ট্রাম্পের জেরুসালেম ঘোষণা : ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবরোধই কাম্য by ডায়ানা বুট্টু

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তার প্রশাসন অধিকৃত জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।­ তিনি দাবি করেন, ‘এতে শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে এবং একটি স্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষর করার লক্ষ্যে এই ঘোষণা কাজ করবে।’ প্রায় ৭০ বছরের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে বাতিল করে দিয়ে ট্্রাম্প ওই ঘোষণা দিলেন। এটা কেবল ট্রাম্পের ভুলই নয়, বরং তার এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের পরিবর্তে আগ্রাসনের ভিত্তিতে হুমকি প্রদানের নজির স্থাপন করে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হলো। জাতিসঙ্ঘের ১৯৪৭ সালের পৃথকীকরণ বা বিভাজন আইন অনুসারে, অধিকৃত জেরুসালেম কখনো কোনো দেশের রাজধানী হতে পারে না। আন্তর্জাতিক সরকারের অধীনে একটি বিভক্ত শহরের সার্বভৌমত্ব ইসরাইল বা ফিলিস্তিন- কারো হতে পারে না। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূখণ্ড দখল করার জন্য অগ্রসর হয়েছিলেন, তখন তারা পশ্চিম জেরুসালেমের অর্ধেকেরও বেশি এলাকা দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডের অবশিষ্টাংশ দখল করে নিলে জেরুসালেমের পূর্বাঞ্চলও ইসরাইলের সামরিক শাসনের আওতায় চলে যায়। কিন্তু ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইল অনেকবার অধিকৃত জেরুসালেমকে তাদের রাজধানী ঘোষণার উদ্যোগ নিলেও বিশ্বের একটি দেশও তাদের এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন দেয়নি। তাদের দাবিকে কেউ মেনে নেয়নি। এর একটি মাত্র কারণ হলো- জোরপূর্বক কোনো ভূখণ্ড দখল করা আন্তর্জাতিক আইনে বেআইনি বা অবৈধ। অধিকৃত জেরুসালেম তিনটি একত্মবাদী ধর্মের পবিত্র স্থান। ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ইসরাইল বিশ্বের কাছে এই বার্তাই প্রেরণ করছে যে, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এবং যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিয়েছে যে, ইসরাইল তার সীমান্তের বিস্তৃতি ঘটনানোর জন্য যেকোনো সময় তার ইচ্ছানুযায়ী শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। ওই ধরনের নজির মেনে নেয়া বিশ্বের উচিত হবে না। ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান উভয় দলের প্রেসিডেন্টদের বেশ কয়েক বছরের নিষ্ক্রিয়তার পর ট্রাম্পের জেরুসালেম ও মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়া নিয়ে এই বক্তব্য এলো। অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে একমাত্র ইসরাইলি কলোনি নির্মাণ করছে, ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে ও ধ্বংস করে সেগুলোর ওপর ইসরাইলি কলোনি নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি নীতি লঙ্ঘন করে পাঁচ দশক ধরে এসব অপতৎপরতা চললেও আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা অলসভাবে এসব প্রত্যক্ষ করে আসছিলেন। আন্তর্জাতিক আইনে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়নি।
ট্রাম্প যে ‘শান্তিপ্রক্রিয়া’ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি করেছেন, প্রকৃতপক্ষে তাতে কেবল ইসরাইলকে অব্যাহতভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড চুরি করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র মাঝে মধ্যে ইসরাইলি বসতি সম্প্রসারণের নিন্দা করেছে, তবুও বছরের পর বছর ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সহায়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য ইসরাইলের সামরিক দখলদারিত্বের অবসান ও ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনভাবে বসবাস করতে দেয়ার লক্ষ্যেও ইসরাইলকে উৎসাহিত করা হয়েছে। এখন ট্রাম্প ইসরাইলকে যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে স্পষ্টত আমেরিকা ইসরাইলের অবৈধ কর্মকাণ্ড মেনে নিয়েছে এবং ইসরাইলের ব্যাপারে কাউকে পরোয়া করবে না যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ তাদের প্রতি অন্ধ সমর্থন অব্যাহত রাখবে। যখন ট্রাম্প হয়তো চিন্তা করবেন, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি শাসনের অবসান ঘটানোর পথ হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা। তাহলেও তিনি ভুল করবেন। অনেকে দাবি করেন, ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলিরা বেশ কয়েক বছর আলোচনায় জড়িত থাকার মাধ্যমে একটি চুক্তির কাছাকাছি এসে পৌঁছেছিল। এই আলোচনায় কয়েক বছর কেউ একজন সম্পৃক্ত ছিল। বাস্তবতা