অনবদ্য মানবাধিকার সংগ্রামী আসমা জাহাঙ্গীরের চলে যাওয়া



আসমা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে মানবাধিকারের জন্য অনবদ্য লড়াই করে যাওয়া এক সংগ্রামীকে হারাল পাকিস্তান। তিনি দেশটির একজন খ্যাতিমান আইনজীবী ছিলেন। নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে তিনি হৃদয়ে যা ধারণ করতেন, সেটিকে সমাজে ছড়িয়ে দিতে ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে একজন আইনজীবী হিসেবে নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা কাজে লাগিয়েছেন। নারী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার আদায়ে তিনি সারাটা জীবন লড়াই করে গেছেন। দেশটির সাধারণ মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করার আন্দোলনে তিনি নিজেকে সবসময় এগিয়ে রেখেছেন। নারীদের সমঅধিকার আদায়ে ‘উইমেন অ্যাকশন’ ফোরামের (ডব্লিউএএফ) সহপ্রতিষ্ঠতা ছিলেন তিনি। ১৯৮১ সাল থেকে সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। কর্মস্থল, বিশেষ করে আইন পেশায় নারীদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে ‘উইমেন অ্যাকশন’। ১৯৮৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক হুদদ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে ডব্লিউএএফ। পাঞ্জাবের নারী আইনজীবী ফোরামের সদস্য হিসেবে তিনি তাতে যোগ দেন। জেনারেল জিয়াউল হক ধর্ম ও আইনের মধ্যে যে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন, সেটির বিরুদ্ধে এটি ছিল প্রথম কোনো প্রতিবাদ। এর পর পাকিস্তানের নারী অধিকারের লড়াইয়ে ডব্লিউএএফ ও আসমা জাহাঙ্গীর সবচেয়ে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। মানববন্ধনে যোগ দিতে গেলে আসমা জাহাঙ্গীরসহ অন্য অ্যাকটিভিস্টদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়, পুলিশের পিটুনি ও গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। পাকিস্তানে অনার কিলিংয়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। ২০০৩ সালে সায়মা ওয়াজেদ মামলায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ওই মামলার কারণে দেশটির নারীরা নিজেদের পছন্দমতো বিয়ে করার অধিকার পায়। এর আগে বাবা কিংবা ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া কোনো মেয়ে বিয়ে করতে পারতেন না। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে ছিলেন। আশির দশকে জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। যে কারণে ১৯৮৩ সালে তাকে আটক হতে হয়েছিল। ২০০৭ সালে সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফের সময় তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২০১২ সালে তিনি দাবি করেন, গোয়েন্দা সংস্থা তার জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সামরিক আদালতে বেসামরিক লোকজনের বিচারের বিরোধিতা করে গেছেন তিনি।
মৃত্যুদণ্ডসহ সামরিক আদালতে দেয়া বিভিন্ন সাজার বিরুদ্ধে তিনি সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেছিলেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সামাজিক প্রান্তিক লোকদের অধিকার আদায়ে তিনি পক্ষপাতহীন ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৯৩ সালে ১১ বছর বয়সী খ্রিস্টান বালক সালামাত মাসিহ ও তার চাচা মনজুর মাসিহ ও রেহমাত মাসিহ ধর্ম অবমাননার অভিযোগে লাহোর হাইকোর্টে অভিযুক্ত হন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তারা মসজিদের দেয়ালে ইসলামের বিরুদ্ধে লিখেছেন। আসমা জাহাঙ্গীর ওই খ্রিস্টান পরিবারের পক্ষে দাঁড়ান। ১৯৯৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি নজিরবিহীন রায়ে ওই খ্রিস্টান পরিবারটি খালাস পায়। তিনি মানুষের বাকস্বাধীনতার গোড়া সমর্থক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে প্রচার ছিল, তিনি পাকিস্তান ও ইসলামবিরোধী। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন বলে সহকর্মী আইনজীবীরা তার ওকালতির সনদপত্র বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন। কিন্তু তিনি নিজের নীতিতে অবিচল ছিলেন। কখনও পিছপা হয়েছেন এমনটি ঘটেনি। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারপারসন আসমা জাহাঙ্গীর নিখোঁজ ও গুমের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। যেসব পরিবারের সদস্যরা গুমের শিকার হয়েছেন, ন্যায়বিচারের জন্য তাদের পক্ষ হয়ে তিনি লড়েছেন। পাকিস্তানে খুব কম আইনজীবী আছেন, যারা নিখোঁজ ও গুমের মামলা নিতে ইচ্ছুক ছিলেন। এ কারণেই তাকে সরাসরি রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো। কোনো প্রক্রিয়া ও প্রমাণ ছাড়াই বিভিন্ন সময় তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। একান্ত তার চেষ্টার কারণেই অনেক পরিবার তাদের নিখোঁজ হওয়া সদস্যদের সন্ধান পেয়েছেন। ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট কোয়েটায় হামলা হলে তার ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। ওই হামলায় ৭০ নিহত ও ১৩০ জনেরও বেশি আহত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতের উগ্রহিন্দুত্ববাদী নেতা বাল থ্যাকারের সঙ্গে তার বৈঠকের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে তিনি ব্যাপক নিন্দা ও ক্ষোভের মুখোমুখি হন। সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ ছিল অবিসংবাদিত। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের এই অগ্রদূত মানবাধিকার সংগ্রামীদের কাছে যুগযুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.