মাছ-গোস্ত-ডিম : দিনে কতটা দরকার?

আমিশাষী হন বা নিরামিশাষী, খাবারের মাধ্যমে প্রোটিন গ্রহণ করতেই হবে। কারণ প্রোটিন আমাদের শরীরের গঠনে সাহায্য করে। তাই বাচ্চা থেকে বয়স্ক, সন্তানসম্ভবা নারী থেকে ডায়াবেটিসের রোগী— সবার জন্যই প্রোটিন অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। এ নিয়ে কিছু তথ্য জানা থাকা দরকার।
* প্রোটিন কী? শরীরে প্রোটিনের প্রয়োজন হয় কেন?
** প্রোটিন এক ধরনের ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট অর্থাৎ মুখ্য পরিপোষক। বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও মস্তিষ্কের গঠনে প্রোটিন একান্ত প্রয়োজনীয়। এছাড়াও হর্মোন ও উৎসেচকের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে প্রোটিন। এমনকি সহায়তা করে বিভিন্ন বিপাকজাত কাজেও। আবার হাড় ও পেশির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ করে এই বিশেষ উপাদানটি।
* প্রতিদিন খাদ্যে কতটা পরিমাণ প্রোটিন থাকা দরকার?
** আমরা সারা দিনে মোট যে পরিমাণ খাদ্য খাই, তার মধ্যে ২০-২৫ শতাংশ প্রোটিন থাকা জরুরি। তবে পরিমাণটা জানা প্রয়োজন। কারণ বয়স অনুযায়ী প্রোটিনের চাহিদাও বদলে যায়।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে :
২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত গড় বয়স ও ওজন অনুপাতে প্রতি কেজিতে ১ থেকে ১.৫ গ্রাম প্রোটিন প্রতিদিন নেয়া উচিত। অর্থাৎ কারো ওজন যদি ৩০ কেজি হয়, তবে তাকে খেতে হবে ৩০ থেকে ৪৫ গ্রাম প্রোটিন।
প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে
প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রেও প্রতি আদর্শ কেজি ওজন অনুযায়ী ১ থেকে ১.৫ গ্রাম প্রোটিন প্রতিদিন প্রয়োজন।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে
তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের ক্ষেত্রে ভালো হলো চর্বিবর্জিত প্রোটিনের উৎস থেকে খাদ্য নির্বাচন করা। তাই তারা খাবারের মেন্যুতে রাখুন ডিম, মাছ, কম ফ্যাটযুক্ত মুরগির গোস্ত। নিরামিশাষীরা সয়াবিন, রাজমা এবং বিভিন্ন রকমের ডাল মিলিয়ে মিশিয়ে খেতে পারেন।
সন্তানসম্ভবা নারীর ক্ষেত্রে
প্রেগনেন্সির সময় প্রোটিনের চাহিদা একটু বেশি থাকে। কারণ সন্তানসম্ভবা মা’কে একসঙ্গে দুটি প্রাণের দেখভাল করতে হয়। অর্থাৎ স্বাভাবিক অবস্থায় ৫০ কেজি ওজনের পূর্ণবয়স্ক একজন নারীর ৫০-৬০ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু সন্তান আসার পর সেই নারীকেই ৮০-৮৫ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। মোটকথা সন্তান এলে প্রত্যেক মহিলাকেই প্রতিদিন মোটামুটি ৮৫ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করতেই হবে।
ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে
ডায়াবেটিস মেলিটাসে ভোগা রোগীকে শর্করা এবং ফ্যাটযুক্ত খাবার কম খেতে বলা হয়। না হলে ইনসুলিন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এদিকে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে অ্যামাইনো অ্যাসিডের উপস্থিতিতে। তাই ডায়াবেটিসের রোগীকেও খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে মাছ, দুধ, পনির, ছানা, টকদই রাখতে হবে।
* শরীরে প্রোটিনের মাত্রা বেশি হলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?
** যারা শরীরচর্চা করেন বা জিমে যান তারা একাধিক প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খান এবং উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ হেল্থ ড্রিঙ্ক পান করেন। মনে রাখতে হবে, কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই নিজের ইচ্ছে মতো এইভাবে প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ এত প্রোটিন শরীরের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এই সমস্ত ক্ষেত্রে লিভার ও কিডনির একাধিক সমস্যা আসতে পারে।
* কোন খাবারে প্রোটিন বেশি থাকে?