হলো, এ ক্ষেত্রে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। আলোচনায় ইসরাইল চাপ দিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের ইসরাইলের ভুলগুলো মেনে নিয়ে নিজেদের অধিকার ত্যাগ করতে হবে। আমাদের তথা ফিলিস্তিনিদের বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি ভূমি চুরি করা বহাল রাখার জন্য ইসরাইলকে কলোনি নির্মাণ অব্যাহত রাখতে দিতে হবে। অপর দিকে শান্তির স্বার্থে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের কখনো নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া যাবে না। আমাদের বলা হলো, অধিকৃত জেরুসালেমকে একটি অংশীদারিত্বপূর্ণ উন্মুক্ত শহর হিসেবে গণ্য করে আলোচনা করা যেতে পারে। বিষয়টি আলোচনার টেবিলে আনা গেলেও এ ব্যাপারে সমতার দাবি করা যাবে না। আর এই আলোচনা এখন ২৫তম বছরে গিয়ে যখন পড়েছে, তখনও বাস্তবতা হলোÑ ফিলিস্তিনিরা কেবল ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে। সত্যিকার অর্থে, ১৯৯৩ সালে শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিম তীরের অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে অবৈধ ইসরাইলি কলোনির সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৩ সালে এই অবৈধ ইহুদি কলোনি ছিল দুই লাখ আর এখন তা ছয় লাখেরও বেশি। বিশ্ব জেরুসালেমকে যে আন্তর্জাতিক নগরী করার আহ্বান জানিয়েছিল, তা দূরের কথাÑ এখন ইসরাইলের অধিকৃত জেরুসালেমকে ইহুদিদের শহর তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে পরিকল্পিতভাবে এমন সব নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে অধিকৃত জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের জীবনযাপন করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। পার্শ্ববর্তী, অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজায় যেসব ফিলিস্তিনি খ্রিষ্টান ও মুসলিম বসবাস করেন, তাদের নগরীতে পবিত্র স্থানগুলোতে গিয়ে প্রার্থনা করার জন্য ইসরাইলের অনুমতি নিতে হয়। এটা শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো ব্যবস্থা নয়, বরং এটা হলো উন্নাসিকতা। ফিলিস্তিনিরা এই দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের ঘোষণার আগে এই আলোচনা প্রায় বন্ধ ছিল। কিন্তু ঘোষণার পর মনে হয় এখন এই আলোচনা অবাস্তব। কিভাবে ফিলিস্তিনিরা এমন একটি প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকবে, যেটাতে ইসরাইলের শাসনাধীনে থাকাটাকে আরো সুরক্ষিত করে ইসরাইলের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হয়েছে? অধিকৃত জেরুসালেমে বহু বছর কাটিয়েছি। সেখানে ফিলিস্তিনিদের অবস্থা স্পষ্টভাবেই খারাপ হতে দেখেছি। ইসরাইলের ২৫ ফুট কংক্রিটের দেয়াল নির্মাণ, আমলাতান্ত্রিক মিথ্যা কারণ দেখিয়ে ফিলিস্তিনিদের হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংস করা, বন্ধুদের তাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়া, অবৈধ কলোনি নির্মাণ অথবা ফিলিস্তিনিদের চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য অসংখ্য চেকপয়েন্ট বসানো ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বৃদ্ধি এবং তাদের ক্রমেই কোণঠাসা করার প্রয়াস অব্যাহত রাখা হয়েছে। অধিকৃত জেরুসালেমের প্রায় তিন লাখ ফিলিস্তিনির ওপর এখন অত্যাচার ও নিষ্পেষণ চালানো হচ্ছে। তারা ইসরাইলের সামরিক শাসনাধীনে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় জীবনযাপন করছে। অধিকৃত জেরুসালেমকে যারা ফিলিস্তিনিমুক্ত করতে চায়, ট্রাম্পের ঘোষণা কেবল তাদের উৎসাহিত করবে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, বিশ্ব জেরুসালেমে ইসরাইলের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে আর কিছুতেই মেনে নেবে না বলে তাদের কাছে শক্তিশালী বার্তা পাঠিয়েছে। জেরুসালেমে ইসরাইলের অবৈধ কার্যক্রমের কারণে যেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস ব্যাহত হচ্ছে। ইসরাইলি কর্মকাণ্ডের প্রতি অন্ধ সমর্থন অথবা তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে পুরস্কৃত করার পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়ের উচিত অবিলম্বে ইসরাইলের ওপর অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। ইসরাইলি নেতৃবৃন্দ এবং বিশ্ব অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা আরাপ করা প্রয়োজন ইসরাইল আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এ কথাটি জানানোর জন্য।
লেখক : ফিলিস্তিনি আলোচক, চীনের একজন আইন উপদেষ্টা এবং ইসরাইল ও পিএলওর আলোচনায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

No comments

Powered by Blogger.