মার মার কাট কাট ব্যবসার কবলে শিক্ষা by আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন একটা ‘কালাজ্বরে’ আক্রান্ত। নাম তার ‘প্রশ্নফাঁস’। বোর্ড পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির পরীক্ষা- সে যাই হোক, পাবলিক পরীক্ষা হলেই এখন, অনেকেই আগে প্রশ্ন পেয়ে যাচ্ছে। সেটা কখনও পুরো প্রশ্নপত্র, কখনও বা আংশিক। কখনও সরাসরি, কখনও প্রযুক্তির বরাতে (ফেসবুক, হোয়াটস্আপ, মেসেঞ্জার, ভাইবারে) প্রশ্ন পৌঁছে যাচ্ছে পরীক্ষার্থীদের হাতে হাতে বা ল্যাপটপ-মোবাইলে। পরীক্ষার আগের রাতে বা সকালে শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা চড়ামূল্যে কিনে নিচ্ছে সেই প্রশ্নপত্র বা প্রশ্ন। এ বিকিকিনিতে ‘প্রশ্নফাঁস’ হয়ে উঠেছে এক ‘মার মার কাট কাট’ ব্যবসা। হয়ে উঠেছে শিক্ষাব্যবস্থার অনিবার্য গলার কাঁটা। হয়ে উঠেছে এক দুরোরোগ্য ‘গোদফোঁড়া’। গোদফোঁড়া বলছি, কারণ পাবলিক পরীক্ষাগুলো প্রায়ই এখন প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে দুষ্ট। তার সর্বশেষ নমুনা, চলমান এসএসসি পরীক্ষা। চলতি এসএসসি পরীক্ষার ১ম পাঁচটি পরীক্ষার প্রায় প্রত্যেক দিনই কোথাও না কোথাও প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছে এবং মোবাইলে প্রশ্নসহ একাধিক জনকে আটক করা হয়েছে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, পরীক্ষা হবে, প্রশ্নফাঁস হবে না- এ যেন এখন ভাবনাতীত বিষয়। সরকার যে চেষ্টা করছে না, তা নয়। কিন্তু প্রশ্নফাঁসকারী চক্রটা এতটাই শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ, তাদের দৌরাত্ম্যের কাছে প্রশাসনকে রীতিমতো অসহায় মনে হচ্ছে। তারা কার্যত কাউকে, কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করছে না। রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ নেয়ার নেশায় তারা এতটাই মত্ত ও বেপরোয়া যে, তারা এখন রীতিমতো প্রকাশ্যে এবং আগাম ঘোষণা দিয়ে প্রশ্নফাঁস করছে। তাদের আস্ফালন ও স্পর্ধা দেখলে রীতিমতো ভিরমি খেতে হয়।
বিষয়টিকে দুরোরোগ্য বলছি কারণ, রোগটি ওষুধে সারছে না। ওষুধের নাম, ১৯৮০ সালের পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৪ ধারা। ওই আইনে প্রশ্নফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ দণ্ডনীয় অপরাধ। যার সাজা জরিমানাসহ ৩-১০ বছর কারাদণ্ড। অবিশ্বাস্য হল, আইনটি পাসের ২৭ বছরেও এ আইনে কারও সাজা হওয়ার দৃষ্টান্ত নেই। আরও অবিশ্বাস্য হল, ২০১৫ সালের প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায় প্রশ্নফাঁসের সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছর থেকে কমিয়ে ৪ বছর করা হয়। অথচ, প্রশ্নফাঁসের ঘটনা তখন নিয়মিত। লক্ষণীয় হল, ২০১৫ সালের ২০ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। প্রশ্নফাঁসের সাজা কমানোয় তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে। বাধ্য হয়ে তখন, আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা পরিমার্জনের কথা বলে এক সপ্তাহের মধ্যে খসড়াটি সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর ১৬ মাস গেল। অথচ, আইন বাদ, খসড়াটিই এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এরকম একটা জঘন্য অপরাধে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এমন গোলমেলে হয়, তাহলে সমাধানটা কোথায়? সত্যি বলতে কী, এ পর্যন্ত কোনো প্রশ্নফাঁসের ঘটনার কার্যকর কোনো সুরাহা হয়নি। প্রতিটি অঘটনের দৌড় তদন্ত কমিটি, সুপারিশ, দু-চারজন গ্রেফতার পর্যন্ত। আর এগোয় না বিষয়টি। কারা, কীভাবে কাজটি করে বা করছে, প্রশ্নফাঁসের মূল হোতা কারা, তা কখনও জানা যায়নি। চুনোপুঁটি যারা ধরা পড়ে, তারাও জামিনে বেরিয়ে আরও বীরদর্পে অপকর্ম চালায়। পত্রিকার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ছয় বছরে (সেপ্টেম্বর, ২০১৫ পর্যন্ত) রাজধানীতে দায়ের হওয়া ৭০টি মামলায় কোনো আসামির সাজা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ একটি মামলাও প্রমাণ করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ১১ মামলায় সব আসামিই অব্যাহতি পায়। বাকি মামলায় বেশিরভাগ আসামি মামলা থেকে অব্যাহতি ও খালাস পায়। অনেক আসামি জামিন নিয়ে আর আদালতে হাজিরা পর্যন্ত দেয় না। ওই ৭০টি মামলার সিংহভাগ ক্ষেত্রে আদালতের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘অভিযোগ গঠনের উপাদান না পাওয়ায় আসামিদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে।’ ওই ৭০টি মামলার অধিকাংশই হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ও জালিয়াতির অভিযোগে (প্রথম আলো, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫)। অবশ্য আশার কথা, ৭ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ীতে এসএসসির ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র প্রশ্নফাঁসের সময় তিনজনকে হাতেনাতে ধরে মোবাইল কোর্ট দুজনকে ৬ মাস ও একজনকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে বিষয়টি কার্যত গুরুপাপে লঘুদণ্ড। পরিহাস হচ্ছে, সরকার প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে তো পারছেই না, উল্টো অভিযোগ উঠলেই দায়িত্বশীল মহল বেশিরভাগ সময় বিষয়টিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রেস কনফারেন্স, আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগকে সরকার মিথ্যা ঘোষণা পর্যন্ত করে। যেমনটি হয়েছিল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠল। একাধিকজন প্রশ্ন ও উত্তরপত্রসহ গ্রেফতার হল। তারপরও সরকার অভিযোগ অস্বীকার করল। ওই পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে তখন বিভিন্ন মহলের কত প্রতিবাদ! ভর্তিবঞ্চিতদের কত মিছিল-মিটিং, আন্দোলন। কিন্তু সব ‘লব ডঙ্কা’। অবশ্য, এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। চলমান এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি সরকার আর সরাসরি ‘গুজব’ বলছে না। খবরে প্রকাশ পায়, শিক্ষামন্ত্রী দায়টা নিজের কাঁধে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদ থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। অথচ গত বছর এসএসসির সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘প্রমাণ মিললে চলতি এসএসসির গণিত পরীক্ষা বাতিল করা হবে’।
তবে সেখানে অনেক ‘কিন্তু’ জুড়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, প্রশ্ন কখন ফাঁস হয়েছে, কীভাবে কতটুকু ফাঁস হয়েছে, পরীক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব কতখানি পড়েছে, তা খতিয়ে দেখার পর পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে (কালের কণ্ঠ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)। তবে বাস্তবতা হল, ওই অভিযোগ সহজে প্রমাণিত হয় না। শিয়ালকে মুরগি চুরির তদন্ত দিলে, ঘটনার সত্যতা মিলবে নাকি? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে ‘প্রশ্নফাঁস’-এর ফাঁসে আটকা পড়েছে, তার পরিণতি ভয়াবহ ও সুদূরপ্রসারী। এবারের এসএসসির কথাই ধরুন। এসএসসির ফল প্রকাশ পেলে হয়তো দেখা যাবে, ফাঁসকৃত প্রশ্ন পাওয়া পরীক্ষার্থীরাও জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। তারপর হয়তো একদিন, ‘জিপিএ’ বা ‘এসএসসি’ মানে কী জিজ্ঞেস করলে বলবে, ‘জানি না’। কিংবা ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ কবে বা ‘রাষ্ট্রপতির নাম’ জানতে চাইলে তা-ও বলবে ‘সরি, জানি না’। ‘আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি’ এর ইংরেজি অনুবাদ বলবে, ‘I am GPA-5’, ‘I gave GPA-5’। বলবে ‘স্বাধীনতা দিবস হল ১৬ ডিসেম্বর’, ‘বিজয় দিবস হল ২৬ ডিসেম্বর’, ‘জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা নজরুল ইসলাম’, পীথাগোরাস একজন ঔপন্যাসিক ইত্যাদি ইত্যাদি..। কিংবা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ কী জানতে চাইলে বলবে, অপারেশন করার সময় যে লাইটটা জ্বালানো হয়, সেটাই ‘অপারেশন সার্চলাইট’!! (তথ্যসূত্র-মাছরাঙা টিভির জিপিএ-৫ বিষয়ক প্রতিবেদন)। এ অবৈধ পন্থায় পাসের পরিণতি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ওই পথের পথিকরা আগামীতেও সব পরীক্ষার (প্রাতিষ্ঠানিক বা চাকরি সংক্রান্ত) বৈতরণী একই পন্থায় পার হতে চাইবে। এমনকি অন্যদেরও বিপথগামী করবে। এ বিপথগামিতা, একটা সুষ্ঠু ও অগ্রসর শিক্ষাব্যবস্থাকে কেবল ধ্বংস বা জাতিকে মেধাশূন্য করাই নয়; সাধারণ, নিরীহ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। দুর্ভাগ্য, সেই প্রশ্নফাঁসই এখন আমাদের উদ্ধারহীন নিয়তি। তারপরও আমরা আশাবাদী। একটা সময় ছিল, নকলছাড়া পাবলিক পরীক্ষা ছিল অকল্পনীয়। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দেখিয়েছেন, নকলমুক্ত পরীক্ষা চাইলে এদেশেও তা সম্ভব। নকলের স্থানটা এখন প্রশ্নফাঁসের দখলে। তাই শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা, তিনি এবার পরীক্ষাগুলোকে ‘প্রশ্নফাঁস’ মুক্ত করবেন। জাতিকে প্রশ্নফাঁসের ফাঁস থেকে উদ্ধার করবেন। দেশের শিক্ষাকে কলঙ্কমুক্ত করবেন। আর সেটা সম্ভব, যদি বিদ্যমান প্রশ্ন প্রণয়ন ও সরবরাহ ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও কঠোর নজরদারিতে রাখা যায়। সম্ভব, যদি প্রশ্নফাঁসকারীদের গলায় সর্বোচ্চ দণ্ডের ফাঁস পরানো যায়।
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
aftabragib2@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.