ভিআইপি করে দাও, হে দয়াময় by আনিসুল হক

আমাকে খুগুব্য করে দাও, হে দয়াময়। খুগুব্য মানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ইংরেজিতে ভিআইপি। এ দেশে এখন রথীন্দ্রনাথ রায়ের মুক্তিযুদ্ধের গান অচল-‘ছোটদের বড়দের সকলের/গরিবের নিঃস্বের ফকিরের/আমার এ দেশ সব মানুষের।’ এই দেশ এখন সবার নয়, এই দেশ এখন খুগুব্য বা ভিআইপিদের। তাঁদের জন্য বাসের ট্রেনের প্লেনের লঞ্চের টিকিট রেখে দেওয়া হয়। এমনকি স্টেডিয়ামের গ্যালারির টিকিটও বেশির ভাগ তাঁরাই পেয়ে যান। সারা রাত যে প্রকৃত ক্রীড়ামোদীরা ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে টিকিটের জন্য, সকালবেলা টিকিটের বদলে পায় পুলিশের লাঠ্যৌষধি, তাদের ভেতর থেকেই কিন্তু বেরিয়ে আসে মুস্তাফিজ-মাশরাফিরা। তারা পিঠে লাঠির আঘাত নিয়ে রাস্তার টিভির সামনে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে চেঁচায়।
আর ভিআইপি বক্সে বসে ভিআইপিরা বলাবলি করেন, উইকেট ভেঙে দিলে খেলাটা হবে কোথায়! উইকেট যে ভাঙে, তাকে রক্ষক বলছে কেন? আসলেই তো, রক্ষকেরা কেন ভাঙবেন? কিন্তু তাঁরাই ভাঙেন। ট্রাফিক কানুন ভেঙে উল্টো দিকে গাড়ি চালান। উল্টো দিকে গাড়ি চালালে চাকা ফাটিয়ে দেওয়ার যন্ত্র বসানো হলো একবার, ধরা খেলেন ভিআইপিরা। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, কে করিবে তবে রক্ষা। আর এই দেশে ভিআইপিদের সংখ্যা-বিস্ফোরণও ঘটে গেছে। গিনেস রেকর্ড বইয়ে আমাদের নাম ওঠা উচিত, সর্বোচ্চসংখ্যক ভিআইপির জন্ম দিয়েছে স্বর্ণপ্রসবিনী দেশমাতা। রাস্তায় সাইরেন বাজছে, বিশেষ হর্ন বাজছে, পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে বাকিদের শাসাচ্ছে-ওরে আমপাবলিক, সর, সর, সরে দাঁড়া, আমপাতা জোড়া জোড়া. মারব চাবুক চলবে ঘোড়া। চাবুক পাবলিকের পিঠেই মারব। ভিআইপি-বহরের সান্ত্রিদের চোখ এত গরম থাকে যে ডিমে নজর পড়লে ওই ডিম সেদ্ধ হয়ে যাবে। ভিআইপিরা যে উল্টো দিকে চলেন, ভিআইপিরা যে রাস্তার মানুষদের দুর্ভোগের কারণ হন-এটা কি চলতে দেওয়া উচিত। সমস্যার চমৎকার সমাধান বের করা হয়েছে, ভিআইপিদের জন্য আলাদা লেন। আমেরিকায় কিন্তু আছে। ইমার্জেন্সি লেন। প্রধানত পুলিশদের জন্য; অ্যাম্বুলেন্স, দমকলের জন্য। কোনো বিপদ হলে সাধারণ নাগরিকদের বাঁচাতে ছুটে যান তাঁরা।
ওই লেনকে অবশ্য কেউ ভিআইপি লেন বলে না। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হবেন যিনি, তিনি সকালবেলা হেঁটে বাড়ি ফেরার সময় পাউরুটি কেনেন, ইউরোপে অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রিপুত্ররা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে জরিমানা খান। আমাদের দেশের প্রকৃত মালিক জনগণ অগণন ভিআইপির চাপে ত্রাহি ত্রাহি করে। আমাদের দেশে যদি রাস্তাঘাট উন্নত হতো, পর্যাপ্ত হতো, তাহলে জরুরি সার্ভিস লেন দুপাশে রাখা যেত। যে দেশে মহাসড়কে গরুগাড়ি চলে, ফুটপাতে দোকান বসে এবং গাড়িঘোড়া উঠে পড়ে, সে দেশে সার্ভিস রোডের স্বপ্ন যিনি দেখেছেন, তাঁকে আকাশকুসুম পদক দেওয়া হোক। যিনি ভিআইপি লেনের স্বপ্ন দেখেছেন, তাঁকে বলব, দুবাইতে উড়ন্ত ট্যাক্সি সার্ভিস হচ্ছে, ভিআইপিদের জন্য সেসব এই দেশে নিয়ে আসুন। ভিআইপিরা অতি গুরুত্বপূর্ণ, আমরা তাঁদের মাথার ওপরেই দেখতে চাই, আমাদের অচল লেনের পাশে ছুটে গেলেও তাঁরা তো একই সমতলেই থেকে যাবেন। তাতে তাঁদের আসল গৌরব দেখানো যাবে না। আমরা অবশ্যই জানি, এই দেশের অগ্রাধিকার সব বাই দ্য ভিআইপিজ, অব দ্য ভিআইপিজ, ফর দ্য ভিআইপিজ।

No comments

Powered by Blogger.