক উত্তাপের বিষয়। এ কারণে সতর্ক বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অনেকে। একের পর এক ইস্যুকে কেন্দ্র করে নতুন করে বিনিয়োগে আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ। ফলে বিনিয়োগ কমেছে। প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতা দেখা দিলে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে রাজস্ব আদায়ে। গত চার অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে গড় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাংলাদেশে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশে দাঁড়ায়, যেখানে একই সময়ে গড় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ভারতে ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ, নেপালে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শ্রীলংকায় ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় কম হওয়ার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বেশ হতাশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।
জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। কিন্তু আয়কর, মূল্য সংযোজন কর এবং শুল্ক- এ তিন খাত মিলিয়ে আয় হয়েছে ৭৫ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতার কারণে বিনিয়োগের কার্যকারিতা কমে যায়। প্রতিবছর সরকার যে এডিপি গ্রহণ করে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয় না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৭ শতাংশ। অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে সরকারকে এডিপির বাকি ৭৩ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে হবে, যা অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং। সময়মতো অর্থছাড় না হওয়া, জমির অধিগ্রহণে বিলম্ব, দক্ষ প্রকল্প পরিচালকের অভাব এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। অভিজ্ঞতার অভাব, কর্মকৌশল গ্রহণে সরকারের ধীরগতি, ক্রয় কাজে জটিলতা, যোগ্য পরামর্শকের অনুপস্থিতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে তেমন গতি আসেনি। প্রকল্প পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় থাকার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেলে সেই প্রকল্প পরিচালকরা তা মানেন না। এমনকি অনেক প্রকল্প পরিচালকের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো ধারণাও থাকে না। এ বছর বাকি ৬ মাসে ৭৩ শতাংশ বা এর কাছাকাছি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এডিপি বাস্তবায়ন হবে চ্যালেঞ্জিং। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও প্রবল করে তুলছে। ফলে উৎপাদনমুখী খাতগুলোয় প্রয়োজনীয় সম্পদ বণ্টনে অদক্ষতা দেখা দেয়, যা দেশের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। মোট দেশজ উৎপাদনের অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা, অর্থ পাচারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অস্থিতিশীলতা ও অদূরদর্শিতা প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সাজ্জাদ আলম খান : সাংবাদিক
sirajgonjbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.