বেড়েই চলেছে ওষুধ রপ্তানির সম্ভাবনা by এম এম মাসুদ

গত কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে ওষুধ রপ্তানি। বর্তমানে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে ১৫১টি দেশে। গত বছর ছিল ১২৭টি দেশ। আর গত ৬ বছরেই ওষুধ থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৩ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। প্রতিবছরই রপ্তানি বাড়তে থাকায় ওষুধকে ২০১৮ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে আগামীতে বিশাল সম্ভাবনা দেখছে ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা।
আর রপ্তানি বাড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতির পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোতে রপ্তানি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে গত সপ্তাহে ওষুধ উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির বিশাল সমাহারে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হলো ‘এশিয়া ফার্মা এক্সপো-২০১৮’। এই প্রদর্শনীতে ওষুধ শিল্পের সর্বশেষ প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছিল দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এর আয়োজক ছিল বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, স্বাধীনতার পর বিদেশ থেকে বেশির ভাগ ওষুধ আমদানির মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা হতো। আর বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ১৫১টি দেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ দিনদিন বাড়ছে। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মূল্য প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে দেশের ওষুধ। যে কারণে রপ্তানির পরিমাণও ব্যাপক। এছাড়া ওষুধের গুণগতমান বজায় রাখায় বিদেশি বাজারে বাংলাদেশের ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের ওষুধ বাণিজ্যের ১০ শতাংশ দখল করা সম্ভব। এতে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। একই সঙ্গে এ খাতে ২ লাখেরও বেশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি এক সেমিনারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, প্রতিনিয়ত দেশে ওষুধ রপ্তানি বাড়ছে। স্বাধীনতার পর দেশে অনেক ওষুধ আমদানি করতে হতো। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ ওষুধ আমদানি করা হচ্ছে; যা ভবিষ্যতে দেশের তৈরি ওষুধ চাহিদা মেটাবে।
ওষুধ শিল্প মালিকদের মতে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ২০৩৩ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বের ছাড়ের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। এটাকে কাজে লাগাতে হবে। বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা আর বিশ্ববাজারের সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ওষুধ রপ্তানিতে এশিয়ার শীর্ষে উঠে আসবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান মো. ফেরদৌস উদ্দিন খান বলেন, আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সব ওষুধ কোম্পানি বিশ্বমানের হবে বলে আশা করছি। সেই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছি। এজন্য সরকারও আমাদের বিভিন্ন সহযোগিতা করছে। এই শিল্পের উন্নয়নে সরকারের আরো সহায়তা প্রয়োজন। এই শিল্পের জন্য ভর্তুকি ও ট্যাক্স সুবিধা দেয়া জরুরি। ফার্মা এক্সপো সম্পর্কে তিনি বলেন, মেলায় ভালো সাড়া পেয়েছি। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাত ওষুধ শিল্প। এ খাতকে এগিয়ে নিতে এই আয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করে ৩৮৬ কোটি টাকা। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৮ কোটি টাকা। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫৪ কোটি টাকা। এরপর ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ কিছুটা কমে হয় ৫৪১ কোটি টাকা। এরপর আবার রপ্তানি আয়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে আয় হয় ৬৫৭ কোটি টাকা ও ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করে আয় করে ৭১৪ কোটি টাকা। ওষুধ রপ্তানিকারকরা মনে করছেন, রপ্তানি বৃদ্ধির হার প্রত্যাশিত মাত্রার নয়। আর রপ্তানি আয়ও তুলনামূলক কম। তবে রপ্তানির পরিমাণ ও দেশের সংখ্যা আগামীতে আরো বাড়বে বলে আশা করছেন।
ওষুধ শিল্প সমিতির সূত্র জানায়, রপ্তানি আরো বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। ইতিমধ্যে দেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ওষুধ রপ্তানির অনুমোদন পেয়েছে। ফলে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ রপ্তানির দরজা খুলছে। এখন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব কারখানায় ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে উৎপাদনও অনেকগুণ বেড়েছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং দক্ষ ফার্মাসিস্টদের সহায়তায় বর্তমানে ক্যানসারের মতো জটিল রোগের ওষুধও দেশেই উৎপাদন হচ্ছে।
বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সত্তরের দশকে যেখানে দেশের চাহিদার ৭০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হতো, সেখানে এখন নিজেদের চাহিদার ৯৮ শতাংশ মিটিয়ে ১৫১টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে প্রতি বছর দেশ আয় করছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে এ শিল্পে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর রপ্তানি পণ্যে পরিণত হবে ওষুধ শিল্প। বর্তমানে দেশের দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারের বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে, যার মধ্যে বড় ১০ কোম্পানি দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করে। বড় ২০ কোম্পানি বিবেচনায় নিলে তারা মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ সরবরাহ করছে। আর ৪০ কোম্পানি ১৮২টি ব্র্যান্ডের সহস্রাধিক রকমের ওষুধ রপ্তানি করছে। আর দেশের ভেতরেই তৈরি হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার বাজার।
ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎকৃষ্টমানের ওষুধ উৎপাদন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানিতে অগ্রগামিতা অর্জনের মাধ্যমে আঞ্চলিক পর্যায়ে ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, ওষুধ রপ্তানিতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই পোশাক খাতকে ধরতে পারবো। কারণ ওষুধ রপ্তানি প্রতি বছরেই বাড়ছে। ফলে আমরা বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না। তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জের এপিআই পার্ক পুরোপরি চালু হলে ওষুধ শিল্পের কাঁচামালের জন্য আর কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না।
জানা গেছে, সরকার এ বছর ওষুধের কাঁচামাল রপ্তানির ওপর নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে ২০ শতাংশ। তবে রপ্তানির ওপর নগদ প্রণোদনাসহ সরকারি সহযোগিতা পেলে রপ্তানি আয় আরো বাড়বে মনে করে ওষুধ শিল্প সমিতি। এদিকে নজরদারির অভাবে নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে বাজারজাত করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান যাতে দেশের সুনাম নষ্ট করতে না পারে সেদিকে নজর রাখার তাগিদ বিশ্লেষকদের।

No comments

Powered by Blogger.