৮ ফেব্রুয়ারি ঘিরে জনমনে উৎকণ্ঠা

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় কাল। এ নিয়ে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। বিশৃঙ্খলা রোধ ও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে গুলি চালাতেও বলা হয়েছে তাদের। সন্দেহ হলেই ট্রেন, বাস ও লঞ্চে চালানো হচ্ছে তল্লাশি। রাজধানীর সব প্রবেশমুখে বসানো হয়েছে নিরাপত্তা চৌকি। ঢাকা মহানগরীতে বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সব ধরনের অস্ত্র বহন এবং মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটের আগে-পরের নাশকতার বিষয়টি মাথায় রেখে রেলে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনে তৈরি করা হয়েছে বাংকার। চলন্ত ট্রেনে ইঞ্জিন ও গার্ডরুমে অস্ত্রধারী পুলিশ দেয়া হয়েছে। রেললাইন, সেতু ও ওয়ার্কশপে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে কোনো ধরনের নৈরাজ্য করতে দেয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের যা যা করার, তা-ই করবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, জান-মালের নিরাপত্তায় পুলিশ সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকবে। পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালাও-পোড়াও রোধে পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট এবং অন্যান্য সংস্থাকে সমন্বয় করে কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সারা দেশে পুলিশ সুপারদের ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দিয়েছে সদর দফতর।
অস্ত্র বহন ও মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ : ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় বলেন, একটি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগরীতে অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী জননিরাপত্তা বিঘ্ন ঘটাতে পারে বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে ওইদিন ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সব ধরনের অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি। যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে/বসে কোনো মিছিল-সমাবেশ করা যাবে না। মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো আরেক বার্তায় ডিএমপি কমিশনার বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি গৃহপ্রাঙ্গণ বা ছাদে, রাস্তা বা উন্মুক্ত স্থানে মাইক্রোফোন, লাউডস্পিকার বা এমন যন্ত্র বাজিয়ে সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে না।
কঠোর হবে পুলিশ : মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিন্টো রোডের কার্যালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যদের ব্রিফিং দিয়েছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এতে যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, জনসাধারণ ও নিজের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব। আইন অনুযায়ী নিজের এবং জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ব্রিফিংয়ে থাকা একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে কেউ যেন নাশকতা করতে না পারে, সেজন্য যা করণীয় তা-ই করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দণ্ডবিধির ৯৬ থেকে ১১২ ধারা অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।’ এসব ধারা অনুসরণের অর্থ কী- জানতে চাইলে কর্মকর্তারা বলেন, নিজের অথবা অন্যের জানমাল রক্ষায় প্রয়োজন হলে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম) সহেলী ফেরদৌস যুগান্তরকে বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি ঘিরে পুলিশ সতর্ক রয়েছে। যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা রোধে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নগরীতে তল্লাশি : রাজধানীর সাতটি প্রবেশমুখে বিশেষ নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়েছে। আবদুল্লাহপুর, বাবুবাজার, পোস্তগোলা, যাত্রাবাড়ী, গাবতলী, বসুন্ধরা, মোহাম্মদপুর এবং খিলগাঁওয়ে বসানো এসব চৌকিতে মঙ্গলবার দিনভর তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। ডিএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শতাধিক তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। বুধবারের মধ্যে আরও অর্ধশতাধিক চৌকি বসানো হবে। ৮ ফেব্রুয়ারি হামলা, বিশৃঙ্খলা এবং নাশকতা হতে পারে- এমন শতাধিক স্পট চিহ্নিত করে কাজ শুরু হয়েছে। সূত্র জানায়, গোয়েন্দাদের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গেও দফায় দফায় বৈঠক করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের ডিসি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ৮ ফেব্রুয়ারি মাঠে থাকবেন। বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড এবং গুরুত্বপূর্ণ স্পটে অবস্থান নিয়ে তারা বিশৃঙ্খলাকারীদের প্রতিহত করবেন।
সারা দেশে নজরদারি : পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, নাশকতা রোধে সারা দেশেই গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পূর্বে নাশকতা করেছে এবং নাশকতা করতে পারে- এমন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে সারা দেশে এরই মধ্যে গ্রেফতার অভিযান চলমান রয়েছে। সাত দিনে সারা দেশে এক হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নাশকতা সরঞ্জাম এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেন নিয়ে যেতে না পারে, সেজন্য সারা দেশে বিশেষ অভিযান চলছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ও মেসে অভিযান চলছে। নজরদারি করা হচ্ছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও।
আবাসিক হোটেল ও মেসে নজরদারি : সারা দেশের মেস ও আবাসিক হোটেলে বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। অতিথিদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে কক্ষ ভাড়া দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে এরই মধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আবাসিক হোটেলে অতিথির নাম-ঠিকানা, ছবি সংরক্ষণ, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি ও মোবাইল নম্বর সংরক্ষণ করা হচ্ছে কিনা, তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। বিভিন্ন বাসা-বাড়ি ও মেসের বাসিন্দা ছাড়া বহিরাগতরা অবস্থান করছেন কিনা, এ বিষয়েও খোঁজ নেয়া হচ্ছে।
নিরাপত্তার চাদরে রেল : মঙ্গলবার কয়েকটি রেল স্টেশন ঘুরে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা চোখে পড়েছে। কমলাপুর ও বিমানবন্দর স্টেশনে নাশকতা মোকাবেলায় বাংকার তৈরি করে অস্ত্র তাক করে থাকতে দেখা গেছে পুলিশ সদস্যদের। কাউন্টার, অফিস, তেলের ডিপো, ওয়ার্কশপ, রেললাইন ও সেতু এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশও দেখা গেছে এদিন। চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনে অস্ত্রধারী পুলিশ সদস্য এবং ট্রেনের কামরা ও গার্ডরুমেও দেখা গেছে পুলিশ। স্টেশনের প্রবেশপথে বসানো তল্লাশি চৌকি পেরিয়েই যাত্রীদের ভেতরে ঢুকতে হচ্ছে। রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আবুল কাশেম যুগান্তরকে বলেন, কোনো অবস্থাতেই কাউকে রেলের সম্পদ ধ্বংস করতে দেয়া হবে না। ধ্বংস ও জ্বালাও-পোড়াও ঠেকাতে প্রয়োজেন গুলি চালানো হবে। রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন যুগান্তরকে জানান, রেলপথ হরতাল-অবরোধের আওতার বাইরে থাকে। কিন্তু ২০১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় রেল ভয়াবহ নাশকতার শিকার হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবার আমরা সতর্ক রয়েছি। স্টেশন, সেতুসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় পুলিশ সতর্কাবস্থায় রয়েছে। অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রেল শ্রমিক লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, আমাদের ৬০টি শাখার নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান নেবে। ৮ ফেব্রুয়ারি ঘিরে যে কোনো নাশকতা প্রতিহত করা হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জল হোসেন যুগান্তরকে জানান, রেল জনগণের সম্পদ, এটি রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। সহিংসতা প্রতিরোধ, প্রতিহত করতে সাধারণ যাত্রীদেরও সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.