** আমাদের শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান হলো অ্যামাইনো অ্যাসিড। এই উপাদান শরীরে নিজের থেকে খুব কম পরিমাণে উৎপন্ন হয়। সাধারণত আমরা অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিড খাবার থেকেই পাই। সেই কারণেই আমাদের সেদ্ধ ডিম, কম তেল-মশলা দিয়ে রান্না করা মাছ, গোস্ত খাওয়া উচিত। এছাড়াও অঙ্কুরিত ছোলা, পাঁচমেশালি ডাল, সয়াবিন, রাজমা, মুসুর ডাল, পনির খাওয়া যায়। মিজো এবং টকদইয়ে ভালো মাত্রায় প্রোটিন পাওয়া যায়। যারা নিয়মিত শরীরচর্চা করেন বা জিমে যান তারা ব্রাঞ্চড চেন অ্যামাইনো অ্যাসিড (Branched Chain Amino Acid) এবং এল কারনিটাইন (L Carnitine)-এর উপর ভরসা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে পেশি সতেজ হয় এবং পেশির ক্ষয়রোধ হয়।
* প্রোটিন পাউডার কী?
** অনেক সময় বাচ্চা থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স্ক মানুষ, সন্তানসম্ভবা নারী, সুগারের রোগী, বয়স্ক মানুষ এবং ব্যায়ামবিদদের আলাদা করে প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে প্রোটিন পাউডার দেয়া যায়। তবে অবশ্যই পুষ্টিবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে দেয়া উচিত।
এছাড়াও বাজারে দুগ্ধজাত প্রোটিন পাওয়া যায় যা শরীরের শক্তির চাহিদা বাড়ায়, পেশিকে সতেজ রাখে এবং পেশির ক্ষয়রোধ করে। তবে এই ধরনের প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট নেয়ার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ জরুরি।
* প্রোটিন কি ওজন কমাতে সাহায্য করে?
** প্রোটিনের মধ্যে অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে। এছাড়াও প্রোটিনের একটা নিও গ্লুকোজেনেসিস ধর্ম আছে। ফলে ডায়েটে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে ও প্রোটিনের মাত্রা বাড়িয়ে ওজন কমানো যায়। এছাড়া প্রোটিনের একটা গতিশীল ধর্ম আছে যার জন্য ওজন কমাতে প্রোটিন অনেকটা সাহায্য করে।
* প্রোটিনজাতীয় খাদ্য রাতে খাওয়া উচিত নয় বলে অনেকে মনে করেন?
** দিনের শুরুতে আমাদের শরীরের বিপাক ক্রিয়ার হার অনেক বেশি থাকে। সেই কারণে সকালে পর্যাপ্ত মাত্রায় প্রোটিন ও অন্যান্য খাবার খেতে বলা হয়। তবে রাত যত বাড়তে থাকে বিপাকের হার ততই কমতে থাকে। এ কারণেই ডিনারে প্রোটিনের পরিমাণ কম রাখাই ভালো।
* কোন কোন রোগে অতিমাত্রায় প্রোটিনযুক্ত খাদ্য খাওয়া যাবে না?
** সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনির সমস্যা থাকলে প্রোটিনজাতীয় খাদ্য গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
* কিডনির সমস্যায় প্রোটিন কি সম্পূর্ণ বন্ধ করা উচিত?
** কিডনির অসুখের অনেকগুলো পর্যায় আছে। সেই পর্যায় অনুযায়ী রোগীকে প্রোটিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে বলেন চিকিৎসক।
* উদ্ভিজ প্রোটিন নাকি প্রাণীজ প্রোটিন, কোনটা বেশি উপকারী?
** যেকোনো প্রোটিনই শরীরের পক্ষে উপযোগী। মাছ-গোস্ত-ডিমের সমতুল্য প্রোটিন পেতে যেকোনো প্রকার ডাল, সয়াবিন, রাজমা, পনির, টকদই খাওয়া যেতেই পারে। তবে ভিটামিন বি১২, আয়রন, ক্যালশিয়াম, প্রোটিন একসঙ্গে পেতে চান চাইলে মাছ, গোস্ত, ডিমেই ভরসা রাখতে হবে।
* অনেকে দুধ খেতে পারেন না। তারা কীভাবে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করবেন?
** দুধে ল্যাকটোজ থাকে, যা অনেকে সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু দুধ থেকে যখন ছানা তৈরি হয় তখন ল্যাকটোজের মাত্রা কমে গিয়ে ‘কেসিন’ নামক এক ধরনের প্রোটিনের মাত্রা বাড়তে থাকে। যার ফলে ছানায় দুধের থেকে বেশি প্রোটিন থাকে। সুতরাং দুধ খেতে না পারলেও ছানা, পনির, টকদই থেকে দুধের চেয়েও বেশি প্রোটিন পাওয়া সম্ভব।
১০০ গ্রাম গরুর দুধে আনুমানিক ৩.২ গ্রাম প্রোটিন থাকে। সেক্ষেত্রে ১০০ গ্রাম গেরুর দুধের ছানায় প্রোটিনের পরিমাণ ১৮ গ্রাম, আর ১০০ গ্রাম পনিরে প্রোটিনের মাত্রা ২৪.১ গ্রাম।
* একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত ডায়েটে প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেটের অনুপাত কেমন হওয়া উচিত?
** পূর্ণবয়স্ক মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত ডায়েটে প্রোটিন, ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেটের অনুপাত হওয়া উচিত।

No comments

Powered by Blogger.